জীবনের আঁচে তপ্ত করেছি দুহাত ভাই।
আগুন নিভিছে, এবার আমিও বিদায় চাই।
নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনোবৃত্তির মতো এ মনোবৃত্তিও যুক্তিসঙ্গত বটে। তাহলে দেখতে পাওয়া যায়, যুক্তি কেবল নৈরাশ্যবাদের পক্ষেই নয়, আশাবাদের পক্ষেও রয়েছে।
ইকলেজিয়েটসের দুঃখের কারণ দেখলুম। এবার কুচের দুঃখের কারণটা কী, ভেবে দেখবার চেষ্টা করছি। ক্রুচের দুঃখের গোড়ায় রয়েছে শাশ্বত আদর্শের অভাব। মধ্যযুগে, এমনকি আধুনিককালের শুরুতেও যে-সকল আদর্শের জন্ম হয়েছিল, তা আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তিনি দুঃখিত। তার মতে, আধুনিককালের সংকট আর যৌবন-উন্মুক্ত অবস্থায় সংকট প্রায় এক পর্যায়ের। যৌবন-উমুখ অবস্থায় যেমন মানুষ ছেলেবেলাকার পৌরাণিক কাহিনীর সহায়তা ছাড়া কোনো ব্যাপারেই সুরাহা করতে পারে না, আধুনিককালের সঙ্গে পূর্ণ পরিচিতি ঘটেনি বলে একালের মানুষও তেমনি সেকালের ভাবাদর্শকে এড়িয়ে চলতে পারছে না। মৃত-কালের ভাবাদর্শ তাকে ভূতের মতো চেপে ধরেছে, তার হাত থেকে সে আর মুক্তি পাচ্ছে না। তাই অভ্যন্তর-দ্বন্দ্ব তার ললাটলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুচের উক্তি উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেবলমাত্র সাহিত্য-পড়া চেঁআধুনিকদের বেলা তাঁর উক্তি বাস্তবিকই সত্য। ভাবাবেগের উপর নির্ভরশীল বলে তারা বিজ্ঞানে আস্থা স্থাপন করতে পারে না, উল্টো বিজ্ঞানের খুঁত ধরে বেড়ায়। তাই অন্যান্য সাহিত্যপ্রিয় লোকের মতো কুচও বিজ্ঞানের ওয়াদ-খেলাপের অভিযোগ আনেন কিন্তু বিজ্ঞানের ওয়াদাটা যে কী ছিল, সে সম্বন্ধে কিছুই বলেন না। শুধু এই বলে আফসোস করেন যে, ষাট বছর আগে ডারউইন ও হাক্সলি বিজ্ঞান থেকে যা আশা করেছিলেন, বিজ্ঞান তা দিতে পারেনি। কিন্তু এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। ভাবমার্গী লেখক ও পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরাই নিজেদের বুজরুগি রক্ষার জন্য এ ধরনের কথা বলে থাকেন। ক্রুচ সাহেবও তার দলে ভিড়েছেন।
বর্তমানে জগতে যে বহু অশুভদর্শী মানুষ রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। তবে তার কারণ বিজ্ঞানের ব্যর্থতা নয়, অন্য কিছু। যুদ্ধের জন্য যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তারই ফলে এই দুঃখবাদের জন্ম। দুঃখবাদ চিন্তার ব্যাপার নয়, ‘মুডের’ ব্যাপার। আর মুড সৃষ্টি করে বাস্তব ঘটনা, দর্শন বা জগৎ সম্বন্ধে ধারণা নয়। সুতরাং একালের দুঃখবাদী মনোভাবের জন্য একালের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দায়ী না করে জগতের বাস্তব অবস্থাকে দায়ী করাই ভালো। ক্রুচ তো বলেছেন, কতকগুলি স্থির বিশ্বাস থেকে চ্যুত হয়েছে বলেই আধুনিককালে মানুষের এই দুরবস্থা। কিন্তু তার মতে সায় দেওয়া যায় না। ইতিহাস তার বিরুদ্ধে। ত্রয়োদশ শতকে তো স্থিরবিশ্বাসের কমতি ছিল না। অথচ সে যুগের মতো নৈরাশ্যব্যঞ্জক যুগ বিরল। রোজার বেকনের মতে, সে-যুগে কামুকতা ও লোভ কেবল