মম আগমনে বাজে আগমনির সানাই
(শরৎ)
রামকেলি কাহারবা
মম আগমনে বাজে আগমনির সানাই।
সহসা প্রভাতে ‘আমি এসেছি’ জানাই॥
আমি আনি দেশে দশভুজার পূজা,
কোজাগরি নিশি জাগি আমি অনুজা।
বুকে শাপলা কমল –
মালা দোলে টলমল,
আমি পরদেশি বন্ধুরে স্বদেশে আনাই॥
মহাকালের কোলে এসে গৌরী আমার হল কালী
দুর্গা গীতাঙ্গী
মহাকালের কোলে এসে গৌরী আমার হল কালী।
মুখে তাহার পড়ুক কালি
মাকে কালো বলে যে দেয় গালি॥
মায়ের অমন রূপ কি হারায়?
সে যে ছড়িয়ে আছে চন্দ্র-তারায়,
মায়ের রূপের আরতি হয়
নিত্য সূর্য-প্রদীপ জ্বালি॥
ভৈরবেরে বরণ করে উমা হল ভৈরবী
মা অভিমানে শ্মশানবাসী শিবের জটায় জাহ্নবী!
পার্বতী মোর পাগলি মেয়ে
চণ্ডী সেজে বেড়ায় ধেয়ে,
শ্মশান-চিতার ভস্ম মেখে
ম্লান হল মা-র রূপের ডালি॥
মা এসেছে মা এসেছে উঠল কলরোল
বাউল–ভাটিয়ালি মিশ্র দাদরা
(আগমনি)
মা এসেছে মা এসেছে
উঠল কলরোল।
দিকে দিকে উঠল বেজে
সানাই কাঁসর ঢোল॥
ভরা নদীর কূলে কূলে,
শিউলি শালুক পদ্মফুলে,
মায়ের আসার আভাস দুলে,
আনন্দ-হিল্লোল।
সেই পুলকে পড়ল নিটোল
নীল আকাশে টোল॥
বিনা কাজের মাতন রে আজ কাজে দে ভাই ক্ষমা,
বে-হিসাবি করব খরচ সাধ যা আছে জমা।
এক বছরের অতৃপ্তি ভাই
এই কদিনে কীসে মিটাই,
কে জানে ভাই ফিরব কিনা
আবার মায়ের কোল।
আনন্দে আজ আনন্দকে
পাগল করে তোল॥
মাতল গগন-অঙ্গনে ওই
দরবারি কানাড়া মিশ্র রূপক
মাতল গগন-অঙ্গনে ওই
আমার রণ-রঙ্গিণী মা।
সেই মাতনে উঠল দুলে
ভূলোক দ্যুলোক গগন-সীমা॥
আঁধার-অসুর-বক্ষপানে
অরুণ আলোর খড়্গ হানে,
মহাকালের ডম্বরুতে উঠল বেজে মা-র মহিমা॥
সৃষ্টিপ্রলয় যুগল নূপুর
বাজে শ্যামার যুগল পায়ে,
গড়িয়ে পড়ে তারার মালা
উল্কা হয়ে গগন-গায়ে।
লক্ষ গ্রহের মুণ্ডমালা দোলে গলে দোলে ওই
বজ্র-ভেরির ছন্দ-তালে নাচে শ্যামা তাথইথই,
অগ্নিশিখায় ঝলকে ওঠে
খড়্গ-ঝরা লাল শোণিমা॥
মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে
পাহাড়ি মিশ্র কাহারবা
মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে।
সজল কাজল-লেখা হব আঁখির পলকে।
জলকে-যাওয়ার কলস হব অলস সন্ধ্যায়,
ছল করে গো অঙ্গে তোমার পড়ব ছলকে॥
তাম্বুল রাগ হব তোমার অরুণ অধরে,
দুলব স্বপন-কমল হয়ে ঘুমের সায়রে,
জ্যোতি হব তোমার রূপের বিজলি-ঝলকে॥
বক্ষে তোমার হার হব গো নূপুর চরণে,
গোপন প্রেমের দাগ হব গো হিয়ার ফলকে॥
মুঠি মুঠি আবির ও কে কাননে ছড়ায়
চৈতি খেমটা
মুঠি মুঠি আবির ও কে কাননে ছড়ায়।
রাঙা হাসির পরাগ ফুল-আননে ঝরায়॥
তার রঙের আবেশ লাগে চাঁদের চোখে,
তার লালসার রং জাগে রাঙা অশোকে।
তার রঙিন নিশান দুলে কৃষ্ণচূড়ায়॥
তার পুষ্পধনু দোলে শিমুল-শাখায়,
তার কামনা কাঁপে গো ভোমরা-পাখায়,
সে খোঁপাতে বেলফুলের মালা জড়ায়॥
সে কুসুমি শাড়ি পরায় নীল-বসনায়,
সে আঁধার মনে জ্বালে লাল রোশনাই।
সে শুকনো বুকে ফাগুন-আগুন ধরায়॥
মেঘ-মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পবন
পিলু – বারোয়াঁ কাহারবা
মেঘ-মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পবন,
কে বিরহী রহি রহি দ্বারে আঘাত হানো।
শাওন ঘন ঘোর ঝরিছে ধারা অঝোর
কাঁপিছে কুটির মোর দীপ-নেভানো॥
বজ্রে বাজিয়া ওঠে তব সংগীত,
বিদ্যুতে ঝলকিছে আঁখি-ইঙ্গিত,
চাঁচর চিকুরে তব ঝড় দুলানো
ওগো মন ভুলানো॥
এক হাতে সুন্দর, কুসুম ফোটাও!
