সুসভ্যতার জন্য কল্যাণসৃষ্টি একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু তাই বলে কল্যাণই সুসভ্যতা নয়; তা সুসভ্যতার পাদপীঠ মাত্র। কল্যাণ প্রাণী-সত্তারই ব্যাপার, আর রূপ রস মানব-সত্তার। তাই রূপ ও রসের দিকে দৃষ্টি না রেখে কল্যাণ-সৃষ্টির সাধনা করলে শেষপর্যন্ত তা অন্ধগলি হয়ে দাঁড়ায়। রূপ ও রসের সাধনাই মনুষ্যত্ব তথা সভ্যতার সাধনা। কল্যাণের সাধনা তার সহায়ক, তার বেশিকিছু নয়, এ-কথা মনে না রাখলে অনেক সময় ঘোড়ার আগে গাড়ি সাজানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
রূপলোক ও রসলোকে আমাদের উন্নত করতে পারে শিক্ষা। তাই শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য, এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য মনের চোখ ও রসনা সৃষ্টি করা। যেখানে তা হয়নি সেখানে শিক্ষা ব্যর্থ। মনুষ্যত্বের সাধনা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনা, আর প্রেম সৌন্দর্য ও আনন্দের তাগিদেই আমরা লঘুভার হতে পারি। শিক্ষা আমাদের এই প্রেম-সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের সাধনায় তথা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনায় সহায়তা করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর রূপ ও রসের জন্য কল্যাণ, কল্যাণের জন্য রূপ ও রস নয়–এই বোধ থাকে না বলে শিল্প-সাহিত্যের এত অপব্যবহার ঘটে। শিক্ষার কাজ সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
প্রাণীমানুষটির চেয়েও যে একটা বড়মানুষ আমাদের জীবনে রয়েছে, তাকে না জানলে মনুষ্যত্বকে জানা হয় না। শিক্ষা আমাদের এই সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন রাখে, কিন্তু তাই বলে যে তা আমাদের একেবারে আলাদা করে রাখে, তা নয়। শিক্ষার ফলে আমরা জানিঃ রস ও সৌন্দর্যের দরুন আমরা প্রকৃত জগৎ তথা তরুলতা ও প্রাণীজগৎ থেকে আলাদা, আবার রস সৌন্দর্যের তাগিদে তার সঙ্গে বাধা, কেননা প্রকৃতি-জগতের সঙ্গে আত্মীয়তা উপলব্ধি করতে না পারলে সৌন্দর্য ও আনন্দ লাভ করা যায় না।
জীবনবৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ্য রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোনো মালী গাছের গোড়ায় জল ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে তোলবার জন্য নয়, মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ সম্বন্ধে চেতনা জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে। যখন এই চেতনা মানুষের চিত্তে জাগে তখন এক আধ্যাত্মিক সুষমায় তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারই প্রতিফলনে সমস্ত জগৎ আনন্দময় হয়ে দেখা দেয়। ফলে মানুষ ইতরজীবনের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে লঘুপক্ষ প্রজাপতির মতো হালকা মনে করে।
যেখানে কামে-প্রেমে প্রভেদ করা হয় না, সত্যে-সত্যে প্রভেদ অস্বীকৃত থাকে। অর্থাৎ নিম্নস্তরের সত্য ও উঁচুস্তরের সত্য বলে কোনো জিনিস থাকে না, যেখানে মুড়ি-মিছরির একদর, সেখানে সুসভ্যতার নিবাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আর যেখানে এর বিপরীতটি ঘটে সেখানে তা মুক্ত, স্বাধীন অবাধগতি। তার চলার ভঙ্গিতে ঝলমল করে ওঠে মানুষের দেহমন, হালকা হয়ে যায় জীবনের গুরুভার। সত্যের স্তরভেদে সুসভ্যরা বিশ্বাসী। তারা জানে সমাজগঠনের নীতি নিম্নস্তরের সত্য, জীবনগঠনের নীতি উঁচুস্তরের সত্য। এবং সমাজগঠনের নীতিকে যে-মূল্য দেওয়া উচিত তা তারা দেয়, কিন্তু কখনো তাকে জীবনগঠনের নীতির মর্যাদা দেয় না।
মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার
