- বইয়ের নামঃ গানের মালা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা চিরচেনা
সাহানা-বাহার কাওয়ালি
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চিরচেনা!
ফোটাও মনের বনে তুমি বকুল হেনা
চিরচেনা॥
যৌবন-মদগর্বিতা তন্বী
আননে জ্যোৎস্না, নয়নে বহ্নি,
তব চরণের পরশ বিনা
অশোক তরু মুঞ্জরে না, চিরচেনা॥
নন্দন-নন্দিনী তুমি দয়িতা চির-আনন্দিতা,
প্রথম কবির প্রথম লেখা তুমি কবিতা।
নৃত্যশেষের তব নূপুরগুলি হায়
রয়েছে ছড়ানো আকাশের তারকায়,
সুরলোক-উর্বশী হে বসন্তসেনা! চিরচেনা॥
আঁখি তোলো দানো করুণা
আঁখি তোলো দানো করুণা
ওগো অরুণা!
মেলি নয়ন জীর্ণ কানন
করো তরুণা॥
আঁখি যে তোমার বনের পাখি
ঘুম সে ভাঙায় আঁধারে ডাকি,
আলোক-সাগর জাগাও বরুণা॥
তব আনত আঁখির পাতার কোলে
তরুণ আলোর মুকুল দোলে।
রঙের কুমার দুয়ারে জাগে
তোমার আঁখির প্রসাদ মাগে,
পাণ্ডুর ভোর হোক তরুণারুণা॥
আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার মনে
জয়জয়ন্তী মিশ্র দাদরা
আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার মনে।
দুলে গো আমার ঘুমে জাগরণে॥
হুতাশ-ভরা বাতাস বহে
আমার কানে কী কথা কহে,
দিনগুলি মোর যায় যে ঝরে
ঝরা পাতার সনে॥
গিয়াছে চলি, সুখের যাহারা ছিল গো সাথি,
গিয়াছে নিভে জ্বলিতেছিল যে শিয়রে বাতি।
স্মৃতির মালার ফুল শুকাইয়া
একে একে হায় পড়িছে ঝরিয়া,
বিদায়বেলার শুনি যে বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে॥
আগের মতো আমের ডালে বোল ধরেছে বউ
বসন্ত মিশ্র দাদরা
আগের মতো আমের ডালে
বোল ধরেছে বউ।
তুমিই শুধু বদলে গেছ
আগের মানুষ নও॥
তেমনি আজও তোমার নামে
উথলে মধু গোলাপ-জামে,
উঠল পুরে জামরুলে রস মহুল ফুলে মউ।
তুমিই শুধু বদলে গেছ, আগের মানুষ নও॥
ডালিম-দানায় রং লেগেছে, ডাঁসায় নোনা আতা,
তোমার পথে বিছায় ছায়া ছাতিম তরুর ছাতা।
তেমনি আজও নিমের ফুলে
ঝিম হয়ে ওই ভ্রমর দুলে,
হিজল-শাখায় কাঁদছে পাখি বউ গো কথা কও।
তুমি শুধু বদলে গেছ, আগের মানুষ নও॥
আজ নিশীথে অভিসার তোমার পথে প্রিয়তম
পিলু — খাম্বাজ কাহারবা
আজ নিশীথে অভিসার
তোমার পথে, প্রিয়তম।
বনের পারে নিরালায়
দিয়ো হে দেখা, নিরূপম॥
সুদূর নদীর ধারে জনহীন বালুচরে –
চখার তরে যথা একা চখি কেঁদে মরে,
সেথা সহসা আসিয়ো গোপন প্রিয়
স্বপনসম॥
তোমার আশায় ঘুরি শত গ্রহে শত লোকে,
ওগো আমার বিরহ জাগে বিরহী চাঁদের চোখে,
অকুল পাথার নিরাশার পারায়ে এসো
প্রাণে মম॥
আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে
বেহাগ মিশ্র দাদরা
আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে,
আধখানা চাঁদ নীচে
প্রিয়া তব মুখে ঝলকিছে।
গগনে জ্বলিছে অগণন তারা
দুটি তারা ধরণিতে
প্রিয়া তব চোখে চমকিছে॥
তড়িৎ-লতার ছিঁড়িয়া আধেকখানি
জড়িত তোমার জরিন ফিতায়, রানি।
অঝোরে ঝরিছে নীল নভে বারি,
দুইটি বিন্দু তারই
প্রিয়া তব আঁখি বরষিছে॥
কত ফুল ফোটে ঝরে উপবনে,
তারই মাঝে আছে ফুটি
তোমার অধরে গোলাপ-পাপড়ি দুটি।
মধুর কণ্ঠে বিহগ বিলাপ গাহে,
গান ভুলি তারা তব অঙ্গনে চাহে,
তাহারও অধিক সুমধুর সুর তব
চুড়ি কঙ্কণে ঝনকিছে॥
আধো-আধো বোল লাজে-বাধো-বাধো বোল
ভৈরবী-পিলু কাহারবা
আধো-আধো বোল
লাজে-বাধো-বাধো বোল
বলো কানে কানে।
যে কথাটি আধো রাতে
মনে লাগায় দোল –
বলো কানে কানে॥
যে কথার কলি সখী আজও ফুটিল না
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল –
বলো কানে কানে॥
যে কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে
না বলিতে যে কথাটি জানাজানি লোকে,
যে কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল –
লুকিয়ে বলো নিরালায় থামিলে কলরোল।
যে কথাটি বলিতে চাও বেশভূষার ছলে,
যে কথা দেয় বলে তব তনু পলে পলে,
যে কথাটি বলিতে সই গালে পড়ে টোল –
বলো কানে কানে॥
আমার প্রাণের দ্বারে ডাক দিয়ে কে যায়
বাউল লোফা
আমার প্রাণের দ্বারে ডাক দিয়ে কে যায়
বারেবারে।
তার নূপুর-ধ্বনি রিনিঝিনি বাজে
বন-পারে॥
নিঝুম রাতে ঘুমাই যবে
সে ডাকে আমায় বেণুর রবে,
স্বপন-কুমার আসে স্বপন-অভিসারে॥
যবে জল নিতে যাই নদীতটে একলা
নাম ধরে সে ডাকে,
ধরতে গেলে পালিয়ে সে যায়
বন-পথের বাঁকে।
বিশ্ববধূর মনোচোরা
ধরতে সে চায়, দেয় না ধরা,
আমি তারই স্বয়ংবরা
সঁপেছি প্রাণ তারে॥
আমি অলস উদাস আনমনা
মিশ্র মালবশ্রী দাদরা
আমি অলস উদাস আনমনা।
আমি সাঁঝ-আকাশে শান্ত নিথর
রঙিন মেঘের আলপনা॥
অলস যেমন বনের ছায়া,
নীড়ের পাখি শ্রান্ত-কায়া,
যেমন অলস তৃণের মুখে
ভোরের শিশির হিম-কণা॥
নদীর তীরে অলস রাখাল
একলা বসে রয় যেমন,
তেমনি অলস উদাস আমি
রই বসে রই অকারণ॥
যেমন অলস দিঘির জলে
থির হয়ে রয় কমল-দলে,
নিতল ঘুমে স্বপনসম
অলস আমি কল্পনা॥
আমি সুন্দর নহি জানি হে বন্ধু জানি
বেহাগ দাদরা
আমি সুন্দর নহি জানি হে বন্ধু জানি।
তুমি সুন্দর, তব গান গেয়ে
নিজেরে ধন্য মানি॥
আসিয়াছি সুন্দর ধরণিতে
সুন্দর যারা তাদেরে দেখিতে
রূপ-সুন্দর দেবতার পায়ে
অঞ্জলি দিই বাণী॥
রূপের তীর্থে তীর্থ-পথিক
যুগে যুগে আমি আসি
ওগো সুন্দর, বাজাইয়া যাই
তোমার নামের বাঁশি।
পরিয়া তোমার রূপ-অঞ্জন
ভুলেছে নয়ন, রাঙিয়াছে মন,
উছলি উঠুক মোর সংগীতে
সেই আনন্দখানি॥
আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব চলো আমার বাড়ি
ভাটিয়ালি কাহারবা
আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব
চলো আমার বাড়ি।
ওগো ভিনগেরামের নারী॥
সোনার ফুলের বাজু দেব চুড়ি বেলোয়ারি।
ওগো ভিনগেরামের নারী॥
বৈঁচি ফলের পৈঁচি দেব, কলমিলতার বালা,
গলায় দেব টাটকা-তোলা ভাঁট ফুলেরই মালা।
রক্ত-শালুক দিব পায়ে পরবে আলতা তারই।
ওগো ভিনগেরামের নারী॥
হলুদ-চাঁপার বরন কন্যা! এসো আমার নায়
সর্ষে ফুলের সোনার রেণু মাখাব ওই গায়।
ঠোঁটে দিব রাঙা পলাশ মহুয়া ফুলের মউ,
বকুল-ডালে ডাকবে পাখি, ‘বউ গো কথা কও!’