আর হাতে নিষ্ঠুর, মুকুল ঝরাও!
হে পথিক, তব সুর অশান্ত বায়
জন্মান্তর হতে যেন ভেসে আসে হায়!
বিজড়িত তব স্মৃতি চেনা অচেনায়
প্রাণ-কাঁদানো॥
মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে
‘ইজিপসিয়ান ডান্সের’ সুর
মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে
নেচে যায়।
বিহ্বল চঞ্চল-পায়॥
সাহারা মরুর পারে
খর্জুর-বীথির ধারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝংকারে।
উড়িয়ে ওড়না ‘লু’ হাওয়ায়
পরি-নটিনি নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
সুরমা-পরা আঁখি হানে আশমানে,
জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে।
ঢেউ তুলে নীল দরিয়ায়
দিল-দরদি নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
দোলে রে গলে দোলে তার
খেজুর-মেতীর সোনার হার,
ছন্দ-দোদুল।
মিশরের আনন্দ সে
চপল ‘রমল’ ছন্দ সে,
জিয়ানো মিছরি-রসে তার হাসি অতুল।
নারঙ্গী-আঙুরবাগে তার
গান গাহে বুলবুল॥
মরীচিকা-মায়া সে
দেয় না ধরা, ছায়া সে,
পালিয়ে সে যায় সুদূর।
যায় নেচে সে নটিনি
নীল দরিয়ার সতিনি
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
মোর বুক-ভরা ছিল আশা
দেশ–খাম্বাজ কাওয়ালি
মোর বুক-ভরা ছিল আশা
ছিল প্রাণ-ভরা ভালোবাসা।
হায় আসিল সে যবে কাছে
মোর মুখে সরিল না ভাষা॥
আমি পেয়েছিনু তায় একা,
তার চোখে ছিল প্রেম-লেখা,
তবু বলিতে নারিনু, প্রাণে
মোর কাঁদিছে কোন দুরাশা॥
আমি পান না করিনু বারি
এসে ভরা সরসীর তীরে,
হায় আমার মতন ‘শহিদ’
কেহ দেখেছে কোথাও কি রে?
এই তৃষ্ণা-কাতর বুকে
ছিল মরুভূমির পিপাসা॥
যবে সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় তুলসীতলায়
ইমন মিশ্র কাহারবা
যবে সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় তুলসীতলায়
তুমি করিবে প্রণাম।
তব দেবতার নাম নিতে ভুলিয়া বারেক
প্রিয় নিয়ো মোর নাম॥
একদা এমনই এক গোধূলিবেলা
একেলা ছিলাম আমি, তুমি একেলা,
জানি না কাহার ভুল, তোমার পূজার ফুল
আমি লইলাম।
সেই দেউলের পথ সেই ফুলের শপথ
প্রিয়া তুমি ভুলিলে, হায় আমি ভুলিলাম॥
দু-ধারে পথের সেই কুসুম ফোটে
হায় এরা ভোলেনি,
বেঁধেছিল তরু-শাখে লতার যে ডোর
হেরো আজও খোলেনি।
একদা যে নীল নভে উঠেছিল চাঁদ
ছিল অসীম আকাশ ভরা অনন্ত সাধ,
আজি অশ্রু-বাদল সেথা ঝরে অবিরাম॥