রিনেসাঁসের দুটি দিক বুদ্ধি ও হৃদয়। এ-যুগে বুদ্ধির সাধনা বিশেষ হয় নি, কিন্তু প্রেমের সাধনা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকে বহু কবি আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা করেছেন। আউল-বাউলের রচনায় বিবাগী মনের যে-বেদনা তা সত্যই মহান, আর আজো তা বহু ভাবুকের অশ্রু-নিঝর। ধর্মের সম্পর্ক বর্জিত নিছক মানবীয় প্রেম-কাহিনী রচনার পথপ্রদর্শকও মুসলমান। দৌলত কাজি, আলাওলের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এঁদের রচনা থেকেই ‘টেল ফর টেলস্ সেকে’র শুরু। মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যে যে মানবমহিমা গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল নিচের দুটি পদে তার পরিচয় পাওয়া যায় :
মোর পরে পয়গম্বর না জন্মিবে আর
মোর পরে হইবেক কবি ঋষিগণ।
প্রভুর গোপন রত্নে বান্ধিবেক মন।
শাস্ত্রসব ত্যাগ করি ভাবে ডুম্ব দি-আ।
প্রভু প্রেমে প্রেম করি রহিবে জড়ি-আ
আমার হৃদয় কমল চলতেছে ফুটে যুগ যুগ ধরি,
তাত্র তুমিও বাঁধা আমিও বাঁধা, উপায় কী করি?
ফোটে ফোটে ফোটে কমল ফোঁটার না হয় শেষ;
এই কমলের যে-এক মধু, রস যে তার বিশেষ।
ছেড়ে যেতে লোভী ভ্রমর, পায়রা না যে তাই।
তাই তুমিও বাঁধা আমিও বাধা, মুক্তি কোথাও নাই।
মিলন-স্পৃহার তাগিদে ঐতিহে ঐতিহ্যে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টাও এ-যুগে কম হয় নি। প্রেমের জাদুতে পরকে আপন করবার জন্য এ-যুগ ব্যাকুল।
পুবেতে বন্দনা করি পুবে ভানুশ্বর
একদিকে উদয় ভানু, চৌদিকে পশরা।
দক্ষিণে বন্দনা করি ক্ষীরনদী-সাগর।
যেখানে বাণিজ্য করে চাঁদ সদাগর।
উত্তরে বন্দনা করি কৈলাস পর্বত
যেখানে পড়ি আছে আলীর মালামের পাথর
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা হেন স্থান।
উদ্দেশে বাড়ায় সালাম মোমিন মুসলমান।
সভা করি বসছ ভাইরে হিন্দু-মুসলমান;
সভার চরণে আমি জানাই সালাম।
একই সভায় হিন্দু মুসলমান আসীন। অতএব কেবল মুসলমানের কথা বললে চলে না, হিন্দুর কথাও বলতে হয়; নইলে হিন্দু-মুসলমান উভয়কে সালাম জানানো অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কবি তাই আগে থাকতে বিশ্বাস সৃষ্টি করে পরে সালাম জানিয়েছেন।
কিন্তু এই প্রেম, চিন্তার এই স্বাধীনতা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি, পরাজয়ের বিষাদের ছায়ায় মুসলমান যে শোচনীয় অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করলে, তাতে মানব মহিমা ব্যাহত হল। কল্পনা ও প্রেমকে বর্জন করে শুধু শাস্ত্রকেই জীবনের একমাত্র নিয়ামক বলে গ্রহণ করা হল বলে আনন্দ বিদায় নিলে, রুক্ষতা প্রবলপ্রতাপান্বিত হয়ে জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করলে। (আজো তার প্রতাপ কমেনি, ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্য থেকে গেছে, কিন্তু বুদ্ধি ও কল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই সমান চলেছে।) স্বাতন্ত্রের অবতাররা বৈশিষ্ট্যের তুঙ্গ প্রাচীর তুলে আলাদা হয়ে বাস করাই জীবনের চরিতার্থতা মনে করলেন, আর তারই ফলে মানসিক ছুৎমার্গ মুসলমান সমাজে শিকড় গেড়ে বসল।