আমি সব দিব গো, যা পারি আর যা দিতে না পারি।
ওগো ভিনগেরামের নারী॥
উত্তরীয় লুটায় আমার
হৈমন্তী তেওড়া
উত্তরীয় লুটায় আমার –
ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।
আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে
নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়॥
ভাঁটির শীর্ণা নদীর কূলে
আমার রবি-ফসল দুলে,
নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর
চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়॥
এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়
বেহাগ মিশ্র কাওয়ালি
এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়
হেরিনু পল্লি-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে
ঝলমল করে লাবণি॥
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম-কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি॥
কেতকী কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা,
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থইথই করে শ্যামল শোভার নবনী॥
শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনি-গীতি গাহিয়া।
অঘ্রানে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনি॥
শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে, কীর্তন শোন রাতে মা।
ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণি॥
এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত
পরজ–বসন্ত তেতালা
এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,
চঞ্চল তরুণ দুরন্ত॥
বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
পরজ-বসন্তের সুর,
পাণ্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত॥
কিশলয়-পর্ণে অশান্ত
ওড়ে তার অঞ্চল-প্রান্ত,
পলাশ-কলিতে তার ফুলধনু লঘুভার
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত॥
এলোমেলো দখিনা মলয় রে
প্রলাপ বকিছে বনময় রে,
অকারণ মনোমাঝে বিরহের বেণু বাজে
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত॥
এল এল রে বৈশাখী ঝড়
ইমন মিশ্র কাহারবা
এল এল রে বৈশাখী ঝড়।
ওই বৈশাখী ঝড় এল এল মহীয়ান সুন্দর।
পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর, চরাচর, থরথর॥
ঘন বন-কুন্তলা বসুমতী
সভয়ে করে প্রণতি,
সভয়ে নত চরণে ভীতা বসুমতী।
সাগর-তরঙ্গ-মাঝে
তারই মঞ্জীর যেন বাজে,
বাজে রে পায়ে গিরি-নির্ঝর –
ঝরঝর ঝরঝর॥
ধূলি-গৈরিক নিশান দোলে
ঈশান-গগন-চুম্বী,
ডম্বরু ঝল্লরি ঝাঁঝর ঝনঝন বাজে,
এল ছন্দ বন্ধন-হারা
এল মরু-সঞ্চর,
বিজয়ী বীরবর॥
এল ফুল-দোল ওরে এল ফুল-দোল
ভৈরবী – পিলু কাওয়ালি
এল ফুল-দোল ওরে এল ফুল-দোল
আনো রং-ঝারি।
পলাশ-মঞ্জরি পরি অলকে
এসো গোপ-নারী॥
ঝরিছে আকাশে রঙের ঝরনা,
শ্যামা ধরণি হল আবির-বরনা,
ত্যজি গৃহ-কাজ এসো চল-চরণা
ডাকে গিরিধারী॥
পরাগ-আবির হানে বনবালা
সুরের পিচকারি হানিছে কুহু,
রঙিন স্বপন ঝরে রাতের ঘুমে
অনুরাগ-রং ঝরে
মনে মুহুমুহু।
রাঙে গিরি-মল্লিকা রঙিন বর্ণে,
রাতের আঁচল ভরে জোছনার স্বর্ণে,
কুলের কালি সখী দেবে ধুয়ে
রাঙা পিচকারি॥
এল শ্যামল কিশোর
কাজরি লাউনি
এল শ্যামল কিশোর,
তমাল-ডালে বাঁধো ঝুলনা।
সুনীল শাড়ি পরো ব্রজনারী
পরো নব নীপ-মালা অতুলনা।
তমাল-ডালে বাঁধো ঝুলনা॥
ডাগর চোখে কাজল দিয়ো,
আকাশি-রং পোরো উত্তরীয়,
নব-ঘন-শ্যামের বসিয়া বামে –
দুলে দুলে বোলো, ‘বঁধু, ভুলো না!’
তমাল-ডালে বাঁধো ঝুলনা॥
নৃত্য-মুখর আজি মেঘলা দুপুর,
বৃষ্টির নূপুর বাজে টুপুর টুপুর।
বাদল-মেঘের তালে বাজিছে বেণু,
পাণ্ডুর হল শ্যাম মাখি কেয়া-রেণু,
বাহুতে দোলনায় বাঁধিবে শ্যামরায়
বোলো, ‘হে শ্যাম, এ বাঁধন খুলো না!’
তমাল-ডালে বাঁধো ঝুলনা॥
এসো কল্যাণী চির-আয়ুষ্মতী
ভজন
এসো কল্যাণী, চির-আয়ুষ্মতী!
তব নির্মল করে জ্বালো ভবন-প্রদীপ
জ্বালো জ্বালো জ্বালো সতী॥
মঙ্গল-শঙ্খ বাজাও বাজাও অয়ি সুমঙ্গলা!
সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল করো দূর শুভ-সমুজ্জ্বলা!
এসো মাটির কুটিরে দূর আকাশের অরুন্ধতী॥
এসো লক্ষ্মী গৃহের, আঁকো অঙ্গনে সুমঙ্গল আলপনা,
তব পুণ্য-পরশ দিয়ে ধূলি-মুঠিরে করো গো সোনা।
তুমি দেবতার শুভ বর মূর্তিমতী॥
স্নান-শুদ্ধা তুমি পূজা-দেউলে যবে কর আরতি,
আনত আকাশ যেন তব চরণে করে প্রণতি।
তব কুণ্ঠিত গুণ্ঠন-তলে
চির-শান্তির ধ্রুবতারা জ্বলে,
সংসার-অরণ্যে ধ্যান-মগ্না তুমি তপতী স্নিগ্ধজ্যোতি॥
ও কালো বউ যেয়ো না আর যেয়ো না আর
পাহাড়ি কাহারবা
ও কালো বউ! যেয়ো না আর যেয়ো না আর
জল আনিতে বাজিয়ে মল।
তোমায় দেখে শিউরে ওঠে
কাজলা দিঘির কালো জল॥
দেখে তোমার কালো আঁখি
কালো কোকিল ওঠে ডাকি,
তোমার চোখের কাজল মাখি
হয় সজল ওই মেঘ-দল॥
তোমার কালো রূপের মায়া
দুপুর রোদে শীতল ছায়া,
কচি অশথ পাতায় টলে
ওই কালো রূপ টলমল॥
ভাদর মাসের ভরা ঝিলে
তোমার রূপের আদল মিলে,
তোমার তনুর নিবিড় নীলে
আকাশ করে ঝলমল॥
ওই কাজল-কালো চোখ
বেহাগ–খাম্বাজ দাদরা
ওই কাজল-কালো চোখ
আদি কবির আদি রসের
যেন দুটি শ্লোক।
ওই কাজল-কালো চোখ॥
পুষ্প-লতার পত্রপুটে
দুটি কুসুম আছে ফুটে,
সেই আলোকে রেঙে ওঠে
বনের গহন লোক (গো)
আমার মনের গহন লোক॥
রূপের সায়র সাঁতরে বেড়ায়
পানকৌড়ি পাখি
ওই কাজল-কালো আঁখি।
মদির আঁখির নীল পেয়ালায়
শরাব বিলাও নাকি,
মদালসা সাকি!
তারার মতো তন্দ্রাহারা
তোমার দুটি আঁখিতারা
আমার চোখে চেয়ে চেয়ে
অশ্রুসজল হোক॥
ওরে ও স্রোতের ফুল
যোগিয়া একতালা
ওরে ও স্রোতের ফুল!
ভেসে ভেসে হায় এলি অসহায়
কোথায় পথ-বেভুল॥
কোল খালি করে কোন লতিকার
নিভাইয়া নয়নের জ্যোতি কার,
বনের কুসুম অকূল পাথারে
খুঁজিয়া ফিরিস কূল॥
ভবনের স্নেহ নারিল রাখিতে
ঠেলে ফেলে দিল যারে,
সারা ভুবনের স্নেহ কি কখনও
তাহারে ধরিতে পারে?
জল নয়, তোর জননী যে ভুঁই,
অভিমানী! সেথা চল ফিরে তুই,
ধূলিতেও যদি ঝরিস সেথায়
স্বর্গ সেই অতুল॥
কলঙ্ক আর জোছনায়-মেশা তুমি সুন্দর চাঁদ
বেহাগ মিশ্র দাদরা
কলঙ্ক আর জোছনায়-মেশা
তুমি সুন্দর চাঁদ।
জাগালে জোয়ার ভাঙিলে আবার
সাগর-কূলের বাঁধ॥
তিথিতে তিথিতে সুদূর অতিথি
ভোলাও জাগাও ভুলে-যাওয়া স্মৃতি,
এড়াইতে গিয়ে পরানে জড়াই
তোমার রূপের ফাঁদ॥
চাহি না তোমায়, তবু তোমারেই
ভাবি বাতায়নে বসি,
আমার নিশীথে তুমিই এনেছ
শুক্লা চতুর্দশী।
সুন্দর তুমি, তবু ভয় মনে
আছে কলঙ্ক জ্যোছনার সনে,
মুখোমুখি বসে কাঁদি তাই বুকে
সাধ আর অবসাদ।
কাজরি গাহিয়া চলো গোপ-ললনা
কাজরি লাউনি
কাজরি গাহিয়া চলো গোপ-ললনা।
শ্রাবণ-গগনে দোলে মেঘ-দোলনা॥
পরো সবুজ ঘাগরি চোলি নীল ওড়না,
মাখো অধরে মধুর হাসি, চোখে ছলনা॥
কদম-চন্দ্রহার পরে এসো চন্দ্রাবলী,
তমাল-শাখা-বরনা এসো বিশাখা-শ্যামলী।
বাজায় করতাল দূরে তাল-বনা॥
লাবণি-বিগলিতা এসো সকরুণ ললিতা,
যমুনাকূলে এসো ব্রজবধূ কুল-ভীতা,
অলকে মাখিয়া নব জলকণা॥
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে
সিন্ধুড়া কাওয়ালি
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে, — চিনি চিনি।
প্রাণের মাঝে সদা শুনি তারই রাগিণী॥
চিনি চিনি॥
বন-শিরীষের জিরিজিরি পাতায়
ধীরি ধীরি ঝিরিঝিরি নূপুর বাজায়,
তমাল-ছায়ায় বেড়ায় ঘুরে মায়া-হরিণী॥
চিনি চিনি॥
আমার প্রাণে তারই চরণের অনুরণনে
ছন্দ জাগে গন্ধে রসে রূপে বরনে।
কান পেতে রই দুয়ার-পাশে
তারই আসার আভাস আসে,
ঝংকার তোলে মনের বীণায় বীণ-বাদিনী –
চিনি চিনি॥
কুঙ্কুম আবির ফাগের লয়ে থালিকা
কালাংড়া খেমটা
কুঙ্কুম আবির ফাগের
লয়ে থালিকা
খেলিছে ‘রসিয়া’ হোরি
ব্রজ-বালিকা॥
হোরির অনুরাগে
যমুনায় দোলা লাগে,
রাঙা কুসুম হানে
শ্যামে মাধবিকা॥
রঙের গাগরিতে,
রঙিলা ঘাগরিতে,
হোরির মাতন লাগায়
নাগর-নাগরিকা॥
জেগেছে রঙের নেশা
মাধবী মধু-মেশা,
মনের বনে দোলে
রাঙা ফুল-মালিকা॥
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি
হিন্দোল মিশ্র তেওড়া
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি।
আকাশ কাঁপে সে সুর শুনে সর্বনাশী॥
বন ঢেলে দেয় উজাড় করে
ফুলের ডালা চরণ পরে,
নীল গগনে ছুটে আসে মেঘের রাশি॥
বিপুল ঢেউয়ের নাগরদোলায় সাগর দুলে,
বান ডেকে যায় শীর্ণা নদীর কূলে কূলে।
তোমার প্রলয়-মহোৎসবে
বন্ধু ওগো, ডাকবে কবে?