পেরিক্লিসীয় এথেস্, রিনেসাঁসের ইটালি ও অষ্টাদশ শতকের ফরাসিদেশ এই সভ্যতাত্রয়ের যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়–মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব। এই দুই বৈশিষ্ট্য যে সবসময় আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে তা নয়, প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। যুক্তিবিচারদৃঢ় মূল্যবোধ ও মূল্যবোধস্নিগ্ধ যুক্তিবিচার প্রতি সভ্যতায়ই এই দুই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
এখানে প্রশ্ন হবে : মূল্যবোধ কাকে বলে, আর যুক্তিবিচার জিনিসটাই বা কী?–নিকটবর্তী স্কুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সূক্ষ্ম সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা–এসবই মূল্যবোধের লক্ষণ; আর এ সকলের অভাবই মূল্যবোধের অভাব। যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব বলতে বোঝায় জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা। যুক্তিবিচার সকলের ভেতরেই কিছু-না-কিছু থাকে, কিন্তু এই সাধারণভাবে থাকা নয়, বিশেষ ও ব্যাপকভাবে থাকার কথাই বলা হচ্ছে। এ যেন যুক্তিবিচারের পূজা, অর্থাৎ তার আদেশ পালন, কার্যসিদ্ধির জন্য তার নামমাত্র ব্যবহার নয়। নিরঞ্জন শুভবুদ্ধিই যুক্তিবিচার স্বার্থের দাগ লাগা বুদ্ধিকে যুক্তিবিচারের সম্মান দেওয়া যায় না। তখন সে আর প্রভু নয়, গোলাম–আমাদের স্বার্থের মোট বয়ে বেড়ানো তার কাজ। সচরাচর আমরা যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে থাকি সে এই স্বার্থের মোটবওয়া গোলামবুদ্ধি, মুক্ত নিরঞ্জন প্রভুবুদ্ধি নয়।
বুদ্ধি কী করে স্বার্থকলঙ্কিত হয়ে তার নিরঞ্জনত্ব হারিয়ে বসে, যত্রতত্রই তার নজির পাওয়া যায়–সেজন্য বিশেষ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না। তথাপি একটা দৃষ্টান্ত দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছিনে। সেদিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ধর্ম, রাজনীতি, হিন্দু মুসলমান সমস্যা ইত্যাদি আলোচনা করছিলুম। কথায় কথায় একজন বলে উঠলেন : আরে ছেঃ! হিন্দু মুসলমানের মিলনের কথা আর তুলো না, তা কখনো সম্ভব হতে পারে না। যারা আমাদের এতটা অবজ্ঞা করে যে, আমাদের নামগুলো পর্যন্ত শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে কি লিখতে পারে না, তাদের সঙ্গে মিল হতে পারে কী করে? অথচ দেখ না, আমরা কত সহজে তাদের নামগুলি, শুধু তাই নয়, তাদের দেবতাদের নামগুলি পর্যন্ত, লিখে যেতে পারি–কোথাও একটুকুবানান ভুল না করে–উপস্থিত সকলেই কথাটায় সায় দিলেন, আমিও বাদ রইলুম না। কিন্তু নির্জনে চিন্তা করতে গিয়ে যখন নিরঞ্জন শুভ্রবুদ্ধির আলোক লাভ করলুম তখন বুঝতে পারলুম ভুল হয়ে গেছে, না-ভেবেচিন্তে তখন কথাটায় সায় দেওয়া ঠিক হয়নি। মুসলমান যে হিন্দুর নামগুলো যথাযথ বানান ও উচ্চারণ করতে পারে, সে মুসলমানের গুণ নয়; কেননা বাংলা মুসলমানের মাতৃভাষা, আর হিন্দুর নামকরণ সে ভাষাতেই হয়ে থাকে, আর হিন্দু-যে মুসলমানের নামগুলো বিশুদ্ধভাবে বানান ও উচ্চারণ করতে পারে না, সে হিন্দুর দোষ নয়–কেননা মুসলমানের নামকরণ সাধারণত যে-দুটি ভাষায় হয়ে থাকে, সেই আরবি ও ফারসি ভাষা হিন্দুর মাতৃভাষা নয়। (হিদুর কথা না হয় থাক, শতকরা কজন মুসলমান মুসলমানের নামগুলি–সেসবের মধ্যে নিজেদেরগুলোও অন্তর্ভুক্ত–ঠিকমতো বানান ও উচ্চারণ করতে পারে, তা ভেবে দেখবার বিষয়। অবশ্য ইচ্ছাকৃত ত্রুটি যে নেই তা নয়, কিন্তু বেশিরভাগই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি।