বাংলা সাহিত্য যদি হিন্দুয়ানি ও সংস্কৃত শব্দে বোঝাই হয়ে থাকে, তবে সেখানে তার দুর্বলতা, শক্তি নয়। হিন্দুর অহঙ্কার তাতে স্ফীত হতে পারে, কিন্তু রসিকের রসতৃষ্ণা তৃপ্ত হতে পারে না। কিন্তু দ্বন্দ্বের যুগের চিন্তাশীল মানুষকে সেই দুর্বলতার অনুসরণে উৎসাহিত করেন–যা বর্জনীয় তা-ই গ্রহণীয় বলে প্রচার করেন। তিনি বলেন : হিন্দু যে ওরূপ করেছে, তাতে তার অন্যায় হয়নি, মুসলমান যে করেনি সেইটেই তার অন্যায়। কী চমৎকার যুক্তি! বাংলা সাহিত্য মোটের ওপর উন্নত ও প্রগতিশীল হলেও তার বেশিরভাগই যে বোঝা ও বাজে, তা অনস্বীকার্য। অথচ এই বোঝা ও বাজের অনুসরণ করতে তাঁর উপদেশ।
হিন্দুয়ানি ও মুসলমানিতে সাহিত্য ভারাক্রান্ত করা অন্যায়। কেননা, সাহিত্য গভীর জীবনবোধের ব্যাপার, কোনো আনি’র ব্যাপার নয়। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তা সেখানে মাঝে মাঝে আসতে পারে, কিন্তু সর্বময় প্রভু হয়ে তাকে গ্রাস করতে পারে না। আর মনে রাখা দরকার আনি’র প্রভাব থেকে জীবনকে রক্ষা করা যখন সাহিত্যের, বিশেষ করে আধুনিক চিন্তাসাহিত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য তখন তা নিয়ে কোন্দল অনাধুনিকতারই প্রমাণ। আনি’র প্রভাবে নিয়ে যাওয়া আর জীবনকে কারাগারে বন্দি করা যে এক কথা, চিন্তাশীলের তা বুঝা উচিত। তবে না বুঝলে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না (বুঝলে অবশ্য প্রশংসা করা যায়), কেননা তিনিও অন্যান্য মানুষের মতো যুগের সন্তান এবং অস্থির যুগে মতির প্রশান্তি রাখতে পারে কম লোকেই।
এই অস্থির দ্বন্দ্বময় যুগে রিনেসাঁসের সাধনা সহজ ব্যাপার নয়। রিনেসাঁসের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। কেননা, তা জীবনসূর্যের উপাসনা আর চিন্তামুক্ত না হলে তা সার্থকভাবে করা যায় না। মেঘলা দিনে সূর্য-উপাসনা চলে না, আর এ-যুগ সত্যই মেঘলা যুগ, এ-বিষয়ে সন্দেহের অবসর নেই। শুধু রাজনৈতিক বিরোধ নয়, এ-যুগের অর্থনীতি বা অর্থনীতিহীন যে নৈরাশ্যের সৃষ্টি করেছে, তা দূরীভূত না হলে রিনেসাঁস তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনার সাধনা অসম্ভব।
অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় হয়নি বলে মানবসভ্যতা বারবার ভেঙে পড়েছে এবং এবারও ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। সুতরাং তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। Man does not live by bread alone, he needs spritual food, এ-ধরনের বড় বড় কথা বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু ‘ব্রেডের চিন্তা থেকে মানুষকে রেহাই দেবার চেষ্টা হয়নি একবার। সুতরাং স্পিরিচুয়ালিটি শেষপর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে কথার কথা। ব্রেডের ব্যাপারটি সুব্যবস্থিত করে এই ফাঁকি থেকে যারা মানুষকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন তারা রিনেসাঁসের তথা বুদ্ধি, কল্পনা ও অনুভূতির জয়যাত্রার পথই প্রশস্ত করছেন। তাঁদের হাতে হাত মেলাতে না পারলেও কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানো দরকার।
