মনে হয়, তাঁর জ্ঞান তাকে ঘাবড়ে দিয়েছিল। জ্ঞান, প্রেম, ভোগবিলাস সমস্ত কিছুই তার কাছে ফাঁকি, অন্তঃসারশূন্য বোধ হল বলে জীবন তার কাছে ঘৃণার বস্তু হয়ে দাঁড়াল। সুখের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দুঃখকেই মানব-ভাগ্য বলে মেনে নিলেন।
এখন এই-যে মনোভঙ্গি, এ সচেতন বুদ্ধিলোকের ব্যাপার নয়, অবচেতন ভাবলোকের ব্যাপার। অর্থাৎ এটি চিন্তার বিষয় নয়, ‘মুড’ বা মনোভাবের বস্তু। তাই এর পরিবর্তন ঘটতে পারে কেবল কোনো শুভ ঘটনার সংযোগে অথবা শরীরগত পরিবর্তনে তর্ক করে কখনো নয়। জীবন অনেকদিন আমার কাছেও ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়েছে। কিন্তু এই শোচনীয় অবস্থা থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি কোনো ফিলজফি পড়ে নয়–অনিবার্য কর্মপ্রেরণায়। আপনি যতই অবসাদ বোধ করেন না কেন, এমন সময় আসবেই যখন আপনি কাজ না করে থাকতে পারবেন না, আর কাজের সঙ্গে সঙ্গে আপনার অগোচরেই আপনার অবসন্নতা বাম্পের মতো মিলিয়ে যাবে। সূর্য যেমন মেঘের শত্রু, কাজও তেমনি অবসাদের দুশমন। আপনার ছেলে যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তো নিশ্চয়ই আপনি দুঃখবোধ করবেন, কিন্তু আপনার কাছে জগৎ অসার মনে হবে না। বরং জীবনের মূল্য আছে কি নেই, এ কথা না-ভেবেই আপনি আপনার ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চাইবেন। সত্যকার দুঃখীরা জীবনকে কোনোদিন কি মনে করে না। জীবনের প্রতি আকর্ষণ তাদের ষোলো আনা। জীবন ফাঁকি বলার প্রবণতা রয়েছে শুধু অবসরভোগী ধনী-সম্প্রদায়ের মধ্যে। কিন্তু ধনীলোকটি যদি ভাগ্যের চক্রান্তে সর্বস্ব খুইয়ে বসে তো পরের বেলার আহারটুকুকে সে আর ফাঁকি বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না। জীবনের চাহিদাগুলি সহজে মিটলেই এ-ধরনের রুগণ মনোভাবের জন্ম হয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জন্যও জীবনসংগ্রামের প্রয়োজন আছে। প্রচুর ধনাগমের ফলে মানুষ যখন সহজে, একরকম বিনা চেষ্টায়ই তার খেয়াল মেটাতে সক্ষম হয়, তখন সে আর জীবনের স্বাদ পায় না। চেষ্টার অভাবের দরুন সুখের উপাদানে ঘাটতি ঘটে। আকাঙ্ক্ষার পূর্তিতে সুখ নেই–এ উক্তি কেবল তারই হয়ে থাকে, কামনার বস্তুগুলি যে অত্যন্ত সহজে পায়। এই লোকটি যদি দার্শনিক গোছের হয় তো সহজে এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছে যে, যে ব্যক্তিটি অনায়াসেই তার শখ মেটাতে পারে সেই যখন সুখী নয়, তখন দুনিয়া স্বভাবতই দুঃখের। কোনো কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবই-যে সুখের হেতু, এ-কথাটা হতভাগ্য দার্শনিকটির মনে থাকে না।
এ গেল ‘মুড’ বা মনোভাবের ব্যাপার। যুক্তি-তর্কের ব্যাপারও ইকলেজিয়েটসে আছে। ইকলেজিয়েটস-কার জীবনের অসারতা সম্বন্ধে যেমতটি ব্যক্ত করেছেন, হালের দার্শনিকদের হাতে তা নিম্নরূপ অভিব্যক্তি পেত :
মানুষ অনবরত খেটে চলেছে, বস্তুও এক অবস্থায় স্থির হয়ে নেই। তথাপি এমন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না যা চিরত্ব দাবি করতে পারে। বড় রকমের কোনো পরিবর্তনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্বের ব্যাপারের সঙ্গে পরের ব্যাপারের পার্থক্য অল্পই। সেই থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়। মানুষ মরে যায়, ছেলে এসে তার পরিশ্রমের ফল ভোগ করে। আবার তার ছেলে তাকে অনুসরণ করে। নদী সমুদ্রের দিকে যায়, কিন্তু সেখানেও তার জল আটকে থাকে না–কেবলই সরে সরে যায়। বারবার