ফুল্লধরার কাঁটা তুলে তুলে আঙুল রাঙাব কত,
আত্মঘাতীর মতো।
আমার ধরণী শ্যামা অপসরা
নাচে শিরে ধরি শোভার পসরা
কোথা রে মৃত্যু কোথা তব জরা
এ দেখা দেখিব কবে?
অন্য দেখায় কী আমার বলো হবে।*[*রাখী-অন্মদাশংকর রায়।]
এই-যে সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টি, এ প্রগতির দান নয়, সংস্কৃতির দান। (ওস্তাদি গানের অনুশীলনে প্রগতির মাথাব্যথা থাকার কারণ নেই, কিন্তু সংস্কৃতির আছে।) সংস্কৃতি সৌন্দর্যভুক। প্রগতি কল্যাণভুক। তাই কাঁটা বাছার কাজে জীবন যাতে সাঙ্গ হয়ে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। মাঝে মাঝে জগতের দুঃখ-বেদনার কথা ভোলা ভালো। তাতে লাভ এই যে, নিজেকে আর কাঁটা করে তুলতে হয় না। ফলে অন্তত একটা কাটা থেকে জগৎ মুক্তি পেয়ে যায়।
মনুষ্যত্ব
মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা–জীব-সত্তা আর মানব-সত্তা। জীব-সত্তার কাজ প্রাণধারণ আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা। এখানে মানুষ বৈশিষ্ট্যহীন, প্রাণীজগতেরই একজন-অপরাপর প্রাণীদের মতো ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ছোটাছুটি করা তার কাজ। কী করে বাঁচা যায় ও সন্তানসন্ততিদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চিন্তায় সে অস্থির। কিন্তু প্রাণী হলেও মানুষ অপরাপর প্রাণীদের পশ্চাতে ফেলে এসেছে এবং নিজের মধ্যে অনুভব করেছে এক নতুন সত্তা। এই নব-অনুভূত সত্তার নামই মানব-সত্তা, আর এখানেই মানুষ অপরাপর প্রাণী থেকে আলাদা। আত্মরক্ষা কি বংশরক্ষা নয়, মুক্তির আনন্দ উপভোগই এখানে বড় হয়ে ওঠে। মুক্তি মানে অস্তিত্বের চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি; শুধু তাই নয়, এক নব সূক্ষ্ম অস্তিত্বের উপলব্বি। ব্যাপারটা আসলে ঋণাত্মক নয়, ধনাত্মক। সাহিত্যশিল্পের মারফতেই এই মুক্তির আনন্দ আস্বাদন করা যায়, তাই তাদের এত মূল্য।
প্রাণধারণের জন্য সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি, তা যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, মনুষ্যত্ব নয়, প্রাণি আর অবসর সময়ে সাহিত্যশিল্পের রস-আস্বাদান, তা যতই অপ্রয়োজনীয় হোক না কেন, মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব রসের ব্যাপার, তাই রসিকরাই বেশি মানুষ। জাতিধর্ম ও আদর্শ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে বেমালুম মিশে যেতে পারেন বলে রসিকরাই মনুষ্যত্বকে সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেন–কোনো বাধাই তাদের উপলব্ধির পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে না। (এখানেই মতবাদীর সঙ্গে রসিকের পার্থক্য; মতবাদী যতই মানুষের উপকারের জন্য চিৎকার করুক না কেন, কখনো মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না মতবাদের নেশাই তার উপলব্বির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর রসিক যত অকাজেরই হোক না কেন, মনুষ্যত্বের পূর্ণ উপলধির সৌভাগ্য তারই। অপ্রয়োজনের জগৎই মনুষ্যত্বের জগৎ এখানেই মানুষ আত্মার লাবণ্য উপভোগ করে। প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দ না হলেও প্রাণধারণের ক্ষতি হয় না; বাঁচার জন্য এরা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু মানুষের মতো বাঁচতে হলে এসব না হলে চলে না। তাই একান্ত প্রয়োজনীয় না হলেও প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। এসব নিয়ে মানুষ বাঁচে না, কিন্তু এসবের জন্য বাঁচে।
সাহিত্য ও শিল্পের জগৎ প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দের জগৎ। তাই এখানে অস্তিত্ব তথা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথা বড় হয়ে ওঠে না, প্রেম ও সহানুভূতির কথা বড় হয়ে ওঠে। প্রেম ও সহানুভূতি আত্মার ইন্দ্রিয়, আর এই ইন্দ্রিয়ের সহায়তায়ই মানুষ মানবসত্তাকে উপলব্ধি করে।
মনুষ্যত্ব তথা মুক্তির আকাক্ষা মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ দিক হলেও প্রাণিত্বকে অবহেলা করা যায় না, বরং মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়েও চলা যায়, কিন্তু প্রাণিত্বকে বাদ দিয়ে চলা কঠিন। তাই মানুষকে প্রাণিত্বের সাধনাই করতে হচ্ছে বেশি। রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি প্রাণিত্বের সাধনারই নিদর্শন, আর তারই ফলে মানুষের জীবনধারণ আর আদিম জৈব ব্যাপার ন-থেকে ধীরে ধীরে মানবিক ব্যাপার হয়ে ওঠে। মানবিক হওয়ার অর্থ জৈব ব্যাপারটাই মনুষ্যত্বের পর্যায়ে উন্নীত হওয়া নয়, মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া–মানবোচিত হওয়া।
মানুষ তার বুদ্ধি ও কল্পনার সহায়তায় জৈব ব্যাপারটি সুনিয়ন্ত্রিত করতে চাচ্ছে সেজন্য পৃথিবীজুড়ে বিরাট আয়োজন চলেছে। খুব আশা ও আনন্দের কথা। কিন্তু লক্ষ্যের দিকে নজর না রাখলে শেষপর্যন্ত সমস্ত চেষ্টাই ভণ্ডুল হতে বাধ্য। লক্ষ্য হচ্ছে মুক্তি-আত্মার লাবণ্য উপভোগ। শারীরিক চিন্তা থেকে মুক্তি চাই আত্মার জগতে প্রবেশের জন্য, এ-কথা মনে না রাখলে জীবনের উন্নয়ন সম্ভব হয় না।
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীব-সত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানব-সত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীব-সত্তার ঘর থেকে মাব-সত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানব-সত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীব-সত্তার ঘরেও সে কাজ করে ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলা তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায়, শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনের দিকও আছে, আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক। সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়, কী ক’রে মনের মালিক হয়ে অনুভূতি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়।