- বইয়ের নামঃ গুল-বাগিচা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অচেনা সুরে অজানা পথিক
পিলু কাহারবা
অচেনা সুরে অজানা পথিক
নিতি গেয়ে যায় করুণ গীতি।
শুনিয়া সে গান দুলে ওঠে প্রাণ
জেগে ওঠে কোন হারানো স্মৃতি॥
ঘুরিয়া মরে উদাসী সে সুর
সাঁঝের কূলে বিষাদ-বিধুর,
নীড়ে যেতে হায় পাখি ফিরে চায়,
আবেশে ঝিমায় কুসুম-বীথি॥
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে
মুলতান-কানাড়া মিশ্র দাদরা
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে।
নিদ্রা নাহি তোমায় চাহি আমার নয়ন-পাতে॥
ভেজা মাটির গন্ধ সনে
তোমার স্মৃতি আনে মনে,
বাদলি হাওয়া লুটিয়ে কাঁদে আঁধার আঙিনাতে॥
হঠাৎ বনে আসল ফুলের বন্যা
পল্লবেরই কূলে,
নাগকেশরের সাথে কদম কেয়া
ফুটল দুলে দুলে।
নবীন আমন ধানের খেতে
হতাশ বায়ু ওঠে মেতে,
মন উড়ে যায় তোমার দেশে
পুব-হাওয়ারই সাথে॥
আঁখি-বারি আঁখিতে থাক, থাক ব্যথা হৃদয়ে
ভৈরবী মিশ্র কাহারবা
আঁখি-বারি আঁখিতে থাক, থাক ব্যথা হৃদয়ে।
হারানো মোর বুকের প্রিয়া রইবে চোখে জল হয়ে॥
নিশি-শেষে স্বপন-প্রায়
নিলে তুমি চির-বিদায়,
ব্যথাও যদি না থাকে হায়,
বাঁচিব গো কী লয়ে॥
ভালোবাসার অপরাধে
প্রেমিক জনম জনম কাঁদে,
কুসুমে কীট বাসা বাঁধে
শত বাধা প্রণয়ে।
আজকে শুধু করুণ গীতে
কাঁদিতে দাও, দাও কাঁদিতে,
আমার কাঁদন-নদীর স্রোতে
বিরহের বাঁধ যাক ক্ষয়ে॥
আঁচল হংস-মিথুন আঁকা
ভৈরবী কাহারবা
আঁচল হংস-মিথুন আঁকা
বলাকা-পেড়ে শাড়ি দুলায়ে।
চলিছে কিশোরী শ্যামা একা
রুমুঝুমু বাজে নূপুর মৃদু পায়ে॥
ভয়ে ভয়ে চলে আধো-আঁধারে
বিরহী বন্ধুর দূর-অভিসারে
পথ কাঁদে যেয়ো না যেয়ো না যেয়ো না ওগো
থামো ক্ষণেক এ ঠাঁয়ে।
আজি এ বাদল-দিনে কত কথা মনে পড়ে
কাজরি দাদরা
আজি এ বাদল-দিনে
কত কথা মনে পড়ে।
হারাইয়া গেছে প্রিয়া
এমনই বাদল-ঝড়ে॥
আমারই এ বুকে থাকি
ঘুমাত সে ভীরু পাখি,
জলদ উঠিলে ডাকি
লুকাত বুকের পরে॥
মোর বুকে মুখ রাখি নিবিড় তিমির কাঁদে
আমার প্রিয়ার মতো বাঁধিয়া বাহুর বাঁধে॥
কোথায় কাহার বুকে
আজি সে ঘুমায় সুখে,
প্রদীপ নিভায়ে কাঁদি
একা ঘরে তারই তরে॥
আজি কুসুম-দিপালি জ্বলিছে বনে
ভীমপলশ্রী-মিশ্র দাদরা
আজি কুসুম-দিপালি জ্বলিছে বনে॥
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
জ্বলে দীপ-শিখা আম-মুকুলে
রাঙা পলাশে অশোকে বকুলে,-
আসে সে আলোর টানে বনতল
মৌমাছে প্রজাপতি দলে দল,
পুড়ে মরিতে সে রূপ-শিখাতে,
প্রাণ সঁপিতে বাসন্তিকাতে
পরিমল-অঞ্জন মাখিয়া নয়নে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
জ্বলে গগনে তারার দীপালি
আজি ধরাতে আকাশে মিতালি।
ধরা চাঁপার গেলাস ভরিয়া
মধু ঊর্ধ্বে তোলো গো ধরিয়া,
পান করিতে সে মধু-পরিরা
আসে নেমে কাননে স-শরীরা।
বাজে উৎসব-বাঁশি গগনে পবনে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
আজি বাতাবি নেবুর কুঞ্জে
শ্যামা দোয়েল মধুপ গুঞ্জে,
