এইসব কারণে হিন্দুর উত্তরাধিকার অনেকটা মুসলমানেরও উত্তরাধিকার। অসূয়াপরবশ হয়ে মুসলমান জোর করে তা অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু তা হলেই তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আজো বাঙালি মুসলমান খাঁটি মুসলমান হয়নি। এ দুঃখের ভেতরেই আমার কথার সত্যতা জাজ্বল্যমান।
নজরুল ইসলামের হিন্দুয়ানি রচনা লিখবার কারণ এইখানে। এ তার উত্তরাধিকার প্রমাণিত করে, ব্যভিচার নয়। রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ না করে আরবদেশে জন্মগ্রহণ করতেন ও আরবি ভাষায় কাব্য রচনা করতেন তো আরবদেশের ‘রেস-কালচারের প্রভাব এড়িয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব হত। মুসলমান না হলেও মুসলমানির প্রভাবযুক্ত তিনি হতেনই, এ এতই সহজ ও স্বাভাবিক যে, এ নিয়ে তর্ক চলে না, যেমন তর্ক চলে না নিশ্বাস-প্রশ্বাসের অস্তিত্ব নিয়ে।
নজরুল ইসলাম রিনেসাঁসের প্রেরণা : বুদ্ধি ও হৃদয়ের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাঁর রচনার মারফতে তা আমাদের জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু শুধু ইসলামি রচনার জন্য তাঁকে ‘রেনেসা শুরু মনে করা ছেলেমি ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এরূপ বলেন, তাঁরা রিনেসাঁস কথাটির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেননি। রিভাই-ভালইজমকে তাঁরা রিনেসাঁস বলতে চান। (রিভাইভালইজম ও রিনেসাঁসের পার্থক্য কী, এ প্রশ্ন অনেকে করেন। উত্তরে বলতে পারা যায় : রিনেসাস মূল্যবোধ, রিভাইভালইজম অহমিকা-বোধ, রিনেসাঁসের জন্য বিশেষ জাতি তার নিজের সৌন্দর্যের দিকেও তাকাতে পারে, সেটা অন্যায় নয়। কিন্তু শুধু সেদিকেই তাকানোর প্রবৃত্তি অন্যায়। কেননা, সেটা সৌন্দর্যপ্রেরিত নয়, অহঙ্কারপ্রেরিত। আর অহঙ্কার যে বহুল, সে জানা কথা।)
প্রাণের অন্ধ আবেগে নজরুল যা করতে চেয়েছিলেন মুসলমান সাহিত্য-সমাজ (ঢাকা) তারই জাগ্রত প্রচেষ্টা। বুদ্ধির মুক্তি ছিল এর লক্ষ্য। সচেতনভাবে দলবদ্ধ হয়ে সমাজের কর্মকর্তারা বুদ্ধির মুক্তির যে-আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন, তা সত্যই অপূর্ব–শুধু মুসলমান সমাজের নয়, বাংলার সংস্কৃতি-আন্দোলনে এর এক বড় স্থান। মানুষের জীবন ছিল এর সামনে; জীবনের বহুভঙ্গিম বিকাশকে সম্ভব করে তোলাই ছিল এর স্বপ্ন। রিনেসাঁসে বড় হয়ে উঠেছিল যে জীবন–পরকালমুখী ধর্মসাধনা নয়, ইহকালমুখী জীবন সাধনা, মানে জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রয়াস, সাহিত্য সমাজেরও লক্ষ্য ছিল তাই। জীবন সুন্দর হোক, ঐশ্বর্যময় হোক, তার বিকাশের অন্তরায় দূরীভূত হোক, এ-ই ছিল তার অন্তর্নিহিত কামনা। জ্ঞান, প্রেম ও বুদ্ধির সন্নিপাতে জীবনের যে ঐশ্বর্যময় জয়যাত্রা, তার স্বপ্নে সমাজের নেতৃস্থানীয়দের চিত্ত আন্দোলিত হয়েছিল। সেজন্য কোনো ইজমের তাবিজে বিশ্বাসী না হয়ে গভীর জীবনানুভূতির আশ্রয় গ্রহণই এঁরা কল্যাণপ্রদ মনে করেছিলেন।
ধর্ম উপেক্ষা করা নয়, বুঝা ও উপলব্ধি করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। ধর্ম-যে মানবকল্যাণের এক অনুপম নিদান, প্রেমে-পুণ্যে জীবনকে ধন্য করার উপায়, অন্ধ অনুসরণের ব্যাপার নয়–এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন সমাজের কর্মকর্তারা। অথচ সেজন্য তাদের নিন্দিত ও নিপীড়িত হতে হয়েছিল; সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার সাক্ষী হয়ে তা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছে। এই বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে তারা মানব-মহিমারই জয় ঘোষণা করলেন।