ভাঙবে আমার ঘরের বাঁধন
কাঁদন হাসি॥
কে পরাল মুণ্ডমালা আমার শ্যামা মায়ের গলে
ভূপালি দাদরা
কে পরাল মুণ্ডমালা
আমার শ্যামা মায়ের গলে।
সহস্রদল জীবন-কমল
দোলে রে যাঁর চরণ-তলে॥
কে বলে মোর মা-কে কালো,
মায়ের হাসি দিনের আলো,
মায়ের আমার গায়ের জ্যোতি
গগন-পবন-জলে-স্থলে॥
শিবের বুকে চরণ যাঁহার
কেশব যাঁরে পায় না ধ্যানে,
শব নিয়ে সে রয় শ্মশানে
কে জানে কোন অভিমানে!
সৃষ্টিরে মা রয় আবরি,
সেই মা নাকি দিগম্বরী?
(তাঁরে) অসুরে কয় ভয়ংকরী
ভক্ত তাঁয় অভয়া বলে॥
কোয়েলা কুহু কুহু ডাকে
খাম্বাজ ঠুংরি
কোয়েলা কুহু কুহু ডাকে।
নব মুকুলিত আমের শাখে॥
যাহার দরশ লাগি
একেলা কুটিরে জাগি,
মোর সাথে পাখিও কি
ডাকিছে তাহাকে॥
চাঁদিনি নিভে যায় আমার চোখে,
চাঁদে মনে পড়ে চাঁদের আলোকে।
কুহু স্বর প্রাণে মম
বাজিতেছে তার সম,
চাঁদিনি নিশীথ মোর
বিষাদ-মেঘে ঢাকে॥
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
(গ্রীষ্ম)
কামোদ–শ্রী দাদরা
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
তপ্ত গগনে জাগি।
রুদ্র তাপস সন্ন্যাসী বৈরাগী॥
সহসা কখন বৈকালি ঝড়ে
পিঙ্গল মম জটা খুলে পড়ে,
যোগী শংকর প্রলয়ংকর
জাগে চিত্তে ধেয়ান ভাঙি॥
শুষ্ক কণ্ঠে শ্রান্ত ফটিকজল,
ক্লান্ত কপোত কাঁদায় কাননতল,
চরণে লুটায় তৃষিতা ধরণি
আমার শরণ মাগি॥
ঘুমাও ঘুমাও দেখিতে এসেছি
যোগিয়া মিশ্র দাদরা
ঘুমাও, ঘুমাও! দেখিতে এসেছি,
ভাঙিতে আসিনি ঘুম।
কেউ জেগে কাঁদে, কারও চোখে নামে
নিদালির মরশুম॥
দেখিতে এলাম হয়ে কুতূহলি
চাঁপা ফুল দিয়ে তৈরি পুতলি,
দেখি, শয্যায় স্তূপ হয়ে আছে
জ্যোৎস্নার কুঙ্কুম।
আমি নয়, ওই কলঙ্কী চাঁদ
নয়নে হেনেছে চুম॥
রাগ করিয়ো না, অনুরাগ হতে
রাগ আরও ভালো লাগে,
তৃষ্ণাতুরের কেউ জল চায়
কেউ বা শিরাজি মাগে!
মনে কর, আমি ফুলের সুবাস,
চোর জ্যোৎস্না, লোলুপ বাতাস,
ইহাদের সাথে চলে যাব প্রাতে
অগোচর নিঝঝুম॥
চম্পা পারুল যূথী টগর চামেলা
কালাংড়া খেমটা
চম্পা পারুল যূথী টগর চামেলা।
আর সই সইতে নারি ফুল-ঝামেলা॥
সাজায়ে বন-ডালি
বসে রই বনমালী
যারে দিই এ ফুল সেই হানে হেলাফেলা॥
কে তুমি মায়ামৃগ
রতির সতিনি গো?
ফুল নিতে আসিলে এ বনে অবেলা॥
ফুলের সাথে প্রিয়
ফুল-মালীরে নিয়ো,
তুমিও একা সই, আমিও একেলা॥
চল রে চপল তরুণ-দল বাঁধন-হারা
চল রে চপল তরুণ-দল বাঁধন-হারা।
চল অমর সমরে, চল ভাঙি কারা
জাগায়ে কাননে নব পথের ইশারা॥
প্রাণ-স্রোতের ত্রিধারা বহায়ে তোরা
ওরে চল!
জোয়ার আনি মরা নদীতে
পাহাড় টলায়ে মাতোয়ারা॥
ডাকে তোরে স্নেহভরে
‘ওরে ফিরে আয় ফিরে ঘরে!’
তারে ভোল ওরে ভোল
তোরা যে ঘর-ছাড়া॥
তাজা প্রাণের মঞ্জরি ফুটায়ে পথে
তোরা চল,
রহে কে ভুলি ছেঁড়া পুথিতে
তাদের পরানে দে রে সাড়া॥
রণ-মাদল আকাশে ঘন বাজে গুরুগুরু।
আঁধার ঘরে কে আছে পড়ে
তাদের দুয়ারে দে রে নাড়া॥
চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল চন্দ্রমল্লিকা
ভৈরবী দাদরা
চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল চন্দ্রমল্লিকা॥
রং-পরিদের সঙ্গিনী তুই,
অঙ্গে চাঁদের রূপ-শিখা॥
ঊষর ধরায় আসলি ভুলে
তুষার দেশের রঙ্গিণী,
হিমেল দেশের চন্দ্রিকা তুই
শীত-শেষের বাসন্তিকা॥
চাঁদের আলো চুরি করে
আনলি তুই মুঠি ভরে,
দিলাম চন্দ্র-মল্লিকা নাম,
তাই তোরে আদর করে।
ভঙ্গিমা তোর গরব-ভরা,
রঙ্গিমা তোর হৃদয়-হরা,
ফুলের দলে ফুলরানি তুই
তোরেই দিলাম জয়টিকা॥
জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা
মিশ্র সুর একতালা
জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা।
স্বর্গাদপি গরীয়সী স্বদেশ আমার ভারত-মাতা॥
তোমার স্নেহ যায় বয়ে মা শত ধারায় নদীর স্রোতে,
ঘরে ঘরে সোনার ফসল ছড়িয়ে পড়ে আঁচল হতে,
স্নিগ্ধছায়া মাটির বুকে তোমার শীতলপাটি পাতা॥
স্বর্গের ঐশ্বর্য লুটায় তোমার ধূলি-মাখা পথে,
তোমার ঘরে নাই যাহা মা, নাইকো তাহা ভূ-ভারতে।
ঊর্ধ্বে আকাশ নিম্নে সাগর গাহে তোমার বিজয়-গাথা॥
আদি জগদ্ধাত্রী তুমি জগতেরে প্রথম প্রাতে
শিক্ষা দিলে দীক্ষা দিলে করলে মানুষ আপন হাতে।
তোমার কোলের লোভে মাগো রূপ ধরে আসেন বিধাতা॥
ছেলের মুখের অন্ন কেড়ে খাওয়ালি মা যাদের ডেকে,
তারাই দিল তোর ললাটে চির-দাসীর তিলক এঁকে,
দেখে শুনে হয় মা মনে নেইকো বিচার, নেই বিধাতা॥
জাগো জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্ম-ধারী
ভৈরবী দাদরা
জাগো জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্ম-ধারী।
জাগো শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণা-তিথির তিমির অপসারি॥
ডাকে বসুদেব দেবকী ডাকে,
ঘরে ঘরে, নারায়ণ, তোমাকে!
ডাকে বলরাম শ্রীদাম সুদাম
ডাকিছে যমুনা-বারি॥
হরি হে, তোমায় সজল নেত্রে
ডাকে পাণ্ডব কুরুক্ষেত্রে!
দুঃশাসন সভায় দ্রৌপদী
ডাকিছে লজ্জাহারী॥
মহাভারতের হে মহাদেবতা
জাগো জাগো, আনো আলোক-বারতা!
ডাকিছে গীতার শ্লোক অনাগতা
বিশ্বের নর-নারী॥
জাগো দুস্তর পথের নব যাত্রী
মার্চের সুর
জাগো দুস্তর পথের নব যাত্রী
জাগো জাগো!
ওই পোহাল তিমির রাত্রি।
জাগো জাগো॥
দ্রিম দ্রিম দ্রিম রণ-ডঙ্কা
শোনো বলে,
নাহি শঙ্কা!
