বরষা ওই এল বরষা
মেঘমল্লার তেতালা
বরষা ওই এল বরষা।
অঝোর ধারায় জল ঝরঝরি অবিরল
ধূসর নীরস ধরা হল সরসা।
ঘন দেয়া দমকে দামিনী চমকে
ঝঞ্ঝার ঝাঁঝর ঝমঝম ঝমকে,
মনে পড়ে সুদূর মোর প্রিয়তমকে
মরাল মরালীরে হেরি সহসা॥
বেণু-বনে মৃদু মিঠে আওয়াজে
টাপুর টাপুর জল-নূপুর বাজে।
শূন্য শয্যাতলে আনমনে শুনি
সেই নূপুরের ধ্বনি অন্তরমাঝে।
শ্যামসখারে মেঘমল্লারে
ডাকি বারেবারে তন্দ্রালসা॥
বল রে তোরা বল ওরে ও আকাশ-ভরা তারা
খাম্বাজ দাদরা
বল রে তোরা বল ওরে ও আকাশ-ভরা তারা!
আমার নয়ন-তারা কোথায়, কোথায় হল হারা?
দৃষ্টিতে তার বৃষ্টি হত তোদের অধিক আলো,
আঁধার করে আমার ভুবন কোথায় সে লুকাল?
হাতড়ে ফিরি আকাশ-ভুবন পাইনে তাহার সাড়া॥
খানিক আগে মানিক আমার ছিল রে এই চোখে,
আলোর কুঁড়ি পড়ল ঝরে কোন সে গহন-লোকে।
বলিস তোর আলোর রাজায়
তাঁহার অসীম আলোক-সভায়
কম হত কি আলো, আমার আঁখির আলো ছাড়া॥
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল
পিলু — খাম্বাজ কাহারবা
বল সখী বল ওরে সরে যেতে বল।
মোর মুখে কেন চায় আঁখি-ছলছল,
ওরে সরে যেতে বল॥
পথে যেতে কাঁপে গা
শরমে জড়ায় পা,
মনে হয় সারা পথ হয়েছে পিছল।
ওরে সরে যেতে বল॥
জল নিতে গিয়ে সই
ওর চোখে চেয়ে রই,
শান-বাঁধা ঘাট যেন কাঁপে টলমল।
ওরে সরে যেতে বল॥
প্রথম বিরহ মোর
চায় কি ও চিত-চোর?
চাঁদনি চৈতি রাতে আনে সে বাদল।
ওরে সরে যেতে বল॥
বল্লরি-ভুজ-বন্ধন খোলো
বল্লরি-ভুজ-বন্ধন খোলো!
অভিসার-নিশি অবসান হল॥
পাণ্ডুর চাঁদ হেরো অস্তাচলে
জাগিয়া শ্রান্ত-তনু পড়েছে ঢলে,
মিলনের মালা ম্লান বক্ষতলে,
অভিমান-অবনত আঁখি তোলো॥
উতল সমীর আমি ক্ষণিকের ভুল,
কুসুম ঝরাই আমি ফোটাই মুকুল।
আলোকে শুকায় মোর প্রেমের শিশির,
দিনের বিরহ আমি মিলন নিশির,
হে প্রিয় ভীরু এ স্বপন-বিলাসীর
অকরুণ প্রণয় ভোলো ভোলো॥
বাদল-মেঘের মাদল তালে
সারং মিশ্র কাওয়ালি
বাদল-মেঘের মাদল তালে
ময়ূর নাচে দুলে দুলে।
আকাশে নাচে মেঘের পরি
বিজলি-জরিন ফিতা পড়ে খুলে॥
কদম্ব-ডালে ঝুলনিয়া ঝুলায়ে,
বনের বেণি কেয়াফুল দুলায়ে,
তাল-তমাল-বনে কাজল বুলায়ে
বর্ষারানি নাচে এলোচুলে॥
তরঙ্গ-রঙ্গে নাচে নটিনি,
ভরা যৌবন ভাদর-তটিনী,
পরি ফুলমালা নাচে বনবালা
সবুজ সুধার লহর তুলে॥
বীরদল আগে চল
মার্চের সুর
বীরদল আগে চল
কাঁপাইয়া পদভারে ধরণি টলমল।
যৌবন-সুন্দর চিরচঞ্চল॥
আয় ওরে আয় তালে তালে পায়ে পায়ে
আশা জাগায়ে নিরাশায়।
আয় ওরে আয় প্রাণহীন মরুভূমে
আয় নেমে বন্যার ঢল॥
ঝঞ্ঝায় বাজে রণ-মাদল
চল চল
