দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা
ভূপালি মিশ্র কাহারবা
দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা।
সকাল সাঁঝে সকল কাজে জপি সে নাম নিরালা॥
সেই নাম বসন-ভূষণ আমারই,
সেই নামে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারি,
সেই নাম লয়ে বেড়াই কেঁদে
সেই নামে আবার জুড়াই জ্বালা॥
সেই নামেরই নামাবলি গ্রহ-তারা রবি-শশী,
দোলে গগন-কোলে।
মধুর সেই নাম প্রাণে সদা বাজে,
মন লাগে না সংসার-কাজে,
সে নামে সদা মন মাতোয়ালা॥
আদর-সোহাগ মান-অভিমান আপন মনে
তার সাথে,
কাঁদায়ে কাঁদি, পায়ে ধরে সাধি,
কভু করি পূজা, কভু বুকে বাঁধি,
আমার স্বামী সে ভুবন-উজলা॥
না-ই পরিলে নোটন খোঁপায়
বেহাগ – খাম্বাজ দাদরা
না-ই পরিলে নোটন খোঁপায়
ঝুমকো-জবার ফুল।
এমনি এসো লুটিয়ে পিঠে
আকুল এলোচুল॥
সজ্জা-বিহীন লজ্জা নিয়ে
এমনি তুমি এসো প্রিয়ে,
গোলাপ ফুলে রং মাখাতে
হয় যদি হোক ভুল॥
গৌর দেহে না-ই জড়ালে
গৌরী-চাঁপা শাড়ি,
ভূষণ পরে না-ই বা দিলে
রূপের সাথে আড়ি।
যেমন আছ তেমনি এসো,
নয়ন তুলে ঈষৎ হেসো,
সেই খুশিতে উঠবে দুলে
আমার হৃদয়-কূল॥
নাচে নাচে রে মোর কালো মেয়ে
নটনারায়ণ তেওড়া
নাচে নাচে রে মোর কালো মেয়ে
নৃত্যকালী শ্যামা নাচে।
নাচ হেরে তার নটরাজও
পড়ে আছে পায়ের কাছে॥
মুক্তকেশী আদুল গায়ে
নেচে বেড়ায় চপল পায়ে
মার চরণে গ্রহতারা নূপুর হয়ে জড়িয়ে আছে॥
ছন্দ-সরস্বতী দোলে পুতুল হয়ে মায়ের কোলে
সৃষ্টি নাচে, নাচে প্রলয়, মায়ের আমার পায়ের তলে রে।
আকাশ কাঁপে নাচের ঘোরে
ঢেউ খেলে যায় সাত সাগরে
সেই নাচনের পুলক দোলে
ফুল হয়ে রে লতায় গাছে॥
নিরুদ্দেশের পথে আমি হারিয়ে যদি যাই
কানাড়া একতালা
নিরুদ্দেশের পথে আমি হারিয়ে যদি যাই
হে প্রিয়তম
নিত্য নূতন রূপে আবার আসব এই হেথাই॥
চাঁদনি রাতে বাতায়নে রইবে চেয়ে উদাস মনে,
বলব আমি, ‘হারাইনি গো, নাই ভাবনা নাই;
আকাশ-লোকে তারার চোখে তোমার পানে চাই।’
সাঁঝ সকালে জল নিতে যাও যে বনপথ বেয়ে –
ঝরা মুকুল হয়ে আমি সে পথ দেব ছেয়ে।
বাতাস হয়ে লহর তুলে ঘোমটা মুখের দেব খুলে,
বলবে হেসে, ‘হায় কালা-মুখ, তোমার মরণ নাই?’