ওহাবী মনোভাবের কথা বলছি। এ কেবল গোসা করতে, কেবলি আলাদা হতে শিখেছে, প্রেমের অপরিমেয়তায় জীবনের ঐশ্বর্য উপলব্ধি করতে শেখেনি। অবশ্য এ মুসলমানকে যোচূবেশ দিয়েছে; বীরত্ব-প্রেমিকরা এইজন্য তার প্রতি বিস্মিত-দৃষ্টি। কিন্তু এই যোদ্ধৃবেশের পেছনের কোনো বড় লক্ষ্য নেই বলে মোটের ওপর তা অসার্থক। স্বাধীন দেশে মুসলমানের ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীর মুখে হাসি ফুটুক (প্রতিবেশীর মুখে হাসি না ফুটলে মুসলমানের মুখে হাসি ফুটতে পারে না, কেননা ভাগ্যের একই তরীতে তারা ভাসমান), মুসলমানের জীবন সার্থক হোক, ফুলে ফুলে সুশোভিত হোক–এই আদর্শে প্রণোদিত হয়ে তার যুদ্ধোদ্যম নয়, ইসলামকে অবিকৃত অপরিবর্তিত রাখতে হলে স্বাধীনতার প্রয়োজন, এই চিন্তাই তার প্রেরণাকেন্দ্র। সুতরাং তা থেকে কোনো বড়কিছু আশা করা অন্যায়। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্মচিন্তা-জগতের এই প্রাথমিক সাধারণ সত্যই মর্মগত হয়নি বলে তা ব্যর্থতারই আরাধনা করেছে।
তারপরে ইংরেজিশিক্ষার যুগ। কিন্তু সানন্দচিত্তে গৃহীত হয়নি বলে সংস্কৃতিজগতে তাও বন্ধ্যা প্রমাণিত হল। নব-শিক্ষা মানে নব-বিশ্বাস। মুসলমান নব-শিক্ষাকে গ্রহণ করলে সন্দিগ্ধচিত্তে–কেবলই টিকে থাকবার জন্যে। সুতরাং কতিপয় চাকুরে সৃষ্টি ছাড়া তা আর কিছুই করতে পারলে না। বুদ্ধি-অনুভূতি-কল্পনা, সাহিত্য-শিল্প-আনন্দ তখনো মুসলমানের মর্মগত হয়নি। সে কেবলই বৃদ্ধের মতো লাঠিতে ভর দিয়ে জীবনের ভার বয়ে চলেছে। সংস্কৃতির এই শীতের দেশে হঠাৎ এলেন নজরুল ইসলাম। বসন্তের মত্ততার মতো তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রিনেসাঁসের আবির্ভাব হল–বুদ্ধি অনুভূতি ও কল্পনার দ্বার খুলে গিয়ে মানব-মহিমা উপলব্ধ হল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ মানব-মহিমারই কাব্য। বন্ধন-জর্জর মানবাত্মার যন্ত্রণা এখানে বিদ্রোহের বেশে আত্মপ্রকাশ করেছে। জরাজীর্ণ দৈন্য দুর্দশাময় পুরোনো পৃথিবী ভেঙে নতুন পৃথিবী গড়ার প্রয়াস-যে মানব-মহিমার চূড়ান্ত, তা সহজেই স্বীকার্য। বাঁচবার স্বাদ আমরা প্রথমে নজরুলের কাব্য থেকেই লাভ করি, জীবনের নিয়ামক যে জীবন নিজেই, আর কিছু নয়, শাস্ত্র-সংহিতা সেখানে শুধু মন্ত্রণা দিতে আসতে পারে, এ-বোধ সর্বপ্রথমে নজরুলের কাব্য থেকেই আমরা পাই। উপদেশ নিয়ে নয়, উচ্ছল সজীব জীবনের প্রতীক হয়ে তিনি তা প্রমাণিত করলেন। জীবনের আগ্রহে জীবনের প্রতিকূল আইনকে আমল দিতে তিনি চাননি–তাকে বন্ধনের রজ্জ্ব বলেই মনে করতেন। যে প্রচলিত নীতিবিরোধিতা (অ্যান্টিনোমিয়ানিজম) রিনেসাঁসের একটি বড় নিদর্শন, নজরুলের জীবনে ও কাব্যে তা সুপ্রচুর। আবেলার্ড, পিকো প্রভৃতি যে-বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে আত্মার ঐশ্বর্য প্রকাশ করেছিলেন নজরুল ইসলামেও তা বর্তমান। ঐতিহ্যে ঐতিহ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস নজরুলের কাব্যে সুস্পষ্ট। হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে তিনি ভিন্ন ভিন্ন কবিতা তো রচনা করেছেনই, ভাবসৌকর্যের জন্য একই রচনায় হিন্দু-প্রতীক ও মুসলমান মহাপুরুষের নাম গ্রহণ করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। এটা চিত্তের বীর্যশালিতারই পরিচায়ক।