পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রিনেসাঁসের সূত্রপাত ধরা হয়, আর ইটালিকে তার জন্মভূমি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তার পূর্বেও রিনেসাঁসের খোঁজ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ও ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকের ফরাসি দেশেও রিনেসাঁসের মতো একটা কিছু ছিল।*[ * শুধু মধ্যযুগীয় ফরাসি দেশেই যে রিনেসাঁসের পূর্বাভাস দৃষ্ট হয় তা নয়, ইংলন্ড ও ইটালিতেও তার পরিচয় মেলে। প্রতি দেশেই যেন কয়েকটি কোকিল বসন্তের অগ্রদূতের মতো শীতের মরসুমেই গেয়ে উঠতে চেয়েছিল, দু-একটি ফুল আগেভাগেই ফুটে উঠে অনাগত বসন্তকে অভিনন্দিত করতে চেয়েছিল। (এরা যেন সেই অগ্রদূত যাদের লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ওরে তোদের ত্বর সহে না আর ওরে চাপা ওরে উন্মত্ত বকুল।’) ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংলন্ডে রোজার বেকন আধুনিক বিজ্ঞানের সম্ভাবনায় উল্ল হয়ে ওঠেন, আর তারও আগে ইটালিতে ফ্লায়ার যোয়াচিম মানবাত্মার ভবিষ্যৎ বিজয়ের কথা প্রচার করতে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হন। তাঁর সেই বিখ্যাত মরমী উক্তি : The Gospel of the Father was past, the Gospel of the son was passing, the Gospel of the spirit was to be : 64 ago রিনেসাঁসেরই আবাহনী।] শাস্ত্র-শাসনমুক্ত, হৃদয় ও প্রেমের প্রাধান্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটা জীবন দর্শন এ-যুগের আঁধার-আকাশে রাত্রিশেষের শুকতারার মতো উজ্জ্বল। প্রভেন্স কবিতায় তার দৃষ্টান্ত মেলে।
পণ্ডিতপ্রবর আবেলার্ডের প্রেমকাহিনী আর আমিস ও আমিলের প্রাবাদিক বন্ধুতার গল্প হৃদয় ও বুদ্ধির মুক্তির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত; অকাসিন ও নিকোলেতের প্রেমকাহিনীও তাই। প্রথম দুটি বীর্যে আর তৃতীয়টি মাধুর্যে মণ্ডিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর আলোকপন্থীদের যে কঠোর বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে বীর্যবত্তার পরিচয় দিতে হয়েছিল মধ্যযুগের আবেলার্ডকে তার চেয়ে কম বিরোধিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। আলোকপন্থীদের আলোর পিপাসায় যে দুঃখের আবির্ভাব, আবেলার্ডের জীবন সেই দুঃখে জর্জরিত, তবু অপরাজিত মন নিয়ে ঝড়ঝাঁপটা-বিধ্বস্ত মহীরুহের মতো তিনি দণ্ডায়মান। প্রেম ও জ্ঞানের এমন সুন্দর সমন্বয় স্বল্পই দৃষ্ট হয়। জ্ঞানী তিনি, প্রেমের জন্য নির্যাতনকে পরম বরণীয় বলেই গ্রহণ করেছিলেন।
প্রচলিত নীতিবিরোধিতা মধ্যযুগীয় রিনেসাঁসের একটি বিশেষ লক্ষণ। হৃদয় ও বুদ্ধির মুক্তির তাগিদে ধর্ম ও নীতির বেড়া অতিক্রম আলোকপন্থীরা জীবনপ্রীতিরই নিদর্শন বলে গ্রহণ করলেন। মানা নয়–জানা, বোঝা ও জয় করাই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। ইন্দ্রিয়সুখ ও কল্পনাবিলাসের জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে তারা ধীরে ধীরে খ্রিস্টানধর্মের সীমানার বাইরে এসে দাঁড়ালেন, আর তাঁদের প্রেম যেন একটা অদ্ভুত পৌত্তলিকতা একটা ভিন্ন ধর্মের রূপ গ্রহণ করল। আবার ফিরে এলেন ভেনাস, ফিরে এল দেহকেন্দ্রিক পূজা। এই নীতিবিরোধিতা (অ্যান্টিনোমিয়ানিজম) সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অকাসিন ও নিকোলেতের গল্পে। অকাসিনকে যখন নরক-যন্ত্রণার ভয় দেখানো হয়েছিল, তখন তিনি যা বলেছিলেন তা সত্যই বুদ্ধি ও বীর্যে ভাস্বর। প্রেমপ্রবণ, সজাগ-ইন্দ্রিয় সেই যুবক স্বর্গের পথে একদল জরাজীর্ণ নিরানন্দ পুরোহিত ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পেয়ে পণ্ডিত, বিলাসী ও রসিকদের সঙ্গে নরকের পথানুসরণই বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। জীবনকে প্রচলিত নীতির ঊর্ধ্বে তুলে ধরার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল।
