ওই কাজল-কালো চোখ
বেহাগ–খাম্বাজ দাদরা
ওই কাজল-কালো চোখ
আদি কবির আদি রসের
যেন দুটি শ্লোক।
ওই কাজল-কালো চোখ॥
পুষ্প-লতার পত্রপুটে
দুটি কুসুম আছে ফুটে,
সেই আলোকে রেঙে ওঠে
বনের গহন লোক (গো)
আমার মনের গহন লোক॥
রূপের সায়র সাঁতরে বেড়ায়
পানকৌড়ি পাখি
ওই কাজল-কালো আঁখি।
মদির আঁখির নীল পেয়ালায়
শরাব বিলাও নাকি,
মদালসা সাকি!
তারার মতো তন্দ্রাহারা
তোমার দুটি আঁখিতারা
আমার চোখে চেয়ে চেয়ে
অশ্রুসজল হোক॥
ওরে ও স্রোতের ফুল
যোগিয়া একতালা
ওরে ও স্রোতের ফুল!
ভেসে ভেসে হায় এলি অসহায়
কোথায় পথ-বেভুল॥
কোল খালি করে কোন লতিকার
নিভাইয়া নয়নের জ্যোতি কার,
বনের কুসুম অকূল পাথারে
খুঁজিয়া ফিরিস কূল॥
ভবনের স্নেহ নারিল রাখিতে
ঠেলে ফেলে দিল যারে,
সারা ভুবনের স্নেহ কি কখনও
তাহারে ধরিতে পারে?
জল নয়, তোর জননী যে ভুঁই,
অভিমানী! সেথা চল ফিরে তুই,
ধূলিতেও যদি ঝরিস সেথায়
স্বর্গ সেই অতুল॥
কলঙ্ক আর জোছনায়-মেশা তুমি সুন্দর চাঁদ
বেহাগ মিশ্র দাদরা
কলঙ্ক আর জোছনায়-মেশা
তুমি সুন্দর চাঁদ।
জাগালে জোয়ার ভাঙিলে আবার
সাগর-কূলের বাঁধ॥
তিথিতে তিথিতে সুদূর অতিথি
ভোলাও জাগাও ভুলে-যাওয়া স্মৃতি,
এড়াইতে গিয়ে পরানে জড়াই
তোমার রূপের ফাঁদ॥
চাহি না তোমায়, তবু তোমারেই
ভাবি বাতায়নে বসি,
আমার নিশীথে তুমিই এনেছ
শুক্লা চতুর্দশী।
সুন্দর তুমি, তবু ভয় মনে
আছে কলঙ্ক জ্যোছনার সনে,
মুখোমুখি বসে কাঁদি তাই বুকে
সাধ আর অবসাদ।
কাজরি গাহিয়া চলো গোপ-ললনা
কাজরি লাউনি
কাজরি গাহিয়া চলো গোপ-ললনা।
শ্রাবণ-গগনে দোলে মেঘ-দোলনা॥
পরো সবুজ ঘাগরি চোলি নীল ওড়না,
মাখো অধরে মধুর হাসি, চোখে ছলনা॥
কদম-চন্দ্রহার পরে এসো চন্দ্রাবলী,
তমাল-শাখা-বরনা এসো বিশাখা-শ্যামলী।
বাজায় করতাল দূরে তাল-বনা॥
লাবণি-বিগলিতা এসো সকরুণ ললিতা,
যমুনাকূলে এসো ব্রজবধূ কুল-ভীতা,
অলকে মাখিয়া নব জলকণা॥
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে
সিন্ধুড়া কাওয়ালি
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে, — চিনি চিনি।
প্রাণের মাঝে সদা শুনি তারই রাগিণী॥
চিনি চিনি॥
বন-শিরীষের জিরিজিরি পাতায়
ধীরি ধীরি ঝিরিঝিরি নূপুর বাজায়,
তমাল-ছায়ায় বেড়ায় ঘুরে মায়া-হরিণী॥
চিনি চিনি॥
আমার প্রাণে তারই চরণের অনুরণনে
ছন্দ জাগে গন্ধে রসে রূপে বরনে।
কান পেতে রই দুয়ার-পাশে
তারই আসার আভাস আসে,
ঝংকার তোলে মনের বীণায় বীণ-বাদিনী –
চিনি চিনি॥
কুঙ্কুম আবির ফাগের লয়ে থালিকা
কালাংড়া খেমটা
কুঙ্কুম আবির ফাগের
লয়ে থালিকা
খেলিছে ‘রসিয়া’ হোরি
ব্রজ-বালিকা॥
হোরির অনুরাগে
যমুনায় দোলা লাগে,
রাঙা কুসুম হানে
শ্যামে মাধবিকা॥
রঙের গাগরিতে,
রঙিলা ঘাগরিতে,
হোরির মাতন লাগায়
নাগর-নাগরিকা॥
জেগেছে রঙের নেশা
মাধবী মধু-মেশা,
মনের বনে দোলে
রাঙা ফুল-মালিকা॥
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি
হিন্দোল মিশ্র তেওড়া
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি।
আকাশ কাঁপে সে সুর শুনে সর্বনাশী॥
বন ঢেলে দেয় উজাড় করে
ফুলের ডালা চরণ পরে,
নীল গগনে ছুটে আসে মেঘের রাশি॥
বিপুল ঢেউয়ের নাগরদোলায় সাগর দুলে,
বান ডেকে যায় শীর্ণা নদীর কূলে কূলে।
তোমার প্রলয়-মহোৎসবে
বন্ধু ওগো, ডাকবে কবে?