এটি রিনেসাঁসেরই লক্ষণ। রিনেসাঁসের অপর লক্ষণ-যে মিলনপ্রয়াস, ঐতিহ্যে ঐতিহ্যে মিলন সাধনের শুভচেষ্টা, সেও এই আন্দোলনের বিষয়বস্তু। ছুম্মাগী বৈশিষ্ট্যের বাণী প্রচার না করে তা মিলনের বাণীই প্রচার করেছিল। বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনার দ্বার খুলে দিয়ে দেশকে প্রেমের ও কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল এর লক্ষ্য।
(সাহিত্য-সমাজ সম্বন্ধে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। এই প্রবন্ধে সকল কথার ঠাই হতে পারে না। তাই সংক্ষেপে সেরে নিলাম)।
এর আরব্ধ কাজ শেষ হতে পারেনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আবির্ভাবে। তা না হলে এ বাঙালির জীবনে সোনা ফলাতে পারত। মুসলিম-সমাজে যদি কখনো সত্যিকারের রিনেসাঁসের আবির্ভাব হয়, তবে উপলব্ধ হবে যে তার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। পঞ্চদশ শতাব্দীর রিনেসাঁস সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে : The Renaissance of the fifteenth century was in many things, great rather by what it designed than by what is achieved, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ সম্বন্ধেও তা বলা যেতে পারে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যা আকাঙ্ক্ষা করা হয়েছিল, অষ্টাদশ শতকে তা পূর্ণ হয়েছিল। বাংলার মুসলমান-সমাজে সেই ‘অষ্টাদশ শতাব্দী’ এখনো দূরে, কেননা পথে বহু অন্তরায়। দ্বন্দ্বের যুগ রিনেসাঁসের যুগ নয়, কারণ তাতে বুদ্ধির অপ্রমত্ততা রক্ষা করা কঠিন। বিদ্বেষাশ্ৰিত মন নিয়ে মানুষ কখনো সভ্যাভিসারী হতে পারে না। সত্যানুসরণ নয়, কেবলি শত্রুপক্ষের চালচলনের দ্বারা তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। এইজন্য উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলনের যুগ রিনেসাঁসের যুগ হতে পারে না। অসহিষ্ণুতার মন্ত্রে দীক্ষিত বলে অনেক সময় তা মনের উপর জবরদস্তি করে থাকে। আর রিনেসাঁস আর যাই হোক, জবরদস্তি বা অসহিষ্ণুতা নয়।* [ * *রিনেসাঁস বহুভঙ্গিম জীবন–একটি আদর্শের পিজরায় পুরে তোতাপাখিপনা শেখানো নয়। বিচিত্র জীবনের ডাকে মানুষ বিচিত্র পথের পথিক হয়; তাই সহজ সরল পন্থা জাতিগত বা সম্প্রদায়গত না হয়ে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। মুক্তি আসে নানান মূর্তি ধরে একজনের পক্ষে যা মুক্তির সরল পথ অপরের কাছে তা সরল নাও মনে হতে পারে। প্রবণতার বিভিন্নতাই এর হেতু। একই ব্যাপারে সকলের মনে সাড়া জাগবে, এমন আশা করা ভুল। ইরানের নার্গিসনয়না সাকির বিরহে কেউ দেওয়ানা হতে পারে, আবার কারো পক্ষে কালিদাসের নিপুণিকা চতুরিকার শোকে ম্রিয়মাণ হওয়া স্বাভাবিক। এই-যে বিভিন্ন রুচি, একে শুধু রক্ষা করা নয়, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা এবং এদের পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য-বিধান করে। ঐক্য স্থাপন করা–এ-ই রিনেসাঁসের মূল প্রবৃত্তি, এর ব্যতিক্রম আর যা-ই হোক, রিনেসাঁস নয়।] অনেক সময় শত্রুর দুর্বলতা তার কাছে মনোহর মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়, আর অসহায়ের মতো সে তার অনুসরণ না করে পারে না। আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে তার প্রমাণ প্রচুর।