ভোল ভোল জননীর স্নেহ-অঞ্চল॥
ডাকে বিধুর প্রিয়া সুদূর
ভোল তারে ডাকে তোরে তূর্য-সুর।
দল দল পায় ভয়-ভাবনায়
শ্মশানে জাগা প্রাণ
আপন-ভোলা পাগল॥
বুনো ফুলের করুণ সুবাস ঝুরে
জয়জয়ন্তী একতালা
বুনো ফুলের করুণ সুবাস ঝুরে
নাম-না-জানা গানের পাখি, তোমার গানের সুরে॥
জানাতে হায় এলে কোথা
বনের ছায়ার মনের ব্যথা,
তরুর স্নেহ ফেলে এলে মরুর বুকে উড়ে॥
এলে চাঁদের তৃষ্ণা নিয়ে কৃষ্ণা তিথির রাতে,
পাতার বাসা ফেলে এলে সজল নয়ন-পাতে।
ওরে পাখি, তোর সাথে হায়
উড়তে নারি দূর অলকায়,
বন্ধনে যে বাঁধা আমি
মলিন মাটির পুরে॥
ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি
দরবারি-কানাড়া মিশ্র একতালা
ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি
ক্ষমিয়ো সে অপরাধ।
অসহায় মনে কেন জেগেছিল
ভালোবাসিবার সাধ॥
কত জন আসে তব ফুলবন –
মলয়, ভ্রমর, চাঁদের কিরণ,
তেমনই আমিও আসি অকারণ
অপরূপ উন্মাদ॥
তোমার হৃদয়-শূন্যে জ্বলিছে
কত রবি শশী তারা,
তারই মাঝে আমি ধূমকেতু-সম
এসেছিনু পথহারা।
তবু জানি প্রিয়, একদা নিশীথে
মনে পড়ে যাবে আমারে চকিতে,
সহসা জাগিবে উৎসব-গীতে
সকরুণ অবসাদ॥
ভেঙো না ভেঙো না ধ্যান
জংলা দাদরা
ভেঙো না ভেঙো না ধ্যান
হে মম ধ্যানের দেবতা।
পূজা লহো অর্ঘ্য লহো
কোয়ো না কোয়ো না কথা॥
পাষাণ-মুরতি তুমি
পাষাণ হইয়া থাকো,
মন্দির-বেদি হতে
ধরার ধুলায় নেমো নাকো,
তুমিও মাটির মানুষ
বুঝায়ে দিয়ো না ব্যথা॥
সহিব সকলই স্বামী
হেনো হেলা ব্যথা দিয়ো,
সহিব না অপমান
আমার ভালোবাসার, হে প্রিয়!
থাকো তুমি প্রাণের মাঝে
তোমার মন্দির যথা॥
মদির স্বপনে মম বন-ভবনে
পিলু মিশ্র কাহারবা
মদির স্বপনে মম বন-ভবনে
জাগো চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষণিকা!
মোর গগনে উল্কার প্রায়
চমকি ক্ষণেক চকিতে মিলায়
তোমার হাসির জুঁই-কণিকা।
ওগো ক্ষণিকা॥
পুষ্পধনু তব মন-রাঙানো
বঙ্কিম ভুরু হানো হানো!
তোমার উতল উত্তরীয়
আমার চোখে ছুঁইয়ে দিয়ো,
ওগো আমি হব তোমার মালার মণিকা।
ওগো ক্ষণিকা॥
মনের রং লেগেছে
চৈতী কাহারবা
মনের রং লেগেছে
বনের পলাশ জবা অশোকে।
রঙের ঘোর জেগেছে
পারুল কনক-চাঁপার চোখে॥
মুহুমুহু বোলে কুহুকুহু কোয়েলা
মুকুলিত আমের ডালে, গাল রেখে ফুলের গালে।
দোয়েলা দোল দিয়ে যায়
ডালিম ফুলের নব কোরকে॥
ফুলেরই পরাগ-ফাগের রেণু
ঝুরুঝুরু ঝরিছে গায়ে ঝিরিঝিরি চৈতি বায়ে
বকুল-বনে ঝিমায়
মধুপ মদির নেশার ঝোঁকে॥
হরিত বনে হরষিত মনে
হোরির হররা জাগে,
রঙিলা অনুরাগে।
নূতন প্রণয়-সাধ জাগে
চাঁদের রাঙা আলোকে॥