আমাদের সঙ্গে নাচে রণ-রঙ্গে
দনুজদলনী বরাভয়দাত্রী॥
অসম্ভবের পথে আমাদের অভিযান,
যুগে যুগে করি মোরা মানুষেরে মহীয়ান।
আমরা সৃজিয়া যাই
নূতন যুগ ভাই,
আমরা নবতম ভারত-বিধাত্রী॥
সাগরে শঙ্খ ঘন ঘন বাজে,
রণ-অঙ্গনে চলো কুচকাওয়াজে
বজ্রের আলোকে মৃত্যুর মুখে
দাঁড়াব নির্ভীক উগ্র সুখে।
ভারত-রক্ষী মোরা নব সান্ত্রি॥
ঝরাফুল-বিছানো পথে
পিলু লাউনি
ঝরাফুল-বিছানো পথে
এসো বিজনবাসিনী।
জ্যোৎস্নায় ছড়ায়ে হাসি
এসো সুচারুহাসিনী॥
এসো জড়ায়ে তব তনুতে
গোধূলি রামধনুতে
পাপিয়া-পিক-কূজনে
গাহিয়া মধুভাষিণী॥
ছন্দ-দোদুল গতি
এসো নোটন কপোতী,
বহায়ে মনের মরুতে
আনন্দ-মন্দাকিনী॥
ঝরে বারি গগনে ঝুরুঝুরু
দেশ তেতালা
ঝরে বারি গগনে ঝুরুঝুরু।
জাগি একা ভয়ে ভয়ে
নিদ নাহি আসে,
ভীরু হিয়া কাঁপে দুরুদুরু॥
দামিনী ঝলকে, ঝনকে ঘোর পবন
ঝরে ঝরঝর নীল ঘন।
রহি রহি দূরে কে যেন কৃষ্ণা মেয়ে
মেঘ পানে ঘন হানে ভুরু॥
অতল তিমিরে বাদলের বায়ে
জীর্ণ কুটিরে জাগি দীপ নিভায়ে।
ঘন দেয়া ডাকে গুরুগুরু॥
ঝড়-ঝঞ্ঝায় ওড়ে নিশান ঘন-বজ্রে বিষাণ বাজে
মার্চ সংগীত
ঝড়-ঝঞ্ঝায় ওড়ে নিশান ঘন-বজ্রে বিষাণ বাজে।
জাগো জাগো তন্দ্রা-অলস রে, সাজো সাজো রণ-সাজে॥
দিকে দিকে ওঠে গান, অভিযান অভিযান!
আগুয়ান আগুয়ান হও ওরে আগুয়ান
ফুটায়ে মরুতে ফুল-ফসল।
জড়ের মতন বেঁচে কী ফল?
কে রবি পড়ে লাজে॥
বহে স্রোত জীবন-নদীর
চল চঞ্চল অধীর,
তাহে ভাসিবি কে আয়,
দূর সাগর ডেকে যায়।
হবি মৃত্যু-পাথার পার
সেথা অনন্ত প্রাণ বিরাজে॥
পাঁওদল রণে চল, চল রণে চল
মরুতে ফুটাতে পারে ওই পদতল
প্রাণ–শতদল।
বিঘ্ন-বিপদে করি সহায়
না-জানা-পথের যাত্রী আয়,
স্থান দিতে হবে আজি সবায়
বিশ্ব-সভা-মাঝে॥
ডেকো না আর দূরের প্রিয়া
ভীমপলশ্রী মিশ্র দাদরা
ডেকো না আর দূরের প্রিয়া
থাকিতে দাও নিরালা।
কী হবে হায় বিদায় – বেলায়
এনে সুধার পিয়ালা॥
সুখের দেশের পাখি তুমি
কেন এলে এ বনে,
আজ এ বনে জাগে শুধু
কণ্টকের স্মৃতির জ্বালা॥
মরুর বুকে কী ঘোর তৃষা
বুঝিবে কি মেঘ-পরি,
মিটিবে না আমার তৃষা
ওই আঁখি-জলে বালা।
আঁধার ঘরের আলো তুমি
আমি রাতের আলেয়া,
ভোলো আমায় চিরতরে,
ফিরিয়া নাও এ ফুলমালা॥
তব যাবার বেলা বলে যাও মনের কথা
বারোয়াঁ লাউনি
তব যাবার বেলা বলে যাও মনের কথা।
কেন কহিতে এসে চলে যাও চাপিয়া ব্যথা॥
কেন এনেছিলে ফুল আঁচলে দিতে কাহারে,
কেন মলিন ধূলায় ছড়ালে সে ফুল অযথা॥
পরি খয়েরি শাড়ি আসিলে সাঁঝের আঁধারে
ও কি ভুল সবই ভুল, নয়নের ও বিহ্বলতা॥
তুমি পুতুল লয়ে খেলেছ বালিকা-বেলা,
বুঝি আমারে লয়ে তেমনই খেলিলে খেলা।
তব নয়নের জল সে কি ছল, জানাইয়া যাও,
এই ভুল ভেঙে দাও, সহে না এ নীরবতা॥
তরুণ অশান্ত কে বিরহী
চাঁদনি কেদারা ত্রিতাল
তরুণ অশান্ত কে বিরহী।
নিবিড় তমসায় ঘন ঘোর বরষায়
দ্বারে হানিছ কর রহি রহি॥
ছিন্ন-পাখা কাঁদে মেঘ-বলাকা,
কাঁদে ঘোর অরণ্য আহত-শাখা,
চোখে আশা-বিদ্যুৎ এলে কোন মেঘদূত,
বিধুর বঁধুর মোর বারতা বহি॥
নয়নের জলে হেরিতে না পারি
বাহিরে গগনে ঝরে কত বারি।
বন্ধ কুটিরে অন্ধ তিমিরে
চেয়ে আছি কাহার পথ চাহি।
বন্ধু গো, ওগো ঝড়, ভাঙো ভাঙো দ্বার,
তব সাথে আজি নব অভিসার,
ঝরা-পল্লব-প্রায় তুলিয়া লহো আমায়
অশান্ত ও-বক্ষে হে বিদ্রোহী॥
তরুণ-তমাল-বরন এসো শ্যামল আমার
কাফি মিশ্র ঠুংরি
তরুণ-তমাল-বরন এসো শ্যামল আমার।
ঘনশ্যাম-তুলি বুলায়ে মেঘ-দলে
এসো দুলায়ে আঁধার॥
কাঁদে নিশীথিনী তিমির-কুন্তলা
আমারই মতো সে উতলা,
এসো তরুণ দুরন্ত ভাঙি হৃদয়-দুয়ার॥
তপ্ত গগনে ঘনায়ে ঘন দেয়া,
ফুটায়ে কদম-কেয়া,
আমার নয়ন-যমুনায় এসো জাগায়ে জোয়ার॥
তুমি ভোরের শিশির রাতের নয়ন-পাতে
ভৈরবী দাদরা
তুমি ভোরের শিশির রাতের নয়ন-পাতে।
তুমি কান্না পাওয়াও কাননকে গো
ফুল-ঝরা প্রভাতে॥
তুমি ভৈরবী সুব উদাস বিধুর,
অতীত দিনের স্মৃতি সুদূর,
তুমি ফোটার আগের ঝরা মুকুল
বৈশাখী হাওয়াতে॥
তুমি কাশের ফুলের করুণ হাসি
মরা নদীর চরে,
তুমি শ্বেত-বসনা অশ্রুমতী
উৎসব-বাসরে।
তুমি মরুর বুকে পথ-হারা
গোপন ব্যথার ফল্গুধারা,
তুমি নীরব বীণা বাণীহীনা
সংগীত-সভাতে।
তোমার হাতের সোনার রাখি
ভৈরবী কাহারবা
তোমার হাতের সোনার রাখি
আমার হাতে পরালে।
আমার বিফল বনের কুসুম
তোমার পায়ে ঝরালে॥
খুঁজেছি তোমায় তারার চোখে
কত সে গ্রহে কত সে লোকে,
আজ এ তৃষিত মরুর আকাশ
বাদল-মেঘে ভরালে॥
দূর অভিমানের স্মৃতি
কাঁদায় কেন আজি গো,
মিলন-বাঁশি সহসা ওঠে
ভৈরবীতে বাজি গো!
হেনেছ হেলা, দিয়েছ ব্যথা,
মনে কেন আজ পড়ে সে কথা,
মরণ-বেলায় কেন এ গলায়
মালার মতন জড়ালে॥
তোর রূপে সই গাহন করি জুড়িয়ে গেল গা
ভাটিয়ালি কাহারবা
তোর রূপে সই গাহন করি জুড়িয়ে গেল গা।
তোর গাঁয়েরই নদীর ঘাটে বাঁধলাম এ মোর না॥
তোর চরণের আলতা লেগে
পরান আমার উঠল রেঙে,
তোর বাউরি-কেশের বিনুনিতে জড়িয়ে গেল পা॥
তোর বাঁকা ভুরু বাঁকা আঁখি বাঁকা চলন, সই,
দেখে পটে-আঁকা-ছবির মতন দাঁড়িয়ে পথে রই।
উড়ে এলি দেশান্তরী
তুই কি ডানাকাটা পরি?
তুই শুকতারাই সতিনি সই, সন্ধ্যাতারার জা॥
দশ হাতে ওই দশ দিকে মা
ভৈরবী মিশ্র দাদরা
(আগমনি)
দশ হাতে ওই দশ দিকে মা
ছড়িয়ে এল আনন্দ।
ঘরে ফেরার বাজল বাঁশি
বইছে বাতাস সুমন্দ।
আনন্দ রে আনন্দ॥
আমার মায়ের মুখের হাসি
শরৎ-আলোর কিরণরাশি
কমল-বনে উঠছে ভাসি
মায়ের গায়ের সুগন্ধ।
আনন্দ রে আনন্দ॥
উঠছে বেজে দিগ্বিদিকে ছুটির মাদল মৃদঙ্গ,
মনের আজি নাই ঠিকানা, যেন বনের কুরঙ্গ।
দেশান্তরী ছেলেমেয়ে
মায়ের কোলে এল ধেয়ে,
শিশির-নীরে এল নেয়ে
স্নিগ্ধ অকাল-বসন্ত।
আনন্দ রে আনন্দ॥
দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ দাও দাও প্রাণ
ভজন
দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ
দাও দাও প্রাণ।
দাও অমৃত মৃত-জনে
দাও ভীত-চিত জনে শক্তি অপরিমাণ
হে সর্বশক্তিমান॥
দাও স্বাস্থ্য দাও আয়ু
স্বচ্ছ আলো মুক্ত বায়ু,
দাও চিত্ত অ-নিরুদ্ধ দাও শুদ্ধ জ্ঞান
হে সর্বশক্তিমান॥
দাও দেহে দিব্যকান্তি
দাও গেহে নিত্য শান্তি,
দাও পুণ্য প্রেম ভক্তি মঙ্গল-কল্যাণ।
হে সর্বশক্তিমান॥
ভীতি-নিষেধের ঊর্ধ্বে স্থির
রহি যেন চির-উন্নত শির,
যাহা চাই যেন জয় করে পাই
গ্রহণ না করি দান
হে সর্বশক্তিমান॥
দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি
‘কিউবান ডান্সের’ সুর
দূর দ্বীপবাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি।
দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনি গো,
সুমন্দভাষিণী॥
প্রশান্ত সাগরে
তুফানে ও ঝড়ে
শুনেছি তোমারই অশান্ত রাগিণী॥
বাজাও কি বুনো সুর
পাহাড়ি বাঁশিতে?
