আত্মার জগতের স্বাদ পাওয়া যায় সাহিত্যে, শিল্পে। তাই সাহিত্যশিল্পের সহায়তায়ই মানুষের মনের উন্নয়ন সম্ভব হয়। গল্প-উপন্যাস ও কবিতা পড়তে পড়তে কী করে যে মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয় মানুষ নিজেই তা টের পায় না। এখন থেকে সে রূপ ও রসলোকের অধিবাসী এবং সেখান থেকে সমস্ত জীবন রাজার মতো শাসন করা তার কাজ। এতদিন তার চালক ছিল ইন্দ্রিয়, এখন চালক হচ্ছে রূপবোধ, রসবোধ অন্য কথায় মূল্যবোধ। নতুন রাজার শাসন মানতে-মানতে ইন্দ্রিয়গুলিও যে রূপান্তর লাভ করে! এতদিন তারা ছিল একক, এখন তাদের আরেকটি সঙ্গী এসে জুটেছে। এতদিন তারা তাদের আহার্য পেলেই খুশি হত, এখন থেকে সহজে খুশি হয়ে ওঠা ভার হয়ে উঠল। সঙ্গীর সত্তাটি যেন অশ্রুভেজা কন্ঠে বলতে থাকে : ভাই তোমরা তো খেলে, আমি তো উপোসী রইলুম, কই আমার দিকে একবার ফিরেও তো তাকালে না। সঙ্গীটির কথায় তারা এমন অভিভূত হয়ে পড়ে যে, তাকে উপোসী রেখে তাদের মুখে আর অন্ন রোচে না, ফলে অনেক সময় তাদের উপোসী থাকতে হয়। তারা কী করে যেন টের পায় : ভোগের চেয়ে সম্ভোগ বড়, আর একসঙ্গে ইন্দ্রিয় ও আত্মার যে ভোগ তা-ই সম্ভোগ। তাই আত্মাকে বাদ দিয়ে তারা কিছুই ভোগ করতে চায় না। আত্মার সংস্পর্শে এসে তাদের উন্নয়ন হয়, প্রেম ও সৌন্দর্য ব্যতীত ভোগ-যে একটা ইতর ব্যাপার, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে।
যে-সাহিত্য ও শিল্পের দৌলতে মানুষের এহেন উন্নয়ন, সে-সাহিত্যশিল্পকে প্রচারধর্মী করা হলে তাদের অবনতি ঘটে, আর সাহিত্যশিল্পের অবনতিতে পরিণামে মানুষেরই ক্ষতি। সাহিত্যশিল্পের কাজ সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশন, এবং তারই মারফতে ধীরে ধীরে মূল্যবোধ সৃষ্টি। তাই সাহিত্য ও শিল্প যদি অন্নবস্ত্রের সমাধান না করতে পারে, অথবা অন্নবশ্বের অভাবের কথা প্রচার করতে ত্রুটি করে তো তাকে ব্যর্থ বলে নিন্দিত করা অন্যায়। সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশনের অক্ষমতাতেই তার ব্যর্থতা, অন্য কোনোরূপ ব্যর্থতা ধৰ্য্য নয়। সাহিত্যের একটি নিজের জগৎ আছে সেই জগতের কাজ করে সে যদি অন্য জগতের কাজ করতে পারে তো তাতে কারো আপত্তি হতে পারে না, কিন্তু নিজের জগতের কাজটি ষোলো আনা করা চাই।
সাহিত্যিক আর শিল্পী আসলে প্রেমিক তারা ভালোবেসেছে এই রূপরসগন্ধস্পর্শময়ী ধরণীকে। প্রেমিক সুদিনে প্রিয়াকে খুশি করতে চায় গান গেয়ে, ছবি এঁকে; কিন্তু দুর্দিনে মাঝে মাঝে তাকে প্রিয়ার নাড়ি টিপেও দেখতে হয়। এটা তার পক্ষে সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়, দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তেমনি কালের গরজে যদি সাহিত্যিক ও শিল্পীকে social engineer কি ভিষক হতেই হয়, তথাপি তাদের মনে রাখা দরকার, সেটা তাদের আসল কাজ নয়, আসল কাজ সৌন্দর্য ও আনন্দ পরিবেশন। দুর্ভাগ্যকে যেন তারা