প্রকৃতিবিজয়ের ফলে যা আসে তা সভ্যতা নয়, আত্মমার্জিতির ফলে যা পাওয়া যায়, তাই সভ্যতা। প্রকৃতিবিজয়ের মত্ততাহেতু মানুষ আত্মমার্জনার কথা একরকম ভুলেই যাচ্ছে। তাই মনে হয়, প্রকৃতিবিজয় মানুষের জীবনে আশীর্বাদের মতো না এসে মহা অভিশাপের মতোই আবির্ভূত হয়েছে। বিজিতের চরণে সেলাম ঠুকে বিজেতা অসহায়ের মতো দাসখত দিতে দ্বিধা করেনি। ফলে মূল্যবোধ তিরোহিত হল, বিচারবুদ্ধি স্বার্থসিদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো বড় কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পেল না। অতএব বলতে ইচ্ছে হয়, প্রকৃতিবিজয় না হলেই যেন ভালো হত; কেননা, তাহলে বিজিগীষু মানুষ স্থূল বস্তুজগতের পরিবর্তে অন্যকোনো সূক্ষ্মজগৎ জয় করবার প্রেরণা লাভ করত এবং ধ্যান-কল্পনার পূজা করে ইতরতামুক্ত হতে পারত।
মনে রাখা দরকার, যা দিয়ে বাঁচা যায় তা সভ্যতা নয়; যার জন্য বাঁচা হয়, তা-ই সভ্যতা। তাই ভাত-কাপড়ের যোগাড়কে সভ্যতা না বলে সৌন্দর্য ও আনন্দের আয়োজনকেই সভ্যতা বলা সঙ্গত। মূল্যবোধের অভাবে মানুষ একথা উপলব্দি করতে পারছে না বলে ক্রমবিকাশ ব্যাহত হচ্ছে মানুষ যে তিমিরে তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। উপায়কে উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করার এই শাস্তি। এই শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন থাকা দরকার। মূল্যবোধের সচেতনতা মানে সৌন্দর্য ও আনন্দ সম্বন্ধে সচেতনতা।
কিন্তু আনন্দ আজ অবজ্ঞাত, আরাম তার স্থান দখল করে বসেছে। আরামের আয়োজনকেই আনন্দের আয়োজন মনে করে লোকে ভুল করছে। ও দুব-যে এক চিজ নয়, সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, সে সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে না পারলে সমূহ ক্ষতি। আনন্দ মানসিক ব্যাপার, আরাম শারীরিক। আরামের জয়ে শরীরেরই জয় হচ্ছে; মন বেচারি কোণঠাসা হয়ে কোনোপ্রকারে দিনগুজরান করছে মাত্র। তার দিন ফিরিয়ে আনতে না পারলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ, সংগ্রাম আরামের জন্যই হয়ে থাকে, আনন্দের জন্য হয় না। আনন্দ একান্তভাবে বস্তুনির্ভর নয়, আরাম একান্তভাবে বস্তুনির্ভর। আর বন্ধুর জন্যই যুদ্ধ। তাই পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হলে আরামের চেয়ে আনন্দ তথা শরীরের চেয়ে মনকে বড় করে তোলা দরকার। নইলে যুদ্ধবিরতির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দৃষ্টিভঙ্গিই ইটানিষ্টের মূল। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তথা মূল্যবোধের প্রতি দৃষ্টি না রেখে সমাজপরিবর্তনের চেষ্টা করলে আশাপ্রদ ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মূল্যবোধ লক্ষ্য, সমাজপরিবর্তন উপলক্ষ, এ কথাটা ভালো করে মনে রাখা চাই। নইলে সমাজপরিবর্তন আমাদের বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে না। শেষপর্যন্ত রাজতোরণে এসেও রাজার দেখা না পেয়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে। যারা বলেন, সমাজপরিবর্তন হলে মূল্যবোধ আপনাআপনি সৃষ্টি হবে, সেজন্য পূর্ব থেকে সচেতনতা বা প্রয়াসের প্রয়োজন নেই, তাদের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারিনে এইজন্য যে, মনুষ্যত্বকে তারা যতটা সস্তা মনে করেন আসলে তা ততটা সস্তা তথা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। সেজন্য সদাজাগৃতির প্রয়োজন; আর মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য ও আনন্দ সম্বন্ধে সচেতনতা সদাজাগৃতির লক্ষণ। মনুষ্যত্বকে যারা সমাজপরিবর্তনের by product মনে করেন, তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারলুম না বলে দুঃখিত।