ভাঙবে আমার ঘরের বাঁধন
কাঁদন হাসি॥
কে পরাল মুণ্ডমালা আমার শ্যামা মায়ের গলে
ভূপালি দাদরা
কে পরাল মুণ্ডমালা
আমার শ্যামা মায়ের গলে।
সহস্রদল জীবন-কমল
দোলে রে যাঁর চরণ-তলে॥
কে বলে মোর মা-কে কালো,
মায়ের হাসি দিনের আলো,
মায়ের আমার গায়ের জ্যোতি
গগন-পবন-জলে-স্থলে॥
শিবের বুকে চরণ যাঁহার
কেশব যাঁরে পায় না ধ্যানে,
শব নিয়ে সে রয় শ্মশানে
কে জানে কোন অভিমানে!
সৃষ্টিরে মা রয় আবরি,
সেই মা নাকি দিগম্বরী?
(তাঁরে) অসুরে কয় ভয়ংকরী
ভক্ত তাঁয় অভয়া বলে॥
কোয়েলা কুহু কুহু ডাকে
খাম্বাজ ঠুংরি
কোয়েলা কুহু কুহু ডাকে।
নব মুকুলিত আমের শাখে॥
যাহার দরশ লাগি
একেলা কুটিরে জাগি,
মোর সাথে পাখিও কি
ডাকিছে তাহাকে॥
চাঁদিনি নিভে যায় আমার চোখে,
চাঁদে মনে পড়ে চাঁদের আলোকে।
কুহু স্বর প্রাণে মম
বাজিতেছে তার সম,
চাঁদিনি নিশীথ মোর
বিষাদ-মেঘে ঢাকে॥
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
(গ্রীষ্ম)
কামোদ–শ্রী দাদরা
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
তপ্ত গগনে জাগি।
রুদ্র তাপস সন্ন্যাসী বৈরাগী॥
সহসা কখন বৈকালি ঝড়ে
পিঙ্গল মম জটা খুলে পড়ে,
যোগী শংকর প্রলয়ংকর
জাগে চিত্তে ধেয়ান ভাঙি॥
শুষ্ক কণ্ঠে শ্রান্ত ফটিকজল,
ক্লান্ত কপোত কাঁদায় কাননতল,
চরণে লুটায় তৃষিতা ধরণি
আমার শরণ মাগি॥
ঘুমাও ঘুমাও দেখিতে এসেছি
যোগিয়া মিশ্র দাদরা
ঘুমাও, ঘুমাও! দেখিতে এসেছি,
ভাঙিতে আসিনি ঘুম।
কেউ জেগে কাঁদে, কারও চোখে নামে
নিদালির মরশুম॥
দেখিতে এলাম হয়ে কুতূহলি
চাঁপা ফুল দিয়ে তৈরি পুতলি,
দেখি, শয্যায় স্তূপ হয়ে আছে
জ্যোৎস্নার কুঙ্কুম।
আমি নয়, ওই কলঙ্কী চাঁদ
নয়নে হেনেছে চুম॥
রাগ করিয়ো না, অনুরাগ হতে
রাগ আরও ভালো লাগে,
তৃষ্ণাতুরের কেউ জল চায়
কেউ বা শিরাজি মাগে!
মনে কর, আমি ফুলের সুবাস,
চোর জ্যোৎস্না, লোলুপ বাতাস,
ইহাদের সাথে চলে যাব প্রাতে
অগোচর নিঝঝুম॥