বনান্ত ছেয়ে যায়
বাসন্তী হাসিতে।
তব কবরীমূলে
নব এলাচির ফুল
দুলে কুসুম-বিলাসিনী॥
দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে
যোগিয়া আদ্ধা কাওয়ালি
দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে
আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।
শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের
গন্ধে কেন কান্না পায়?
সন্ধ্যাবেলার পাখির সম
মন উড়ে যায় নীড় পানে।
নয়ন-জলের মালা গাঁথে
বিরহিণী একলা, হায়।
কোন সুদূরে নওবতে কার
বাজে সানাই যোগিয়ায়,
টলমল টলিছে মন
কমল-পাতে শিশির-প্রায়।
ফেরেনি আজ ঘরে কে হায়
ঘরে যে আর ফিরবে না,
কেঁদে কেঁদে তারেই যেন
ডাকে বাঁশি, ‘ফিরে আয়!
দেখে যা-রে রুদ্রাণী মা
আনন্দ-ভৈরবী দাদরা
দেখে যা-রে রুদ্রাণী মা
হয়েছে আজ ভদ্রকালী।
শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে
শ্মশান-মাঝে শিব-দুলালি॥
আজ শান্ত সিন্ধুতে রে
অশান্ত ঝড় থেমেছে রে,
মা-র কালো রূপ উপচে পড়ে
ছাপিয়ে ভুবন গগন-ডালি॥
আজ অভয়ার ওষ্ঠে জাগে
শুভ্র করুণ শান্ত হাসি,
আনন্দে তাই বিষাণ ফেলে
মহেন্দ্র ওই বাজায় বাঁশি।
ঘুমিয়ে আছে বিশ্ব-ভুবন
মায়ের কোলে শিশুর মতন,
পায়ের লোভে মনের বনে –
ফুল ফুটেছে পাঁচমিশালি॥
দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা
ভূপালি মিশ্র কাহারবা
দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা।
সকাল সাঁঝে সকল কাজে জপি সে নাম নিরালা॥
সেই নাম বসন-ভূষণ আমারই,
সেই নামে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারি,
সেই নাম লয়ে বেড়াই কেঁদে
সেই নামে আবার জুড়াই জ্বালা॥
সেই নামেরই নামাবলি গ্রহ-তারা রবি-শশী,
দোলে গগন-কোলে।
মধুর সেই নাম প্রাণে সদা বাজে,
মন লাগে না সংসার-কাজে,
সে নামে সদা মন মাতোয়ালা॥
আদর-সোহাগ মান-অভিমান আপন মনে
তার সাথে,
কাঁদায়ে কাঁদি, পায়ে ধরে সাধি,
কভু করি পূজা, কভু বুকে বাঁধি,
আমার স্বামী সে ভুবন-উজলা॥
না-ই পরিলে নোটন খোঁপায়
বেহাগ – খাম্বাজ দাদরা
না-ই পরিলে নোটন খোঁপায়
ঝুমকো-জবার ফুল।
এমনি এসো লুটিয়ে পিঠে
আকুল এলোচুল॥
সজ্জা-বিহীন লজ্জা নিয়ে
এমনি তুমি এসো প্রিয়ে,
গোলাপ ফুলে রং মাখাতে
হয় যদি হোক ভুল॥
গৌর দেহে না-ই জড়ালে
গৌরী-চাঁপা শাড়ি,
ভূষণ পরে না-ই বা দিলে
রূপের সাথে আড়ি।
যেমন আছ তেমনি এসো,
নয়ন তুলে ঈষৎ হেসো,
সেই খুশিতে উঠবে দুলে
আমার হৃদয়-কূল॥
নাচে নাচে রে মোর কালো মেয়ে
নটনারায়ণ তেওড়া
নাচে নাচে রে মোর কালো মেয়ে
নৃত্যকালী শ্যামা নাচে।
নাচ হেরে তার নটরাজও
পড়ে আছে পায়ের কাছে॥
মুক্তকেশী আদুল গায়ে
নেচে বেড়ায় চপল পায়ে
মার চরণে গ্রহতারা নূপুর হয়ে জড়িয়ে আছে॥
ছন্দ-সরস্বতী দোলে পুতুল হয়ে মায়ের কোলে
সৃষ্টি নাচে, নাচে প্রলয়, মায়ের আমার পায়ের তলে রে।
আকাশ কাঁপে নাচের ঘোরে
ঢেউ খেলে যায় সাত সাগরে
সেই নাচনের পুলক দোলে
ফুল হয়ে রে লতায় গাছে॥
নিরুদ্দেশের পথে আমি হারিয়ে যদি যাই
কানাড়া একতালা
নিরুদ্দেশের পথে আমি হারিয়ে যদি যাই
হে প্রিয়তম
নিত্য নূতন রূপে আবার আসব এই হেথাই॥
চাঁদনি রাতে বাতায়নে রইবে চেয়ে উদাস মনে,
বলব আমি, ‘হারাইনি গো, নাই ভাবনা নাই;
আকাশ-লোকে তারার চোখে তোমার পানে চাই।’
সাঁঝ সকালে জল নিতে যাও যে বনপথ বেয়ে –
ঝরা মুকুল হয়ে আমি সে পথ দেব ছেয়ে।
বাতাস হয়ে লহর তুলে ঘোমটা মুখের দেব খুলে,
বলবে হেসে, ‘হায় কালা-মুখ, তোমার মরণ নাই?’
সত্যি, আমার নাই তো মরণ তোমায় ভালোবেসে,
তোমায় আরও পাবার আশায় এলাম নিরুদ্দেশে।
কাছে কাছে ছিলাম বলে
ভুলতে আমায় পলে পলে,
শয়ন-সাথে নাই বলে আজ নয়ন-পাতে পাই।
বাহির ছেড়ে আজ পেয়েছি অন্তরেতে ঠাঁই॥
নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না
ভৈরবী দাদরা
নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না
দীপ নিভিতে দাও।
নিবু-নিবু প্রদীপ নিবুক হে পথিক
ক্ষণিক থাকিয়া যাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
আজও শুকায়নি মালার গোলাপ,
আশা-ময়ূরী মেলেনি কলাপ,
বাতাসে এখনও জড়ানো প্রলাপ,
বারেক ফিরিয়া চাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
ঢুলিয়া পড়িতে দাও ঘুমে অলস আঁখি
ক্লান্ত করুণ কায়,
সুদূর নহবতে বাঁশরি বাজিতে দাও
উদাস যোগিয়ায়।
হে প্রিয়, প্রভাতে তব রাঙা পায়
বকুল ঝরিয়া মরিতে চায়,
তব হাসির আভায় তরুণ অরুণ-প্রায়
দিক রাঙিয়ে যাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
ভৈরবী কাহারবা
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই॥
পরি চাঁপা রঙের শাড়ি, খয়েরি টিপ,
জাগি বাতায়নে, জ্বালি আঁখি-প্রদীপ,
মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই॥
তুমি আসিবে বলে সুদূর অতিথি
জাগে চাঁদের তৃষ্ণা লয়ে কৃষ্ণা-তিথি,
কভু ঘরে আসি কভু বাহিরে চাই॥
আজি আকাশে বাতাসে কানাকানি
জাগে বনে বনে নব ফুলের বাণী,
আজি আমার কথা যেন বলিতে পাই॥
ফিরে ফিরে কেন তারই স্মৃতি
ভৈরবী কাহারবা
ফিরে ফিরে কেন তারই স্মৃতি
মোরে কাঁদায় নিতি
যে ফিরিবে না আর।
ফিরায়েছি যায় কাঁদাইয়া হা
সে কেন কাঁদায় মোরে বারেবার॥
তারই দেওয়া ফুলমালা যত দলিয়াছি পায়
সেই ছিন্নমালা কুড়ায়ে নিরালা
আজি রাখি হিয়ায়।
বারেবারে ডাকি প্রিয় নাম ধরে তার॥
হানি অবহেলা যারে দিয়াছি বিদায়
আজি তারেই খুঁজি, সে কোথায় সে কোথায়।
জ্বালি নয়ন-প্রদীপ জাগি বাতায়নে,
নিশি ভোর হয়ে যায় বৃথা জাগরণে,
আজি স্বর্গ শূন্য মোর তার বিহনে,
কাঁদি আকাশ বাতাস মোর করে হাহাকার॥
ফুলের মতন ফুল্ল মুখে দেখছি এ কী ভুল
আশাবরি দাদরা
ফুলের মতন ফুল্ল মুখে
দেখছি এ কী ভুল।
হাসির বদল দুলছে সেথায়
অশ্রুকণার দুল॥
রোদের দাহে বালুচরে
মরা নদী কেঁদে মরে,
গাইতে এসে কাঁদছে বসে
বান-বেঁধা বুলবুল॥
ভোর গগনে পূর্ণ চাঁদের
এমনি মলিন মুখ,
ঝড়ের কোলে এমনি দোলে
প্রদীপশিখার বুক।
ম্লান-মাধুরী মালার ফুলে
এমনি নীরব কান্না দুলে,
করুণ তুমি বিসর্জনের
দেবীর সমতুল॥
বকুল-বনের পাখি
খাম্বাজ মিশ্র ঠুংরি
বকুল-বনের পাখি
ডাকিয়া আর ভেঙো না ঘুম।
বকুলবাগানে মম,
ফুরায়েছে ফুলের মরশুম॥
চাঁদের নয়নে চাহি
জাগে না আর সে নেশা,
চাঁপার সুরভি-সুরায়
বিরস বিরহ-মেশা।
আজি মোর জাগার সাথি
একাকিনী নিশীথ নিঝুম॥
পিয়া মোর দূর বিদেশে, —
কারে আর ডাকিছ পাখি
শুকায়ে গিয়াছে হাতে
মালতী-মালার রাখি।
নিভিয়া গিয়াছে প্রদীপ
রেখে গেছে মলিন ধূম॥
বনে মোর ফুল-ঝরার বেলা
হাম্বির মিশ্র কাহারবা
বনে মোর ফুল-ঝরার বেলা
জাগিল এ কী চঞ্চলতা। (অবেলায়)
এল ওই শুকনো ডালে ডালে
কোন অতিথির ফুল-বারতা॥ (এল ওই)
বিদায়-নেওয়া কুহু সহসা এল ফিরে
জোয়ার ওঠে দুলে, মরা নদীর তীরে,
শীতের বনে বহে দখিনা হাওয়া ধীরে
জাগায়ে বিধুর মধুর ব্যথা॥ (পরানে)
বেল-কুঁড়ির মালা পরে তেমনি করে
কৈশোরের প্রিয়া এল কী রূপ ধরে!