ফেরে আকাশে পক্ষ প্রসারি
ফুল- কিশোর স্বপন-পসারি।
সাড়া জাগে বনে বনে সাজ-সাজ
ওই এল রে এল রে ঋতুরাজ,
তাই সেজেছে প্রকৃতি কুসমি বসনে।
হেরো ঝিমায় আকাশ চাঁদের স্বপনে॥
আমার দেশের মাটি
বাউল লোফা
আমার দেশের মাটি
ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি॥
এই দেশের মাটি-জলে
এই দেশেরই ফুলে ফলে
তৃষ্ণা মিটাই, মিটাই ক্ষুধা
পিয়ে এরই দুধের বাটি॥
এই মায়েরই প্রসাদ পেতে,
মন্দিরে এর এঁটো খেতে
তীর্থ করে ধন্য হতে আসে কত জাতি॥
এই দেশেরই ধুলায় পড়ি
মানিক যায় রে গড়াগড়ি,
বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙাল
এই দেশেরই জিয়ন-কাঠি॥
এই মাটি এই কাদা মেখে,
এই দেশেরই আচার দেখে,
সভ্য হল নিখিল ভুবন দিব্য পরিপাটি॥
এই সন্ন্যাসিনী সকল দেশে,
জ্বালল আলো ভালোবেসে
মা আঁধার রাতে একলা জাগে
আগলে রে এই শ্মশান-ঘাঁটি॥
আমার বিজন ঘরে হেসে এল পথিক মুসাফির-বেশে
বারোয়াঁ-মিশ্র কাহারবা
আমার বিজন ঘরে হেসে এল পথিক মুসাফির-বেশে।
শরমে মরিয়া তারে শুধাই, তরুণ পথিক, কী তব চাই।
সে কহে, – যা দাও লইব তাই॥
দিনু তারে খোঁপার ফুল,
সে কহে, – এ নহে, করেছ ভুল।
কহিনু, – ভিখারি কী তবে চাও?
সে কহে, – গলার মালাটি দাও॥
বসিতে তারে দিনু আসন,
দাঁড়ায়ে রহে সে করুণ-নয়ন।
কহিনু, – কী চাহ ওগো শ্যামল?
সে কহে, – তোমার আধেক আঁচল॥
কহিনু, – কেন এ আঁখি-পানে
চাহিয়া রয়েছ এক ধ্যানে?
আমার চোখে কী চাও বঁধু?
সে কহে, – অনুরাগের মধু॥
কহিনু, – হে প্রিয়, নাহি যে ঠাঁই,
ভাঙা কুটির, চাঁদে কোথায় বসাই।
কহিল না কথা অভিমানী –
কী হল শেষে সই নাহি জানি।
হেরিনু প্রভাতে পাশে মম
ঘুমায় আমার প্রিয়তম॥
আমার ভাঙা নায়ের বইঠা ঠেলে
ভাটিয়ালি কাহারবা
আমার ভাঙা নায়ের বইঠা ঠেলে
আমি খুঁজে বেড়াই তারেই রে ভাই
যে গিয়াছে আমায় ফেলে॥
আমার, তোদের মতোই ঘর ছিল ভাই
এমনি গাঙের কূলে,
সেই ঘরেতে রূপের জোয়ার
উঠত দুলে দুলে।
সেই সোনার পরি উড়ে গেছে
সোনার পাখা মেলে॥
পায়ে চলে খুঁজি তারে,
গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজি,
নাইতে চলে বউ-ঝি,
আমি ভাবি সে-ই বুঝি।
চাঁদের দেশের মেয়ে সে ভাই
গেছে বাপের বাড়ি,
মাটিতে মোর পা বাঁধা ভাই,
উড়ে যেতে নারি।
হারালে সব যায় পাওয়া ভাই,
শুধু মানুষ নাহি মেলে॥
আসিলে কে গো বিদেশি
দেশি টোড়ি মিশ্র কাহারবা
আসিলে কে গো বিদেশি
দাঁড়ালে মোর আঙিনাতে।
আঁখিতে লয়ে আঁখি-জল
লইয়া ফুল-মালা হাতে॥
জানি না চিনি না তোমায়,
কেমনে ঘরে দিব ঠাঁই,
অমনি আসে তো সবাই
হাতে ফুল, জল নয়ন-পাতে॥
কত-সে প্রেম-পিয়াসি প্রাণ
চাহিছে তোমার হাতের দান,
কাঁদায়ে কত গুলিস্তান
আমারে এলে কাঁদাতে॥
ফুলে আর ভোলে না মোর মন, গলে না নয়নজলে,
ভুলিয়া জীবনে একদিন আজিও জ্বলি জ্বালাতে॥
পাষাণের বুকে নদী বয়, যে পাষাণ সে পাষাণই রয়,
ও শুধু প্রতারণা ছল, নয়নে নীর, নিঠুর হৃদয়।
আমারে মালারই মতন দলিবে নিশি-প্রভাতে॥