মানব-কল্পনা ও খ্রিস্টানধর্মের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা এ-যুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য; আর তা দেখতে পাওয়া যায় আমিস ও আমিলের গল্পে। খ্রিস্টান-সন্ন্যাসী রচিত এই গল্পে মর্ত-মানবের স্বর্গীয় বন্ধুতার এমন সুন্দর ছবি আঁকা হয়েছে যে, লোকেরা এই দুই বন্ধুকে শহীদরূপে গণ্য না করে পারেনি। মানবীয় কল্পনা এখানে পবিত্র ধর্মের শ্রদ্ধা লাভ করেছে। দুই বন্ধু খ্রিস্টান-জগতে সাধুকল্প পুরুষরূপে গৃহীত হয়েছিলেন। খ্রিস্টানধর্ম ও মানব-কল্পনার সুন্দর সমন্বয় সাধনই যেন এই গল্পের উদ্দেশ্য।
পঞ্চদশ শতাব্দীর ইটালীয় রিনেসাঁসেও সেই একই ব্যাপার। নানা আপাতবিরোধী ভাবকে একত্র করে সামঞ্জস্য-বিধানের দ্বারা একটি উদার বহুভঙ্গিম সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রয়াস এ-যুগের বিশেষ কীর্তি। পূর্বে গ্রিকদেবতাদের প্রতি তাকানো হত যে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে, গ্রিকসাহিত্য চর্চার ফলে তা ধীরে ধীরে তিরোহিত হল, এবং গ্রিকদেবতা তথা গ্রিকপুরাণ ধর্মের বিষয়বস্তুরূপে না হলেও শিল্প ও কাব্যের বিষয়বস্তুরূপে সমাদৃত হল। তবে শিল্পের প্রতি পঞ্চদশ শতকের শ্রদ্ধা এতবেশি ছিল যে শিল্পের বস্তুতে ধর্মের মর্যাদা দিতে এ-যুগ কুণ্ঠাবোধ করেনি। জ্ঞান ও রসিকগণ ধীরে ধীরে গ্রিক ও খ্রিস্টানধর্মের বিরোধিতা সম্বন্ধে সন্দিহান হতে থাকেন। পরিশেষে তা একেবারে তিরোহিত হল এবং দুই ধর্ম কালভেদে একই মানবমনের বিভিন্ন প্রকাশ রূপে গৃহীত হল।
আধুনিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ধর্মে ধর্মে এই পারস্পরিক সম্বন্ধ সহজেই স্বীকার করেন এবং ধর্ম ব্যাপারটা-যে অন্যান্য ব্যাপারের মতো ক্রমবিকাশের ফল এ-কথায় সায় না দিয়ে পারেন না। মানবমনের সৃজনশীলতাই ধর্মের গোড়ায়। অতএব এই রহস্যময় সত্তার ভিতরেই প্রাচীন ও নবীন ধর্মের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়–যেমন শৈশবের কল্পনা আর পরিণত বয়সের চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায় একই ব্যক্তির অভিজ্ঞতায়। (সাহিত্য-কাব্যকেও প্রাচীন ও নবীন দুই ভাগে ভাগ করে দেখা হয়, কিন্তু তাই বলে তারা সত্য-সত্যই আলাদা নয়–একই মনের সৃষ্টি বলে বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের ভেতর ঐক্য সুস্পষ্ট।) তাই উদার অ-ছুৎমার্গী রিনেসাঁসের কাজ হল খ্রিস্টানধর্ম ও গ্রিকধর্মের মধ্যে আত্মীয়তা সম্পর্ক খুঁজে বের করা–বিরোধমত্ত হয়ে এককে অপর থেকে দূরে ঠেলে ফেলা নয়। মধ্যযুগ অন্ধতার দরুন যে-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গিন উঁচিয়েছিল, এ-যুগে তার কোনো পাত্তাই পাওয়া যায় না, উদারতার আবহাওয়ার দরুন সকলে যেন ঘেঁষাঘেঁষি করে চলতে শিখেছে, আর তারই ফলে কৌণিকতা মসৃণতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই সহানুভূতি, মনুষ্যত্বে এই অপরিসীম শ্রদ্ধা, এ-ই রিনেসাঁসের গোড়ার কথা। ভেদনীতি নয়, মিলন-নীতির ওপরই এর প্রতিষ্ঠা। মানবমন এককালে যা আত্মপ্রকাশের উপায়রূপে গ্রহণ করেছিল, যা থেকে তা আনন্দ-বেদনার প্রেরণা পেয়েছিল, তা তুচ্ছ ও বাজে নয়, তার মধ্যেও খুশি হবার জিনিস রয়েছে, এই প্রত্যয়ে এ-যুগের আত্মা উজ্জ্বল। স্বাতন্ত্র ধ্বজা এ-যুগের আকাশে ওড়েনি; এ-যুগ বিলিয়ে দেওয়ার যুগ–সত্যের কাছে, সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যুগ। যা ভালো, তা গ্রহণ করো, আপন-পরের চিন্তায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ো না–এ-ই এ-যুগের মর্মবাণী।