হারানো সুর আজি কণ্ঠে ওঠে ভরে,
লাজ ভুলে বধূ কহিল কথা॥ (বাসরে)
রুদ্ধ বাতায়ন খুলে দে, চেয়ে দেখি –
হেনার মঞ্জরি আবার ফুটেছে কি?
হারানো মানসী ফিরেছে লয়ে কি
গত বসন্তের বিহ্বলতা॥
বরষা ওই এল বরষা
মেঘমল্লার তেতালা
বরষা ওই এল বরষা।
অঝোর ধারায় জল ঝরঝরি অবিরল
ধূসর নীরস ধরা হল সরসা।
ঘন দেয়া দমকে দামিনী চমকে
ঝঞ্ঝার ঝাঁঝর ঝমঝম ঝমকে,
মনে পড়ে সুদূর মোর প্রিয়তমকে
মরাল মরালীরে হেরি সহসা॥
বেণু-বনে মৃদু মিঠে আওয়াজে
টাপুর টাপুর জল-নূপুর বাজে।
শূন্য শয্যাতলে আনমনে শুনি
সেই নূপুরের ধ্বনি অন্তরমাঝে।
শ্যামসখারে মেঘমল্লারে
ডাকি বারেবারে তন্দ্রালসা॥
বল রে তোরা বল ওরে ও আকাশ-ভরা তারা
খাম্বাজ দাদরা
বল রে তোরা বল ওরে ও আকাশ-ভরা তারা!
আমার নয়ন-তারা কোথায়, কোথায় হল হারা?
দৃষ্টিতে তার বৃষ্টি হত তোদের অধিক আলো,
আঁধার করে আমার ভুবন কোথায় সে লুকাল?
হাতড়ে ফিরি আকাশ-ভুবন পাইনে তাহার সাড়া॥
খানিক আগে মানিক আমার ছিল রে এই চোখে,
আলোর কুঁড়ি পড়ল ঝরে কোন সে গহন-লোকে।
বলিস তোর আলোর রাজায়
তাঁহার অসীম আলোক-সভায়
কম হত কি আলো, আমার আঁখির আলো ছাড়া॥
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল
পিলু — খাম্বাজ কাহারবা
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল।
মোর মুখে কেন চায় আঁখি-ছলছল,
ওরে সরে যেতে বল॥
পথে যেতে কাঁপে গা
শরমে জড়ায় পা,
মনে হয় সারা পথ হয়েছে পিছল।
ওরে সরে যেতে বল॥
জল নিতে গিয়ে সই
ওর চোখে চেয়ে রই,
শান-বাঁধা ঘাট যেন কাঁপে টলমল।
ওরে সরে যেতে বল॥
প্রথম বিরহ মোর
চায় কি ও চিত-চোর?
চাঁদনি চৈতি রাতে আনে সে বাদল।
ওরে সরে যেতে বল॥
বল্লরি-ভুজ-বন্ধন খোলো
বল্লরি-ভুজ-বন্ধন খোলো!
অভিসার-নিশি অবসান হল॥
পাণ্ডুর চাঁদ হেরো অস্তাচলে
জাগিয়া শ্রান্ত-তনু পড়েছে ঢলে,
মিলনের মালা ম্লান বক্ষতলে,
অভিমান-অবনত আঁখি তোলো॥
উতল সমীর আমি ক্ষণিকের ভুল,
কুসুম ঝরাই আমি ফোটাই মুকুল।
আলোকে শুকায় মোর প্রেমের শিশির,
দিনের বিরহ আমি মিলন নিশির,
হে প্রিয় ভীরু এ স্বপন-বিলাসীর
অকরুণ প্রণয় ভোলো ভোলো॥
বাদল-মেঘের মাদল তালে
সারং মিশ্র কাওয়ালি
বাদল-মেঘের মাদল তালে
ময়ূর নাচে দুলে দুলে।
আকাশে নাচে মেঘের পরি
বিজলি-জরিন ফিতা পড়ে খুলে॥
কদম্ব-ডালে ঝুলনিয়া ঝুলায়ে,
বনের বেণি কেয়াফুল দুলায়ে,
তাল-তমাল-বনে কাজল বুলায়ে
বর্ষারানি নাচে এলোচুলে॥
তরঙ্গ-রঙ্গে নাচে নটিনি,
ভরা যৌবন ভাদর-তটিনী,
পরি ফুলমালা নাচে বনবালা
সবুজ সুধার লহর তুলে॥
বীরদল আগে চল
মার্চের সুর
বীরদল আগে চল
কাঁপাইয়া পদভারে ধরণি টলমল।
যৌবন-সুন্দর চিরচঞ্চল॥
আয় ওরে আয় তালে তালে পায়ে পায়ে
আশা জাগায়ে নিরাশায়।
আয় ওরে আয় প্রাণহীন মরুভূমে
আয় নেমে বন্যার ঢল॥
ঝঞ্ঝায় বাজে রণ-মাদল
চল চল
ভোল ভোল জননীর স্নেহ-অঞ্চল॥
ডাকে বিধুর প্রিয়া সুদূর
ভোল তারে ডাকে তোরে তূর্য-সুর।
দল দল পায় ভয়-ভাবনায়
শ্মশানে জাগা প্রাণ
আপন-ভোলা পাগল॥
বুনো ফুলের করুণ সুবাস ঝুরে
জয়জয়ন্তী একতালা
বুনো ফুলের করুণ সুবাস ঝুরে
নাম-না-জানা গানের পাখি, তোমার গানের সুরে॥
জানাতে হায় এলে কোথা
বনের ছায়ার মনের ব্যথা,
তরুর স্নেহ ফেলে এলে মরুর বুকে উড়ে॥
এলে চাঁদের তৃষ্ণা নিয়ে কৃষ্ণা তিথির রাতে,
পাতার বাসা ফেলে এলে সজল নয়ন-পাতে।
ওরে পাখি, তোর সাথে হায়
উড়তে নারি দূর অলকায়,
বন্ধনে যে বাঁধা আমি
মলিন মাটির পুরে॥
ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি
দরবারি-কানাড়া মিশ্র একতালা
ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি
ক্ষমিয়ো সে অপরাধ।
অসহায় মনে কেন জেগেছিল
ভালোবাসিবার সাধ॥
কত জন আসে তব ফুলবন –
মলয়, ভ্রমর, চাঁদের কিরণ,
তেমনই আমিও আসি অকারণ
অপরূপ উন্মাদ॥
তোমার হৃদয়-শূন্যে জ্বলিছে
কত রবি শশী তারা,
তারই মাঝে আমি ধূমকেতু-সম
এসেছিনু পথহারা।
তবু জানি প্রিয়, একদা নিশীথে
মনে পড়ে যাবে আমারে চকিতে,
সহসা জাগিবে উৎসব-গীতে
সকরুণ অবসাদ॥
ভেঙো না ভেঙো না ধ্যান
জংলা দাদরা
ভেঙো না ভেঙো না ধ্যান
হে মম ধ্যানের দেবতা।
পূজা লহো অর্ঘ্য লহো
কোয়ো না কোয়ো না কথা॥
পাষাণ-মুরতি তুমি
পাষাণ হইয়া থাকো,
মন্দির-বেদি হতে
ধরার ধুলায় নেমো নাকো,
তুমিও মাটির মানুষ
বুঝায়ে দিয়ো না ব্যথা॥
সহিব সকলই স্বামী
হেনো হেলা ব্যথা দিয়ো,
সহিব না অপমান
আমার ভালোবাসার, হে প্রিয়!
থাকো তুমি প্রাণের মাঝে
তোমার মন্দির যথা॥
মদির স্বপনে মম বন-ভবনে
পিলু মিশ্র কাহারবা
মদির স্বপনে মম বন-ভবনে
জাগো চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষণিকা!
মোর গগনে উল্কার প্রায়
চমকি ক্ষণেক চকিতে মিলায়
তোমার হাসির জুঁই-কণিকা।
ওগো ক্ষণিকা॥
পুষ্পধনু তব মন-রাঙানো
বঙ্কিম ভুরু হানো হানো!
