ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য এ-যুগের ছিল না, আর সেজন্য তাকে দোষও দেওয়া যায় না, কেননা তা নিতান্ত হালের জিনিস। তবু একটা মিলনাত্মক প্রেরণায় মুসার সঙ্গে হোমার ও প্লেটোর ঐক্য-সাধনের জন্য যুগের আত্মা ব্যাকূল। ঐক্যসাধনের উদ্দেশ্যে নানা ব্যাপারে গোজামিল দিতেও তা কুণ্ঠাবোধ করেনি। এ-যুগের আত্মার বাণী যেন, ‘মিলনধর্মী মানুষ মিলিবে, ভয় নাই, ভয় নাই। মিরাণডোলার পিকো এই মিল-প্রচেষ্টার জীবন্ত প্রতীক। তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল ‘To bind the ages each by natural piety. আপাতবিরোধ সত্ত্বেও গ্রিকধর্মের সঙ্গে যে খ্রিস্টানধর্মের মিল রয়েছে, উভয়ই রহস্যাভিসারী মানবমনের সৃষ্টি পিকোর চিন্তার গোড়ার কথা তা-ই, খ্রিস্টাননাপযোগী আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তার কম ছিল না, তথাপি প্রাচীন দেবতাদের ভোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মানবমনের আলোক-পিপাসা থেকে সৃষ্ট বলে তারা তার কাছে আলোকেরই দূত। গ্রিকদেবতাদের পেছনে যে-কল্পনার সত্য রয়েছে, তা তিনি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন।
পিকোর রচনার উদ্দেশ্য, মানবপ্রকৃতির মহিমা ও মানুষের সৌন্দর্য প্রচার। মধ্যযুগে মানব-প্রকৃতির প্রতি যে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, পিকোর রচনা যেন তারই যোগ্য প্রতিবাদ। তারই ফলে রিনেসাঁসের যুগে দেহ, বুদ্ধি ও কল্পনার সহজ-স্বীকৃতি। প্রাচীন গ্রিসে এই স্বীকৃতির জ্বলন্ত স্বাক্ষর রয়েছে বলে তিনি তার প্রতি একান্ত আকৃষ্ট। মিলনের দূত তিনি, তাই প্রাচীন গ্রিস ও খ্রিস্টানজগতের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখাবার জন্য ‘হেপ্টেপ্লাস’ বা ‘ডিসকোর্স অন দি সেভেন ডেজ অব ক্রিয়েশন রচনা করলেন। প্লেটোর ‘টিমিয়াসের সঙ্গে মুসার ‘জেনেসিসের যে সাদৃশ্য রয়েছে, এ পুস্তকে তাই দেখাবার চেষ্টা হয়েছে। এরূপ প্রয়াসের ফলে রিনেসাঁসের যুগে দুই ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এক ঐশ্বর্যময় নব পুরাণের সৃষ্টি। জেরুজালেম ও পিসার মাটির সংমিশ্রণে যেমন এক নব পুষ্পের সূচনা হয়েছিল, গ্রিস ও খ্রিস্টান পুরাণের সংমিশ্রণেও তেমনি এক নব-পুরাণের সৃষ্টি হল। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকের শিল্পে বিপরীতের যে-সুন্দর সংমিশ্রণ, পিকোর জীবন তারই বাস্তব প্রতিলিপি, আর এখানেই তার জীবনের মূল্য। জ্ঞানের জন্যই তিনি জ্ঞান খোঁজেননি, বরং জ্ঞানে জ্ঞানে মিল রয়েছে, নির্বুদ্ধিতার ফলে মানুষ তা ভুলে গেছে, এই সত্য প্রমাণিত করবার জন্যই তার জ্ঞানান্বেষণ। পিকো সত্যকারের হিউমানিস্ট বা মান্বতাবাদী, কেননা…”The essence of humanism is that belief of which he seems never to have doubted, that nothing which has ever interested living men and women can wholly lose its vitality–no language they have spoken, nor oracle beside which they have hushed their voices, no dream which has once been entertained by actual human minds, nothing about which they have ever been passionate, or expended time and zeal.”
রিনেসাঁসের মর্মকথা এই মানবতা। শুধু পিকো নয়, পঞ্চদশ শতকের অপরাপর জ্ঞানীগুণীর ভেতরেও তা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিসি প্রমুখের রচনায় হিউম্যানিজমের প্রেরণা সুস্পষ্ট। উইকেলম্যান্ অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান সন্তান, তিনিও পুরোদস্তুর হিউম্যানিস্ট। গ্যেটে তার এই গুরু সম্বন্ধে বলেছেন যে, তিনি পুরোপুরি প্যাগান ছিলেন, আর খ্রিস্টানজগৎ সংক্রান্ত ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। ঈশ্বরের আদেশ নয়–মানবমন, মানুষের কল্পনা ও অনুভূতি, মানবদেহ গ্রিক সংস্কৃতির গোড়ার কথা বলে তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং আজীবন তার চর্চায় রত থাকেন। তাই পরবর্তীকালের লোক হলেও এই শিল্প-জহুরীকে রির্সোসের শেষ ফল বলে গণ্য করা যায়।
আমাদের দেশের প্রতি এখন তাকানো যাক। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রিনেসাঁসের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। এ-যুগ মুসলমানের সমৃদ্ধির যুগ (এখানে মুসলমানের সম্বন্ধেই শুধু বলা হচ্ছে), তাই তাদের সীমাহীন কৌতূহল। জোয়ারের নদীর মতো এখন তারা কেবলই মানুষকে আপন করতে চাচ্ছে। (ভাটার নদীর ভিন্ন ধারা, সে কেবলই ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না বলে সঙ্কুচিত হয়ে সরে যায়।) হিন্দুর রামায়ণ-মহাভারত মুসলিম নওয়াব ওমরাহদের মনে যে সহানুভূতি সৃষ্টি করেছিল তার কাছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য অনেকখানি ঋণী। স্রষ্টার গৌরবের অধিকারী না হলেও, পালকের মর্যাদা তাদের দেওয়া যায়। রিনেসাঁসের জন্য যে উদারতা বর্তমান, এ তারই নিদর্শন। গোরক্ষ বিজয়’ রচয়িতা ফয়জুল্লার অন্তরে যে-ভিন্নধর্মী গোরক্ষণাথের মাহাত্ম্য সাড়া জাগিয়েছিল, মানব-মহিমার অন্তর্গত বলে তা রিনেসাঁসের পর্যায়ভুক্ত। অহঙ্কার-পীড়িত মানবমন (সে অহঙ্কার ব্যক্তিগতই থোক, আর জাতিগতই হোক) অপরের মাহাত্ম্য ও কীর্তি উপলব্ধি করতে অক্ষম। ফয়জুল্লা যে পেরেছিলেন এতেই বুঝতে পারা যায়, প্রেমের প্রসাদে অহমিকামুক্তি তিনি লাভ করেছিলেন। শুধু ফয়জুল্লা নয়, অন্যান্য কবি ও গীতিকারের রচনায়ও এর নিদর্শন প্রচুর। হিন্দু দেব-দেবী, রাধাকৃষ্ণ, কামরতি প্রভৃতির নাম তো সকলের কাব্যেই বর্তমান। কবি বলে কল্পনার বস্তুর মর্যাদা দিতে তারা শিখেছিলেন। ছুত্যাগী তারা ছিলেন না–বৈশিষ্ট্যের তুষার প্রাচীর তাঁদের প্রেমের উত্তাপে গলে যাচ্ছিল।