রুটির কথায় বর্বরতার গন্ধ পেয়ে যে-সকল উন্নাসিক নাসিকা কুঞ্চিত করেন, তাঁদের জানাতে চাই, রুটিকে প্রধান বলে স্বীকার করা হয়নি বলেই তা বারবার সভ্যতাকে আক্রমণ করেছে। সেজন্য বর্বরতার গুটিকায় তার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন হয়েছে। তার প্রতিকার টিকা। বর্বরতাকে প্রথমেই মৃদুভাবে মেনে নিয়ে নিয়ন্ত্রিত করাই হচ্ছে সে টিকা।
সমাজতন্ত্র তারই আয়োজনে ব্যস্ত, তাই বর্বরতার বাড়াবাড়ি থেকে মানুষকে রক্ষা করার ক্ষমতা তারই হাতে।
পৃথিবীর যে-দুঃখের কথা বলেছি তার কারণ অর্থনীতি, এ-বিষয়ে চিন্তাশীলরা একমত। কিন্তু অর্থনীতি বিজ্ঞানের এলাকার, সাহিত্যের নয়। তাই তা নিয়ে আলোচনা না করে বর্তমান অর্থনীতির পেছনে যে মনস্তত্ত্ব রয়েছে, অথবা তা থেকে যে মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়। কেননা, মনস্তত্ত্ব সাহিত্য ও বিজ্ঞান উভয়ের এলাকাভুক্ত।
একটুখানি তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, আমাদের ভেতরের মানুষটি কুঅভ্যাসবশত নিজেকে খুশি করার নামে অপরকে অসুখী করতে চায়। (আমরা অট্টালিকা নির্মাণ করি নিজেরা সুখে থাকার জন্য নয়, অপরকে ঈর্ষান্বিত তথা দুঃখিত করার জন্য)। সমকক্ষের কালো মুখেই আমাদের আনন্দ। এই বিকৃত দৃষ্টির ভদ্র নামই কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতা। প্রয়োজন না থাকলেও ছেনে-ছুনে কেড়ে-কুড়ে সিন্দুক ভর্তি করার এই কদর্য স্পৃহা–একে বর্বরতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। নির্বোধ অথবা নিষ্ঠুর বলে (এ দুটো অপবাদের একটি আমাদের গ্রহণ করতেই হবে) আমরা বুঝতেই পারি না যে, সিন্দুকে কেবল অর্থকেই বন্দি করে রাখা হয় না, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরমায়ুকেও বন্দি করে রাখা হয়। তাই পৃথিবী মরণে-মরণে ও অস্বাস্থ্যে-অস্বাস্থ্যে ছেয়ে যায়।
এই দুর্ভোগ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজনীয়। পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা প্রতিযোগিতা তথা অপরকে পরাজিত ও দুঃখিত করা, নব দৃষ্টিভঙ্গির গোড়ার কথা নিজেকে খুশি করা। আর পরস্পরের স্বাস্থ্য ও সখ্য পানই নিজেকে খুশি করার উপায়। এ-যুগ তাই সখ্যরস আস্বাদনের জন্য এত ব্যাকুল।
দুস্থ পৃথিবীকে সুস্থ করাই এখন বড় কথা। বুদ্ধি-মুক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে রিনেসাঁস এ-ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করতে পারে। মুমূর্ষ পৃথিবী শুশ্রূষা চাচ্ছে, দানবের অত্যাচারমুক্ত হতে চাচ্ছে। এ-যুগের দুঃখ-ব্যথা, কলঙ্ক কুশ্রীতা চপেটাঘাত করে কবি-শিল্পীদের আত্ম-রতিবিরত করছে। তাই রবীন্দ্রনাথের মতো সৌন্দর্যধ্যানী-কণ্ঠে দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আকুল আহ্বান। শিল্পী ও কবি মন নিয়ে আজ পৃথিবীকে ঢেলে সাজানো দরকার। পৃথিবী আমাদের সমগ্র প্রতিভা চাচ্ছে–আমাদের কবিতার খাতা হতে চাচ্ছে–বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনা সমস্ত তার জন্য উজাড় করে দিতে হবে।