হিন্দু ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখবার এই-যে প্রয়াস, এর জন্য রিনেসাঁসকামী কোনো কোনো লেখক দুঃখ ও লজ্জাবোধ করেন। তাঁদের কথা : রবীন্দ্রনাথ মুসলমানী ব্যাপার নিয়ে কোনো কবিতা লিখলেন না, অথচ নজরুল ইসলাম কিনা বেহায়ার মতো (কথাটা অবশ্য তারা ব্যবহার করেন না, কিন্তু মনের কোণে ওরকম একটা কথা থেকে যায়। বহু হিন্দুয়ানি রচনা লিখলেন। এতে তাঁদের জাতীয়-সম্মানবোধ ক্ষুণ্ণ হয়, তাদের মাথা নুয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, তারা যে মনোভাবের দ্বারা পীড়িত, সে হচ্ছে প্রেসটিজ-বোধ, আর এ প্রেসটিজ-বোধ থেকে-যে জগতে কত অনাচার হয়েছে ও হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রসঙ্গত আজকাল লোকেরা প্রেসটিজের যতটা পূজা করে, ডিগনিটির ততটা পূজা করে না। তারই ফলে জগৎ অত্যাচার-অবিচার ও কলঙ্ক-কুশ্রীতায় পরিপূর্ণ। সত্য কি মিথ্যা, এ প্রশ্ন আজ বড় নয়, সম্মান রক্ষা হবে কি হবে না এ-প্রশ্নই বড়। এরই ফলে কয়েকটি বিভ্রান্তিকর শব্দের সৃষ্টি : ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স, সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইত্যাদি। বুলির মতো এরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু মনের ব্যাপার বলে এদের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া কঠিন। মুশকিল এই যে, যাকে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স বলা হয় তার নিচে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স লুকিয়ে থাকে, আর প্রেম আর সত্যানুসরণকে যে অনেক সময় ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বলে গাল দেওয়া হয়, এ তো প্রায় সব সময়েই দেখতে পাওয়া যায়। অতএব ইনফিরিওরিটি সুপিরিওরিটি প্রভৃতি কমপ্লেক্সের আবর্তে পড়ে সত্য-মিথ্যার প্রশ্নকেই বড় করে তোলা দরকার। কেননা, তা-ই আমাদের জীবনকে সারল্য তথা শক্তিমণ্ডিত করতে সক্ষম।
নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই। প্রাণের যোগ নেই বলে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি একপ্রকার জলবায়ুর মতো সহজ। তা বোঝা কঠিন নয়, তাকে জানতে হয় না, সে নিজেই নিজেকে জানিয়ে যায়, আর আমরা জেনেও টের পাইনে যে জেনেছি। এই দিনের আলোর মতোই সহজ সত্যকে যারা অস্বীকার করেন, মাটির বাঁধনকে স্বীকার করতে চান না, শুকিয়ে মরা তাদের ভাগ্যলিপি। (ইউরোপীয় রিনেসাঁসকে এক হিসেবে মাতৃভূমির সাধনার সঙ্গে পিতৃভূমির সাধনার সংমিশ্রণ-প্রয়াস বলা যেতে পারে।) হিন্দু ঐতিহ্য, মুসলিম ঐতিহ্য এ-দুয়ের সংমিশ্রণের দায়িত্ব মুসলমানেরই, হিন্দুর নয়–কেননা, হিন্দুর দুই উত্তরাধিকার নয়। অথচ সে-মিলনের জন্য বারবার হিন্দুর দিকেই তাকানো হয়েছে; বলা হয়েছে হিন্দু বড়ভাই ও মুসলমান ছোটভাই, সম্প্রীতির কথাটি বড়ভাইয়ের তরফ থেকেই আসা উচিত। কিন্তু প্রশ্নটি আসলে সম্প্রীতির