সত্যি, আমার নাই তো মরণ তোমায় ভালোবেসে,
তোমায় আরও পাবার আশায় এলাম নিরুদ্দেশে।
কাছে কাছে ছিলাম বলে
ভুলতে আমায় পলে পলে,
শয়ন-সাথে নাই বলে আজ নয়ন-পাতে পাই।
বাহির ছেড়ে আজ পেয়েছি অন্তরেতে ঠাঁই॥
নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না
ভৈরবী দাদরা
নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না
দীপ নিভিতে দাও।
নিবু-নিবু প্রদীপ নিবুক হে পথিক
ক্ষণিক থাকিয়া যাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
আজও শুকায়নি মালার গোলাপ,
আশা-ময়ূরী মেলেনি কলাপ,
বাতাসে এখনও জড়ানো প্রলাপ,
বারেক ফিরিয়া চাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
ঢুলিয়া পড়িতে দাও ঘুমে অলস আঁখি
ক্লান্ত করুণ কায়,
সুদূর নহবতে বাঁশরি বাজিতে দাও
উদাস যোগিয়ায়।
হে প্রিয়, প্রভাতে তব রাঙা পায়
বকুল ঝরিয়া মরিতে চায়,
তব হাসির আভায় তরুণ অরুণ-প্রায়
দিক রাঙিয়ে যাও।
দীপ নিভিতে দাও॥
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
ভৈরবী কাহারবা
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই॥
পরি চাঁপা রঙের শাড়ি, খয়েরি টিপ,
জাগি বাতায়নে, জ্বালি আঁখি-প্রদীপ,
মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই॥
তুমি আসিবে বলে সুদূর অতিথি
জাগে চাঁদের তৃষ্ণা লয়ে কৃষ্ণা-তিথি,
কভু ঘরে আসি কভু বাহিরে চাই॥
আজি আকাশে বাতাসে কানাকানি
জাগে বনে বনে নব ফুলের বাণী,
আজি আমার কথা যেন বলিতে পাই॥
ফিরে ফিরে কেন তারই স্মৃতি
ভৈরবী কাহারবা
ফিরে ফিরে কেন তারই স্মৃতি
মোরে কাঁদায় নিতি
যে ফিরিবে না আর।
ফিরায়েছি যায় কাঁদাইয়া হা
সে কেন কাঁদায় মোরে বারেবার॥
তারই দেওয়া ফুলমালা যত দলিয়াছি পায়
সেই ছিন্নমালা কুড়ায়ে নিরালা
আজি রাখি হিয়ায়।
বারেবারে ডাকি প্রিয় নাম ধরে তার॥
হানি অবহেলা যারে দিয়াছি বিদায়
আজি তারেই খুঁজি, সে কোথায় সে কোথায়।
জ্বালি নয়ন-প্রদীপ জাগি বাতায়নে,
নিশি ভোর হয়ে যায় বৃথা জাগরণে,
আজি স্বর্গ শূন্য মোর তার বিহনে,
কাঁদি আকাশ বাতাস মোর করে হাহাকার॥
ফুলের মতন ফুল্ল মুখে দেখছি এ কী ভুল
আশাবরি দাদরা
ফুলের মতন ফুল্ল মুখে
দেখছি এ কী ভুল।
হাসির বদল দুলছে সেথায়
অশ্রুকণার দুল॥
রোদের দাহে বালুচরে
মরা নদী কেঁদে মরে,
গাইতে এসে কাঁদছে বসে
বান-বেঁধা বুলবুল॥
ভোর গগনে পূর্ণ চাঁদের
এমনি মলিন মুখ,
ঝড়ের কোলে এমনি দোলে
প্রদীপশিখার বুক।
ম্লান-মাধুরী মালার ফুলে
এমনি নীরব কান্না দুলে,
করুণ তুমি বিসর্জনের
দেবীর সমতুল॥
বকুল-বনের পাখি
খাম্বাজ মিশ্র ঠুংরি
বকুল-বনের পাখি
ডাকিয়া আর ভেঙো না ঘুম।
বকুলবাগানে মম,
ফুরায়েছে ফুলের মরশুম॥
চাঁদের নয়নে চাহি
জাগে না আর সে নেশা,
চাঁপার সুরভি-সুরায়
বিরস বিরহ-মেশা।
আজি মোর জাগার সাথি
একাকিনী নিশীথ নিঝুম॥
পিয়া মোর দূর বিদেশে, —
কারে আর ডাকিছ পাখি
শুকায়ে গিয়াছে হাতে
মালতী-মালার রাখি।
নিভিয়া গিয়াছে প্রদীপ
রেখে গেছে মলিন ধূম॥
বনে মোর ফুল-ঝরার বেলা
হাম্বির মিশ্র কাহারবা
বনে মোর ফুল-ঝরার বেলা
জাগিল এ কী চঞ্চলতা। (অবেলায়)
এল ওই শুকনো ডালে ডালে
কোন অতিথির ফুল-বারতা॥ (এল ওই)
বিদায়-নেওয়া কুহু সহসা এল ফিরে
জোয়ার ওঠে দুলে, মরা নদীর তীরে,
শীতের বনে বহে দখিনা হাওয়া ধীরে
জাগায়ে বিধুর মধুর ব্যথা॥ (পরানে)
বেল-কুঁড়ির মালা পরে তেমনি করে
কৈশোরের প্রিয়া এল কী রূপ ধরে!
হারানো সুর আজি কণ্ঠে ওঠে ভরে,
লাজ ভুলে বধূ কহিল কথা॥ (বাসরে)
রুদ্ধ বাতায়ন খুলে দে, চেয়ে দেখি –
হেনার মঞ্জরি আবার ফুটেছে কি?
হারানো মানসী ফিরেছে লয়ে কি
গত বসন্তের বিহ্বলতা॥