মূল্যবোধের অভাবের দরুন আমরা আসলকে নকল, কলকে আসল, লক্ষ্যকে উপায়, উপায়কে লক্ষ্য মনে করছি। তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে। কোন জিনিসের উপর কোন জিনিস স্থাপিত হওয়া দরকার, কোটা জীবনের পাদপীঠ, কোষ্টা শিরোপা, তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলে জীবনকে শিল্পের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অন্নবস্ত্রের আয়োজন আনন্দ উপভোগের উপায় না হয়ে আনন্দ উপভোগই অন্নবস্ত্র উপার্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকেরা যখন সৌন্দর্য ও আনন্দের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে তখন বিজ্ঞের মতো বলে থাকে : আরে একটু আনন্দ উপভোগ না করলে কর্ম-উদ্যম বজায় থাকবে কী করে? আর কর্ম-উদ্যম বজায় না থাকলে আমরা জগতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কোন উপায়ে?–যেন কর্ম-উদ্যম বজায় রাখবার জন্যই আনন্দের প্রয়োজন, তার নিজস্ব কোনো সার্থকতা নেই। উপায়কে লক্ষ্য আর লক্ষ্যকে উপায় করে দেখার এ চমৎকার নিদর্শন। বিজ্ঞজনরা আনন্দ কথাটা ব্যবহার করে বটে, কিন্তু আসলে তারা যা বুঝাতে চায় তা হচ্ছে ফুর্তি। জীবনের গভীরতার সঙ্গে পরিচয় নেই বলে আনন্দ কী বস্তু তা তারা ধারণা করতেই পারে না। পারলে তাকে উপায় না করে লক্ষ্যই করত।
বহির্জীবনের চেয়ে অন্তরজীবন বড়এই মূল্যবোধের শিক্ষা। তাই বাইরের জন্য ভেতরকে, স্কুলের জন্য সূক্ষ্মকে বলি দেওয়া মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের মনঃপূত নয়। সুকুমারবৃত্তির বিকাশেই জীবনের চরিতার্থতা, স্থূল ভোগে নয়–এই বিশ্বাস আছে বলে সূক্ষ্ম উপভোগের দিকেই তার ঝোঁক। প্রয়োজনের দাবির চেয়ে অপ্রয়োজনের দাবিই তার কাছে বড়। কিন্তু তাই বলে। প্রয়োজনের দাবিও সে অস্বীকার করে না। দেহের জন্য আত্মা বিক্রয় যেমন তার কাছে মহাঅপরাধ তেমনি প্রয়োজনবোধে জীবনধারণের জন্য আত্মা বিক্রয় না-করাও মহাপাতক। বেঁচে থাকার দাবিই তার কাছে সর্বাগ্রগণ্য। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। জীবনধারণের জন্য আত্ম বিক্রয় সমর্থন করলেও সাংসারিক উন্নতির জন্য আত্ম বিক্রয় সে কোনোদিন সমর্থন করে না। সে জানে সংস্কৃতির যদি কোনো শত্রু থাকে তো সে এই সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা। কেননা, সংস্কৃতি মানে সুকুমারবৃত্তিসমূহের উৎকর্ষসাধন, আর সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা শিলাবৃষ্টির মতো সুকুমারবৃত্তির বিকাশ-উন্মুখ মুকুলগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। আগে জীবন, পরে সংস্কৃতি–একথা সে মানে কিন্তু আগে সাংসারিক উন্নতি, পরে সংস্কৃতি–এ কথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। সাংসারিক উন্নতির চেষ্টা সংস্কৃতি-কামনাকে এমনভাবে দাবিয়ে রাখে যে, তা আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না–আলো হাওয়ার স্পর্শবঞ্চিত ফুলের মতো অবচেতনের অন্ধকারে আবদ্ধ থেকে তা ধীরে ধীরে শুকিয়ে ঝরে যায়। লক্ষ্মীসরস্বতীর প্রাবাদিক কোন্দল ভিত্তিহীন হয়। ধন আর মন একসঙ্গে যায় না। ধনকে যে চেয়েছে মনকে সে পর করেছে, আর মনকে যে কামনা করেছে ধন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি–এ তো সচরাচরই দেখতে পাওয়া যায়। তাই লক্ষ্মীর ধনভাণ্ডারকে সমভাবে বেঁটে দেওয়ার উদ্যম সত্যই প্রশংসনীয়। অতিভোগ ও ভোগহীনতার পাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার এ-ই একমাত্র পথ। কিন্তু তা করতে হবে সরস্বতীর প্রতি দৃষ্টি রেখে, লক্ষ্মীর দিকে নজর রেখে নয়। ধনসাম্যের উদ্দেশ্য হোক সার্বজনীন সরস্বতী পূজা :তবেই তা মানুষের সত্যিকার মুক্তির বাহন হতে পারবে। বলাবাহুল্য, লক্ষ্মী মানে কল্যাণ আর সরস্বতী মানে সৌন্দর্য। কল্যাণের জগৎ থেকে সৌন্দর্যের জগতে গমন প্রাণের পক্ষে অধিরোহণই, অবরোহণ নয়। আর কল্যাণের জগতে থেকে যাওয়াকে অবরোহণ বলা গেলেও অধিরো বলা যায় না। তাই কল্যাণকে সৌন্দর্যের বাহন করে তোলা দরকার, নইলে প্রগতি একটা তাৎপর্যহীন বাত-কি-বাত হয়ে দাঁড়ায়।