নয়, উত্তরাধিকারের; আর উত্তরাধিকারের ব্যাপকতায় মুসলমান হিন্দুর চেয়ে বড় মাতৃ-সম্পত্তি ও পিতৃ-সম্পত্তি উভয়েরই সে ওয়ারিশ। মুসলমান যদি এই দুই উত্তরাধিকার স্বীকার করে, তবে তার দ্বারা এক বড় সৃষ্টি সম্ভব–আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মন্থনদণ্ডে মন্থিত করে সে দুই সংস্কৃতিকে এক বিরাট নব-সংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারে। এ গৌরব মুসলমানের জন্যই অপেক্ষা করছে, তবে সে তা চায় কি না, সেটাই প্রশ্ন। প্রতিভার স্বাদ পেতে হলে এই মিলন-সাধনা তথা জীবন-সাধনার সাধক হওয়া দরকার। বিরোধ অত্যন্ত সোজা, মিলন কঠিন, কঠিনের সাধনাই প্রতিভা-বিকাশের একমাত্র পথ, তা ভেতরের সুপ্তশক্তিকে জাগিয়ে তোলে, নিদ্রার অবকাশ দেয় না। (বিরোধ বলতে আমি অপর সম্প্রদায় বা অপর জাতির সঙ্গে বিরোধ বুঝেছি, নিজের সম্প্রদায় বা নিজের সঙ্গে নয়। নিজের জাতির সঙ্গে বিরোধ অত্যন্ত কঠিন, মহাপুরুষের জীবনেই তা দৃষ্ট হয়।)
হিন্দুর উত্তরাধিকার যে অনেকখানি মুসলমানের উত্তরাধিকার তার প্রমাণ, হিন্দুর অনেক কিছুই আমরা জানি, বুঝি ও উপভোগ করি এবং এইজন্য দুঃখও প্রকাশ করি। এই জানার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
১. সব মুসলমান আরব কি ইরান তুরান হতে আসে নি। অন্তত শতকরা পঞ্চাশজন হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে।
২. বিদেশাগত বাকি পঞ্চাশজনের প্রত্যেকে যে স্বদেশ থেকে পত্নী নিয়ে এসেছিলেন এমন মনে করা বাতুলতা। অন্তত বিশজন দেশী পত্নী গ্রহণ করেছিলেন।
৩. হিন্দুধর্ম উৎসবময়, আর উত্সব-ছোঁয়াচে। হিন্দুর নানা উৎসবের সংস্পর্শে এসে, বিশেষ করে যাত্রা-পাঁচালি, কবিগান ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে মুসলমান বেমালুম হিন্দুধর্মের অনেক কিছু জেনেছে ও পেয়েছে।
৪. কালচারের ব্যাপার হয়ে হিন্দুধর্ম সাধারণতা লাভ করেছে, আর তারই ফলে তা মুসলমানের মনে প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছে। সাহিত্য তথা আনন্দের বস্তু হয়ে (কাব্য কাহিনীময় বলে) তা আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত করেছে, আর আমরা বেদরদীর মতো দ্বার রুদ্ধ করে থাকতে পারিনি। (মুসলমান ধর্মও সাহিত্য তথা আনন্দের ব্যাপার হয়ে হিন্দুর অবচেতনে স্থান নিতে পারত, কিন্তু সে প্রচেষ্টা আজো বিশেষ হয়নি। আরবি ও ফরাসি ভাষার সিন্দুক হতে মাতৃভাষার সূর্যালোকে ইসলামকে মুক্তি না দিলে তা সম্ভব হবে না। সেজন্য ইসলাম-প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশ-প্রীতিও প্রয়োজনীয়। কেননা, রোগী-প্রীতি ব্যতীত চিকিৎসকের সার্থকতা অসম্ভব। কিন্তু যেরূপ আরবি-পারসি মিশ্রিত রচনার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তাতে সে ভরসাও হয় না। মনে হয়, রচনাগুলি কেবলি আরবি-পারসি জানা মুসলমান পাঠকের জন্য লেখা হচ্ছে, সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য নয়)।