সৌভাগ্য মনে না করে। প্রয়োজনের তাগিদে আসল উদ্দেশ্যটি ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক, তাই লক্ষ্যটি সম্বন্ধে বিশেষভাবে সচেতন থাকা দরকার। অস্তিত্বের স্থূলচিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে অনুভুতি ও কল্পনার সু। জগতে নিয়ে যাওয়াই কাজ; তাই উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দেয় বলে যে-রচনার অস্তিত্বের চিন্তা বড় হয়ে ওঠে সে-রচনা–তাতে যতই মস্তিষ্কের ঘি ঢালা হোক না কেন–উঁচুশ্রেণীর রচনা হতে পারে না। ঘড়া ঘড়া ঘি ঢাললেও শাক শাকই থেকে যায়, পোলাও হয় না। যে রচনা জীবনের অমৃতত্ব সম্বন্ধে সচেতন না করে মানুষকে ইতরজীবনের নাগপাশে বন্দি করে রাখে, তাকে কিছুতেই সার্থক রচনা বলা যায় না।
সাহিত্য ও শিল্পের ফলে মানুষের এহেন উন্নয়ন হয়, একথা ঠিক কিন্তু শরীর চিন্তা থেকে মুক্তি না পেলে সহজে সাহিত্যশিল্পের জগতে প্রবেশ করা যায় না। তাই নিচের তলার ঘরটি ভালো করে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। মানুষের চেহারার দিকে তাকালেই মনে হয়, কী একটা অসামঞ্জস্যের পীড়ায় যেন তার জীবন দ্বিধাবিত–জীবনের অটুটভাব সে হারিয়ে বসেছে; অখণ্ডতার আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত। সে যেন চেহারা দিয়েই গাইতে থাকে :
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুই তারে,
জীবন-বীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে।
অনেকে সমস্যাটির সমাধান করতে চান সরু তারটি ছিঁড়ে দিয়ে। কিন্তু সেটি সার্থক সমাধান নয়; মোটা তারটিকে সরু তারটির উপযুক্ত করে তোলাই সার্থক সমাধান। সমাজব্যবস্থাকে এমন সুশৃখল করা দরকার যেন তা সুকুমারজীবনের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। তাহলেই আমরা উপলব্দি কর, যোগ্যতমের উদ্বর্তন-নীতি অতীতকালের মন্ত্র, আর পেছনে ফেলে আসা প্রাণীযুগের মন্ত্র আওড়িয়ে লাভ নেই, লাভ ভবিষ্যৎ জীবনের মন্ত্র আওড়িয়ে; আর তা হচ্ছে : Expression of the beautiful–সুন্দরের বিকাশ। সম্মুখের মন্ত্র আমাদের সম্মুখে টেনে নিক, অতীতের মন্ত্র অতীত হয়ে যাক।
প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দই মানুষের মধ্যে মূল্যবান, তাই এদের জয় মনুষ্যত্বেরই জয়, আর এদের সঙ্গে যোগ্যতমের উদ্বর্তন নীতির বৈরীভাব সুবিদিত। জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বাদ পেতে হলে এই সর্বনাশা নীতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া চাই নইলে তা মাধ্যাকর্ষণের মতোই আমাদের ইতর জীবনে আবদ্ধ করে রাখবে, ওপরে উঠতে দেবে না। Expression of the beautiful-এর মন্ত্র ঊর্ধ্বকর্ষণের মন্ত্র–তা পঙ্কিল জীবন থেকে ঊর্ধ্বে টেনে নিয়ে আমাদের আত্মিক ক্রমবিকাশে সহায়তা করবে। তারই টানে বর্বরতামুক্ত হয়ে আমরা সুসভ্য হয়ে উঠব। আর সুসভ্যতাই মানুষের শ্রেষ্ঠ কাম্য।