তোমার উতল উত্তরীয়
আমার চোখে ছুঁইয়ে দিয়ো,
ওগো আমি হব তোমার মালার মণিকা।
ওগো ক্ষণিকা॥
মনের রং লেগেছে
চৈতী কাহারবা
মনের রং লেগেছে
বনের পলাশ জবা অশোকে।
রঙের ঘোর জেগেছে
পারুল কনক-চাঁপার চোখে॥
মুহুমুহু বোলে কুহুকুহু কোয়েলা
মুকুলিত আমের ডালে, গাল রেখে ফুলের গালে।
দোয়েলা দোল দিয়ে যায়
ডালিম ফুলের নব কোরকে॥
ফুলেরই পরাগ-ফাগের রেণু
ঝুরুঝুরু ঝরিছে গায়ে ঝিরিঝিরি চৈতি বায়ে
বকুল-বনে ঝিমায়
মধুপ মদির নেশার ঝোঁকে॥
হরিত বনে হরষিত মনে
হোরির হররা জাগে,
রঙিলা অনুরাগে।
নূতন প্রণয়-সাধ জাগে
চাঁদের রাঙা আলোকে॥
মম আগমনে বাজে আগমনির সানাই
(শরৎ)
রামকেলি কাহারবা
মম আগমনে বাজে আগমনির সানাই।
সহসা প্রভাতে ‘আমি এসেছি’ জানাই॥
আমি আনি দেশে দশভুজার পূজা,
কোজাগরি নিশি জাগি আমি অনুজা।
বুকে শাপলা কমল –
মালা দোলে টলমল,
আমি পরদেশি বন্ধুরে স্বদেশে আনাই॥
মহাকালের কোলে এসে গৌরী আমার হল কালী
দুর্গা গীতাঙ্গী
মহাকালের কোলে এসে গৌরী আমার হল কালী।
মুখে তাহার পড়ুক কালি
মাকে কালো বলে যে দেয় গালি॥
মায়ের অমন রূপ কি হারায়?
সে যে ছড়িয়ে আছে চন্দ্র-তারায়,
মায়ের রূপের আরতি হয়
নিত্য সূর্য-প্রদীপ জ্বালি॥
ভৈরবেরে বরণ করে উমা হল ভৈরবী
মা অভিমানে শ্মশানবাসী শিবের জটায় জাহ্নবী!
পার্বতী মোর পাগলি মেয়ে
চণ্ডী সেজে বেড়ায় ধেয়ে,
শ্মশান-চিতার ভস্ম মেখে
ম্লান হল মা-র রূপের ডালি॥
মা এসেছে মা এসেছে উঠল কলরোল
বাউল–ভাটিয়ালি মিশ্র দাদরা
(আগমনি)
মা এসেছে মা এসেছে
উঠল কলরোল।
দিকে দিকে উঠল বেজে
সানাই কাঁসর ঢোল॥
ভরা নদীর কূলে কূলে,
শিউলি শালুক পদ্মফুলে,
মায়ের আসার আভাস দুলে,
আনন্দ-হিল্লোল।
সেই পুলকে পড়ল নিটোল
নীল আকাশে টোল॥
বিনা কাজের মাতন রে আজ কাজে দে ভাই ক্ষমা,
বে-হিসাবি করব খরচ সাধ যা আছে জমা।
এক বছরের অতৃপ্তি ভাই
এই কদিনে কীসে মিটাই,
কে জানে ভাই ফিরব কিনা
আবার মায়ের কোল।
আনন্দে আজ আনন্দকে
পাগল করে তোল॥
মাতল গগন-অঙ্গনে ওই
দরবারি কানাড়া মিশ্র রূপক
মাতল গগন-অঙ্গনে ওই
আমার রণ-রঙ্গিণী মা।
সেই মাতনে উঠল দুলে
ভূলোক দ্যুলোক গগন-সীমা॥
আঁধার-অসুর-বক্ষপানে
অরুণ আলোর খড়্গ হানে,
মহাকালের ডম্বরুতে উঠল বেজে মা-র মহিমা॥
সৃষ্টিপ্রলয় যুগল নূপুর
বাজে শ্যামার যুগল পায়ে,
গড়িয়ে পড়ে তারার মালা
উল্কা হয়ে গগন-গায়ে।
লক্ষ গ্রহের মুণ্ডমালা দোলে গলে দোলে ওই
বজ্র-ভেরির ছন্দ-তালে নাচে শ্যামা তাথইথই,
অগ্নিশিখায় ঝলকে ওঠে
খড়্গ-ঝরা লাল শোণিমা॥
মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে
পাহাড়ি মিশ্র কাহারবা
মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে।
সজল কাজল-লেখা হব আঁখির পলকে।
জলকে-যাওয়ার কলস হব অলস সন্ধ্যায়,
ছল করে গো অঙ্গে তোমার পড়ব ছলকে॥
তাম্বুল রাগ হব তোমার অরুণ অধরে,
দুলব স্বপন-কমল হয়ে ঘুমের সায়রে,
জ্যোতি হব তোমার রূপের বিজলি-ঝলকে॥
বক্ষে তোমার হার হব গো নূপুর চরণে,
গোপন প্রেমের দাগ হব গো হিয়ার ফলকে॥
মুঠি মুঠি আবির ও কে কাননে ছড়ায়
চৈতি খেমটা
মুঠি মুঠি আবির ও কে কাননে ছড়ায়।
রাঙা হাসির পরাগ ফুল-আননে ঝরায়॥
তার রঙের আবেশ লাগে চাঁদের চোখে,
তার লালসার রং জাগে রাঙা অশোকে।
তার রঙিন নিশান দুলে কৃষ্ণচূড়ায়॥
তার পুষ্পধনু দোলে শিমুল-শাখায়,
তার কামনা কাঁপে গো ভোমরা-পাখায়,
সে খোঁপাতে বেলফুলের মালা জড়ায়॥
সে কুসুমি শাড়ি পরায় নীল-বসনায়,
সে আঁধার মনে জ্বালে লাল রোশনাই।
সে শুকনো বুকে ফাগুন-আগুন ধরায়॥
মেঘ-মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পবন
পিলু – বারোয়াঁ কাহারবা
মেঘ-মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পবন,
কে বিরহী রহি রহি দ্বারে আঘাত হানো।
শাওন ঘন ঘোর ঝরিছে ধারা অঝোর
কাঁপিছে কুটির মোর দীপ-নেভানো॥
বজ্রে বাজিয়া ওঠে তব সংগীত,
বিদ্যুতে ঝলকিছে আঁখি-ইঙ্গিত,
চাঁচর চিকুরে তব ঝড় দুলানো
ওগো মন ভুলানো॥
এক হাতে সুন্দর, কুসুম ফোটাও!
আর হাতে নিষ্ঠুর, মুকুল ঝরাও!
হে পথিক, তব সুর অশান্ত বায়
জন্মান্তর হতে যেন ভেসে আসে হায়!
বিজড়িত তব স্মৃতি চেনা অচেনায়
প্রাণ-কাঁদানো॥
মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে
‘ইজিপসিয়ান ডান্সের’ সুর
মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে
নেচে যায়।
বিহ্বল চঞ্চল-পায়॥
সাহারা মরুর পারে
খর্জুর-বীথির ধারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝংকারে।
উড়িয়ে ওড়না ‘লু’ হাওয়ায়
পরি-নটিনি নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
সুরমা-পরা আঁখি হানে আশমানে,
জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে।
ঢেউ তুলে নীল দরিয়ায়
দিল-দরদি নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
দোলে রে গলে দোলে তার
খেজুর-মেতীর সোনার হার,
ছন্দ-দোদুল।
মিশরের আনন্দ সে
চপল ‘রমল’ ছন্দ সে,
জিয়ানো মিছরি-রসে তার হাসি অতুল।
নারঙ্গী-আঙুরবাগে তার
গান গাহে বুলবুল॥
মরীচিকা-মায়া সে
দেয় না ধরা, ছায়া সে,
পালিয়ে সে যায় সুদূর।
যায় নেচে সে নটিনি
নীল দরিয়ার সতিনি
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥
মোর বুক-ভরা ছিল আশা
দেশ–খাম্বাজ কাওয়ালি
মোর বুক-ভরা ছিল আশা
ছিল প্রাণ-ভরা ভালোবাসা।
হায় আসিল সে যবে কাছে
মোর মুখে সরিল না ভাষা॥
আমি পেয়েছিনু তায় একা,
তার চোখে ছিল প্রেম-লেখা,
তবু বলিতে নারিনু, প্রাণে
মোর কাঁদিছে কোন দুরাশা॥
আমি পান না করিনু বারি
এসে ভরা সরসীর তীরে,
হায় আমার মতন ‘শহিদ’
কেহ দেখেছে কোথাও কি রে?