উদ্দেশ্যবিহীন চক্রে মানুষ ও বস্তু ঘুরছে। অন্তহীন, পরিণতিহীন এই ঘূর্ণন। এতে কী লাভ? নদী যদি বুদ্ধিমান হত তো সে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকত চপলতা দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেত না। সোলেমান যদি বুদ্ধিমান হতেন তো ছেলের ভোগের জন্য গাছ লাগিয়ে যেতেন না। বুদ্ধিমান লোকের কাছে সব ফাঁকি সব মায়া। এই ফাঁকির ফাঁদে ধরা দেয় কেবল বোকারাই। অতএব, নিজের বুদ্ধির শ্রেষ্ঠতা যদি প্রতিপন্ন করতে চাও তো ওপথ মাড়িও না। অবজ্ঞা করো, পৃথিবীকে অবজ্ঞা করো-ফিরেও তার দিকে তাকিও না।
কিন্তু অন্যভাবে দেখতে গেলে পৃথিবী কত সুন্দর, কত বিচিত্র। কত নিত্যনতুন ব্যাপার ঘটছে এখানে। সূর্যের নিচে নতুন কিছু নেই, না? তাহলে এই-যে আকাশ ছোঁয়া ইমারত, উড়োজাহাজ, বেতারবার্তা–এসব কী? সোলেমান এসবের কী জানতেন? মনে করুন, শেবার রানী তার শাসনাধীন দেশসমূহ থেকে ফিরে এসে রেডিওর মারফত প্রজাদের কাছে বক্তৃতা দিচ্ছেন। সোলেমান তা শুনে কি খুশি হতেন না? না, তাও তার কাছে বৃক্ষ ও পুকুরের মতো একঘেয়ে মনে হত? তার কালে খবরের কাগজেরও চল ছিল না। কেউ যদি তাকে সংবাদপত্র থেকে তার হারেম ও ইমারতের প্রশংসা বাণী, অথবা তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষিকুলের নাজেহাল হওয়ার কথা পড়ে শোনাতেন, তাহলে কি তিনি জীবনের নতুনতর স্বাদ পেতেন না? না, তাও তার কাছে জলো, অর্থবিহীন মনে হত? অবশ্য নৈরাশ্যবাদ দূর করবার জন্য এগুলিই যথেষ্ট নয়, এদের বর্তমানেও তা থেকে যেতে পারে। আর প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। ইকলেজিয়েটস্ রচয়িতা মুখ কালো করেছিলেন নতুনত্বের অভাব দেখে, ক্রুচ করেছেন নতুনত্বের প্রাচুর্যের দরুন। দুই বিপরীত কারণ একই ব্যাপারের জন্ম দিতে পারে না। সুতরাং বুঝতে পারা যায়, কারণ হিসাবে তারা তেমন জোরালো নয়। নদী পড়ে গিয়ে সমুদ্রে, তথাপি সমুদ্র যেমনটি ছিল তেমনটিই থাকে, তার বৃদ্ধি হয় না; জলধারা যেখান থেকে আসে সেখানেই আবার ফিরে যায়। এটা যদি একটা দুঃখের কারণ হয় তো ভ্রমণে কেউ আনন্দ পেত না। লোকেরা গরমের দিনে হাওয়া বদলে যায় গরমের শেষে আবার ফিরে আসতেই। তাই বলে হাওয়া বদলটা দুঃখজনক, এমন কথা তো কেউ বলে না! বরং তা থেকে আনন্দই পাওয়া যায়। জলধারার যদি অনুভ-ক্ষমতা থাকত তো এই দৃর্ণনে সে শেলীর মেঘের মতো আনন্দই বোধ করত, দুঃখ নয়। জীবনের স্পন্দনই বড় কথা। বরাবরই একটি ব্যাপার ঘটলেও তা যদি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হয় তো তাকে আর বিরক্তিকর মনে হয় না। ভবিষ্যতের সুপরিণতির দিকে তাকিয়ে বর্তমানের বিচার করা ভুল। বর্তমানের নিজেরই একটা মূল্য আছে। অংশগুলির মূল্য না থাকলে সমগ্রেরও কোনো মূল্য থাকতে পারে না। জীবন আর যাই হোক, ‘মেলোড্রামা’ নয়। মেলোড্রামা হাজার দুঃখ-বিপদের মধ্য দিয়ে গিয়েও পরিণামে একটা সুপরিণতি তথা নায়ক-নায়িকার মিলন চোখে পড়ে। জীবনে তেমনটি হয় না। হলে তা একটা কৃত্রিম ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। জীবনে কেবল সুপরিণতিরই মূল্য নেই, প্রতিটি মুহূর্তেরও মূল্য রয়েছে। আমার কালটি আমি ভোগ করলুম, আমার ছেলে তার কালটি ভোগ করবে, তারপর তাকে অনুসরণ করবে তার ছেলে–এই তো জীবন, এ-কথা বলে উন্নাসিকতা প্রদর্শনের কী আছে? বরং চিরকাল বেঁচে থাকলেই তো জীবনের স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা কমে আসে। ফলে পরিণামে জীবন বোঝার মতো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।