সাধারণের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, যাজকশ্রেণীও এই পাপস্রোতে ভেসে চলেছিলেন। তিনি বলেন, সে-যুগের ধার্মিকদের তুলনায় প্যাগান-যুগের সাধু-পুরুষরা অনেক উন্নত চরিত্রের লোক ছিলেন। সংযম, সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। শুধু রোজার বেকন নন, তাঁর সমসাময়িক অপরাপর সাহিত্য-সেবকও তাদের কালকে ভালোবাসতে পারেননি বলে দুঃখ করে গেছেন। সুতরাং বেকন ত্রয়োদশ শতকের যে-ছবি এঁকেছেন, তাতে সহজেই আস্থা স্থাপন করা যায়।
ক্রুচের গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদে রয়েছে প্রেমের আলোচনা। তাতে প্রেমের অভাবের জন্য করুণ সুরে হায়-আফসোস করা হয়েছে। কুচের মতে ভিক্টোরীয় যুগে প্রেমের যে মূল্য ছিল, এযুগে তা নেই। এ যুগ প্রেমহীনতার যুগ। ভিক্টোরীয় যুগে স্কেপটিকগণ বা সন্দেহবাদীরা প্রেমকে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে পূজা করত। একালে তেমনটি আর হচ্ছে না। মানুষের মনে পূজার ভাব রয়েছে! তার প্রকাশ না হলে অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায় না। যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা। সেকালের লোকেরা প্রেমের মারফতে পূজার ক্ষুধা মেটাত। প্রেমের সম্পর্কে এসে কঠিন হৃদয় লোকও মরমীভাবাপন্ন হয়েছে, এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। পরমাত্মা যেমন ত্যাগের প্রেরণা দেন, প্রেম থেকেও তেমনি ত্যাগের প্রেরণা পাওয়া যেত। প্রেমের জন্য সব খোয়াতে তারা প্রস্তুত ছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের যুগে তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে ভিক্টোরীয় যুগ যেরূপ প্রেমময় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেকালের লোকদের কাছে সেরূপ প্রেমময় হয়ে দেখা দেয়নি। যুগের বিভিন্ন ভাবের প্রতিনিধি হিসাবে দাঁড়াতে পারেন, এমন দুটি বৃদ্ধমহিলাকে আমি জানতুম। তাদের একজন ছিলেন পিউরিটান আরেকজন ভটেরিয়ান। তাদের কথাবার্তার মারফতে আমি সেযুগটিকে ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করব। প্রথম মহিলা বললেন : প্রেমের মতো এমন বাজে জিনিস নিয়ে এত কাব্য লেখা হবে কেন, আমি বুঝতে পারিনে। দ্বিতীয় মহিলাটি উত্তর দিলেন : আমি তো বাইবেলের সপ্তম আদেশ ভাঙায় তেমন কিছু পাপ দেখতে পাইনে। অন্তত ষষ্ঠ আদেশ ভাঙার চেয়ে তাযে কম অন্যায় তাতো একরকম নিঃসন্দেহেই বলা যায়। সপ্তম আদেশ ভাঙার বেলা প্রতিপক্ষের অনুমতির যে প্রয়োজন হয় তাতেই অপরাধটি হাল্কা হয়ে পড়ে। মহিলা দুটির কথার সুরেই বুঝতে পারা যায়, প্রেমের প্রতি তারা কেউই শ্রদ্ধাসম্পন্ন নন। একজনের কাছে প্রেম ঘৃণার ব্যাপার, আরেকজনের কাছে হালকা ফুর্তির। তবে ক্রুচ সাহেব ভিক্টোরীয় যুগের প্রেম সম্বন্ধে এমন উঁচু ধারণায় উপনীত হলেন কী করে? তার ধারণার ভিত্তি কী? খুব সম্ভব, যুগের সঙ্গে মিল নেই এমন কোনো লেখকের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ রবার্ট ব্রাউনিঙের নাম করা যেতে পারে। তার প্রেমদর্শন হচ্ছে :