এই তৃষ্ণা-কাতর বুকে
ছিল মরুভূমির পিপাসা॥
যবে সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় তুলসীতলায়
ইমন মিশ্র কাহারবা
যবে সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় তুলসীতলায়
তুমি করিবে প্রণাম।
তব দেবতার নাম নিতে ভুলিয়া বারেক
প্রিয় নিয়ো মোর নাম॥
একদা এমনই এক গোধূলিবেলা
একেলা ছিলাম আমি, তুমি একেলা,
জানি না কাহার ভুল, তোমার পূজার ফুল
আমি লইলাম।
সেই দেউলের পথ সেই ফুলের শপথ
প্রিয়া তুমি ভুলিলে, হায় আমি ভুলিলাম॥
দু-ধারে পথের সেই কুসুম ফোটে
হায় এরা ভোলেনি,
বেঁধেছিল তরু-শাখে লতার যে ডোর
হেরো আজও খোলেনি।
একদা যে নীল নভে উঠেছিল চাঁদ
ছিল অসীম আকাশ ভরা অনন্ত সাধ,
আজি অশ্রু-বাদল সেথা ঝরে অবিরাম॥
যাবার বেলায় ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল
মাঢ়–মিশ্র কাহারবা
যাবার বেলায় ফেলে যেয়ো
একটি খোঁপার ফুল।
আমার চোখে চেয়ে যেয়ো
একটু চোখের ভুল॥
অধর-কোণের ঈষৎ হাসির ক্ষণিক আলোকে
রাঙিয়ে যেয়ো আমার মনের গহন কালোকে,
যেয়ো না গো মুখ ফিরিয়ে
দুলিয়ে হিরের দুল॥
একটি কথা কয়ে যেয়ো, একটি নমস্কার,
সেই কথাটি গানের সুরে গাইব বারেবার,
হাত ধরে মোর বন্ধু বোলো
একটু মনের ভুল॥
যাহা কিছু মম আছে প্রিয়তম
সিন্ধু–ভৈরবী যৎ
যাহা কিছু মম আছে প্রিয়তম
সকলই নিয়ো হে স্বামী।
যত সাধ আশা প্রীতি ভালোবাসা
সঁপিনু চরণে আমি॥
পুতুল-খেলায় মায়ার ছলনায়
ভুলাইয়া প্রভু রেখেছিলে আমায়,
ভুলেছি সে খেলা, আজি অবেলায়
তোমার দুয়ারে থামি॥
ধরে রাখি যারে আমার বলিয়া
সহসা কাঁদায়ে যায় সে চলিয়া,
অনিমেষ-আঁখি তুমি ধ্রুবতারা
জাগো দিবসযামী॥
যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে
ভীমপলশ্রী কাহারবা
যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে
দেহের কূলে কে চঞ্চল দিগঞ্চলা,
মেঘ-ঘন-কুন্তলা।
দেয় দোলা সে দেয় দোলা
পুব-হাওয়াতে বনে বনে দেয় দোলা॥
চলে নাগরী দোলে ঘাগরি
কাঁখে বর্ষা-জলের গাগরি,
বাজে নূপুর-সুর-লহরি –
রিমিঝিম রিম ঝিম রিম ঝিম
চল-চপলা॥
দেয়ারই তালে কেয়া কদম নাচে,
ময়ূর-ময়ূরী নাচে তমাল-গাছে,
চাতক-চাতকী নাচে।
এলায়ে মেঘ-বেণি কাল-ফণী
আসিল কি দেবকুমারী
নন্দন-পথ-ভোলা॥
রঙ্গিলা আপনি রাধা তারে হোরির রং দিয়ো না
হোরি
কাফি–-সিন্ধু কাহারবা
রঙ্গিলা আপনি রাধা
তারে হোরির রং দিয়ো না।
ফাগুনের রানি যে, তায়,
আর ফাগে রাঙিয়ো না॥
রাঙা আবির-রাঙা ঠোঁটে
গালে ফাগের লালি ফোটে,
রং-সায়রে নেয়ে উঠে
অঙ্গে ঝরে রঙের সোনা॥
অনুরাগ-রাঙা মনে
রঙের খেলা ক্ষণে ক্ষণে,
অন্তরে যার রঙের লীলা
(তারে) বাহিরের রং লাগিয়ো না॥
রাত্রিশেষের যাত্রী আমি যাই চলে যাই একা
মালকোষ মিশ্র দাদরা
রাত্রিশেষের যাত্রী আমি
যাই চলে যাই একা।
শুকতারাতে রইল আমার
চোখের জলের লেখা॥
ফোটার আগে ঝরল যে ফুল
সঙ্গী আমার সেই সে মুকুল,
ছায়াপথে জাগে আমার
বিদায়-পদ-রেখা॥
অনেক ছিল আশা আমার
অনেক ছিল সাধ
ব্যর্থ হল না পেয়ে কার
আঁখির পরসাদ।
অনেক রাতে ঘুমের ঘোরে
এসো না আর খুঁজতে মোরে,
তারার দেশে চন্দ্রলোকে
হবে আবার দেখা॥
লুকোচুরি খেলতে হরি হার মেনেছ আমার সনে
ধানী মিশ্র কাওয়ালি
লুকোচুরি খেলতে হরি হার মেনেছ আমার সনে।
লুকাতে চাও বৃথাই হে শ্যাম, ধরা পড় ক্ষণে ক্ষণে॥
গহন মেঘে লুকাতে চাও, অমনি রাঙা চরণ লেগে
যে পথে ধাও সে পথ ওঠে ইন্দ্রধনুর রঙে রেঙে,
চপল হাসি চমকে বেড়ায় বিজলিতে নীল গগনে॥
রবি-শশী-গ্রহ-তারা তোমার কথা দেয় প্রকাশি,
ওই আলোতে হেরি তোমার তনুর জ্যোতি মুখের হাসি।
হাজার কুসুম ফুটে ওঠে লুকাও যখন শ্যামল বনে॥
মনের মাঝে যেমনি লুকাও, মন হয়ে যায় অমনি মুনি,
ব্যথায় তোমার পরশ যে পাই, ঝড়ের রাতে বংশী শুনি,
দুষ্টু তুমি দৃষ্টি হয়ে লুকাও আমার এই নয়নে॥
শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ওই
মার্চের সুর
শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ওই।
পুণ্য-চিত্ত মৃত্যু-তীর্থ-পথের যাত্রী কই॥
আগে জাগে বাধা ও ভয়,
ও ভয়ে ভীত নয় হৃদয়,
জানি মোরা হবই হব জয়ী॥
জাগায়ে প্রাণে প্রাণে নব আশা,
ভাষাহীন মুখে ভাষা,
হে নবীন, আনো নব পথের দিশা,
নিশি শেষের উষা,
কেহ নাই দেশে মানুষ তোমরা বই॥
স্বর্গ রচিয়া মৃত্যুহীন –
চল ওরে কাঁচা চল নবীন,
দৃপ্ত চরণে নৃত্য দোল জাগায়ে মরুতে রে বেদুইন!
‘নাই নিশি নাই’ ডাকে শুভ্র দীপ্ত দিন!
নাই ওরে ভয় নাই,
জাগে ঊর্ধ্বে দেবী জননী শক্তিময়ী॥
শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল
লচ্ছাশাখ ত্রিতাল
শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল
শান্ত অচঞ্চল ধ্রুব-জ্যোতি।
অশান্ত এ চিত করো হে সমাহিত
সদা আনন্দিত রাখো মতি॥
দুঃখ শোক সহি অসীম সাহসে,
অটল রহি যেন সম্মানে যশে,
তোমার ধ্যানের আনন্দ-রসে
নিমগ্ন রহি হে বিশ্বপতি॥
মন যেন না টলে কলকোলাহলে
হে রাজ-রাজ।
অন্তরে তুমি নাথ সতত বিরাজ!
বহে তব ত্রিলোক ব্যাপিয়া, হে গুণী,
ওংকার-সংগীত-সুর-সুরধুনী,
হে মহামৌনী, যেন সদা শুনি
সে সুরে তোমার নীরব আরতি॥
শূন্য এ-বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়
ছায়ানট একতালা
শূন্য এ-বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়!
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়॥
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ,
কেঁদে নদীজল করুণ বিষাদ
ডাকে, ‘আয় ফিরে আয়!’
গগনে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু, ওরে সুন্দর!
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়
লুটায় লতা ধুলায়।
তুই ফিরে এলে, ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বনে ফুলদল,
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল
তোর চোখের চাওয়ায়॥
শ্মশান-কালীর নাম শুনে রে
বারোয়াঁ দাদরা
শ্মশান-কালীর নাম শুনে রে
ভয় কে পায়?
মা যে আমার শবের মাঝে
শিব জাগায়॥
আনন্দেরই নন্দিনী সে,
অমৃত নীল-কণ্ঠ-বিষে,
চরণ শোভে অরুণ আলোর
লাল জবায়॥
চার হাতে তার চার যুগেরই খঞ্জনি
নৃত্য-তালে নিত্য ওঠে রনঝনি।
অন্নদা মোর নিল তুলি
সাধ করে রে ভিক্ষা-ঝুলি,
পায় না ধ্যানে যোগীন্দ্র সেই যোগ-মায়ায়॥
শ্যামা তন্বী আমি মেঘ-বরনা
(বর্ষা)
মেঘ তেতালা
শ্যামা তন্বী আমি মেঘ-বরনা।
মোর দৃষ্টিতে বৃষ্টির ঝরে ঝরনা॥
অম্বরে জলদ-মৃদঙ্গ বাজাই,
কদম-কেয়ায় বন-ডালা সাজাই,
হাসে শস্যে কুসুমে ধরা নিরাভরণা॥
পুবালি হাওয়ায় ওড়ে কালো কুন্তল,
বিজলি ও মেঘ – মুখে হাসি, চোখে জল।
রিমিঝিমি নেচে যাই চল-চরণা॥
সহসা কী গোল বাধাল পাপিয়া আর পিকে
সিন্ধু–ভৈরবী মিশ্র দাদরা
সহসা কী গোল বাধাল পাপিয়া আর পিকে।
গোলাপ ফুলের টুকটুকে রং চোখে লাগে ফিকে॥
নাই বৃষ্টি বাদল ওলো
দৃষ্টি কেন ঝাপসা হল?
অশ্রুজলের ঝালর দোলে চোখের পাতার চিকে॥
পলাশকলির লাল আখরে বনের দিকে দিকে
গোপন আমার ব্যথার কথা কে গেল সই লিখে।
মনে আমার পাইনে লো খেই,
কে যেন নেই, কী যেন নেই!
কে বনবাস দিল আমার মনের বাসন্তীকে॥
স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণি-বর্ণা এসো মালবিকা
মিয়া কি মল্লার তেতালা
স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণি-বর্ণা এসো মালবিকা!
অর্জুন-মঞ্জরী-কর্ণে গলে নীপ-মালিকা, –
মালবিকা॥
ক্ষীণা তন্বী জলভার-নমিতা,
শ্যাম জম্বুবনে এসো অমিতা!
আনো কুন্দ-মালতী-জুঁই ভরি থালিকা
মালবিকা॥
ঘন-নীল বাসে অঙ্গ ঘিরে
এসো অঞ্জনা-রেবা নদীর তীরে!
পরি হংসমিথুন-আঁকা শাড়ি ঝিলিমিল
এসো ডাগর চোখে মাখি সাগরের নীল।
ডাকে বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দিগ্বালিকা –
মালবিকা॥