দুরকম গর্ভপাত আছে। বৈধ এবং অবৈধ। বৈধ এবং অবৈধের মধ্যে সূক্ষ্ম সুতোর ব্যবধান। গর্ভপাত করা বৈধ, কিন্তু লিঙ্গ নির্ণয়ের পর গর্ভপাত অবৈধ। একজন মেয়ে তার গর্ভপাত বৈধভাবে ঘটাতে পারে যদি ভ্রুণে কোনও অস্বাভাবিকতা পায়। কিন্তু স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের মধ্যে পার্থক্যটা কী? ডাক্তারি বিত্তানে যে ভ্রুণকে অস্বাভাবিক ভ্রুণ বলে সেটি আর সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েভ্রুণ — এ দুটো এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিকভাবে দু ভ্রুণই অনাকাঙ্ক্ষিত।
অস্বাভাবিক বা পঙ্গু ভ্রুণ এবং মেয়ে ভ্রুণ এ দুটোকে জন্মাতে দিলে অনেক খরচ। মানসিক সুস্থতা আর থাকবে না, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। তার চেয়ে এদের না জন্মাতে দেওয়াই ভালো। এই হল মেয়েভ্রুণহত্যায় বিশ্বাসীদের মত।
গর্ভপাতের ক্লিনিকগুলো একটা বিত্তাপন দেয়। ‘পাঁচশ টাকা খরচা কর, ৫০,০০০ টাকা বাঁচবে।’ অর্থাৎ ‘একে মার। এ বেঁচে থাকলে তোর পত্তাশ হাজার টাকা যাবে পণে।’ এক ২০০৫ সালেই আলট্রাসাউন্ডএর কারখানাই গড়া হয় ৫০০ কোটি টাকার। পুত্রপিপাসুদের জন্য লিঙ্গনির্ণায়ক ক্লিনিকগুলো হল আধুনিক মন্দির।
গর্ভপাতের অধিকারের জন্য ইওরোপ আমেরিকায় দীর্ঘ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে মেয়েদের। গর্ভপাতের অধিকার পাওয়া নারীস্বাধীনতার পক্ষে বিরাট ঘটনা। কিন্তু ভারতবর্ষে একটি বিশেষ লিঙ্গের কারণে যখন গর্ভপাত ঘটানো হয়, এবং সে লিঙ্গটি স্ত্রীলিঙ্গ, তার সঙ্গে তখন আর নারীস্বাধীনতার সম্পর্ক তো থাকেই না, বরং অঙ্গাঙ্গী যুক্ত থাকে নারীর পরাধীনতার করুণ কাহিনী।
ভারতীয়রা যে দেশেই বাস করতে যায়, এক টুকরো ভারতকে সঙ্গে নিয়ে যায়। ইওরোপ আমেরিকায় যেখানেই বাস করুক, পুত্রলিপ্সা তাদের মরে না। ওখান থেকে খরচ কম বলে ভারতে চলে এসে গর্ভপাত ঘটায়। আরও নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার হদিস পাওয়া গেছে, ভ্রুণের অসুখ দেখার আধুনিক পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নিয়ে গোপনে লিঙ্গ দেখছে তারা। ভ্রুণ যদি ভুল লিঙ্গের হয়, চোখ বুজে হত্যা। নিউ জার্সির ভারতীয় পরিবারে মেয়েশিশুর সংখ্যা পাত্তাব হরিয়ানার চেয়ে কিছু বেশি নয়। ভারতীয় মেয়েরা অনেকটা এখন বিলুপ্ত হতে যাওয়া প্রাণী। এনডেনজারড, বাঘের চেয়েও।
আইন দেখাতে গিয়েছিল কেউ কেউ। যে মেয়েরা মেরে ফেলছে নিজের সন্তান, তারা চেঁচিয়ে বললো, ‘আইন? আইন আবার কী? আইন কি আমাকে সাহায্য করতে আসবে যখন আমি আরেকটি কন্যা জন্ম দিলে আমার স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে! আইন কি আমাকে সাহায্য করবে যখন আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করবে পুত্রসন্তানের আশায়? আইন কি সমাজের সেই চোখকে বদলাতে পারবে যে চোখ আমাকে মূল্য দেবে না যেহেতু আমার পুত্রসন্তান নেই!’
পুরোনো মেয়েশিশুহত্যার জায়গায় এখন আধুনিক সঙ্গে সিলেকটিভ অ্যাবরশান এসেছে। ডিএনএ টেস্ট, প্রি-জেনেটিক ডায়াগনোসিস টেস্ট। আরও হাই টেক। মেয়েবর্জিত সমাজ চাই, চাইই চাই। সমাজ তো প্রস্তুত নয় মেয়েসন্তানকে মর্যাদা দিতে। কিন্তু আইন বলছে মেয়েসন্তানকে হত্যা করা যাবে না। এদিকে মেয়েরা কারণ দেখিয়ে যাচ্ছে কেন তারা হত্যা করছে তাদের নিজের সন্তানকে। কারণ সমাজ পুত্র চায়, পরিবার পুত্র চায়। পুত্র না জন্ম দিলে জীবনে অশান্তি হচ্ছে। সোজা কথা, সমাজ যেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, যেটা মানুষের অন্তরে, মুখে অন্য যা কিছু বলুক না কেন, যে, ‘তোমার যদি দুটো পুত্র থাকে, তোমার দুটো চোখ আছে। যদি একটা পুত্র থাকে, এক চোখ অন্ধ। আর যদি তোমার দুটো কন্যা থাকে, তুমি সম্পূর্ণই অন্ধ।’ আইন ভাঙা হচ্ছে। সবাই ভাঙছে। ডাক্তার, নার্স, ধাই, ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল সবাই। ৯৪ সালে লিঙ্গ-দেখা পরীক্ষা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও কারও যেন কিছু যায় আসে না। মানুষের মানসিকতা না পাল্টালে আইন প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার মানসিকতাও পাল্টাবে না যতক্ষণ না আইন প্রণয়ন হবে। কিন্তু এই মানসিকতা, এই নারীবিরোধী মানসিকতা নিয়ে কি মানুষ জন্মায়? তা তো নয়, এ তৈরি করা।
সমাজে অপরাধ যখন বাড়তে থাকে, মেয়ের মূল্যও হু হু করে কমতে থাকে। স্ক্যান মেশিনগুলো যে হয়ে উঠবে এক একটি মানুষ মারার অস্ত্র, তা কে জানতো! পাত্তাব হরিয়ানায় মেয়েশিশুহত্যা ইদানীং ফিরে আসছে। যেহেতু মেয়েভ্রুণহত্যা এখন দিনকে দিন কঠিন হচ্ছে। বেআইনি, তার ওপর এনজিওগুলো ওত পেতে আছে অপরাধী ধরার জন্য। যে সব গ্রামে মেয়েশিশুর সংখ্যা কম, সেসব গ্রামে নার্স বা ধাই মানেই কিন্তু ভয়ংকর। বুঝে নিতে হবে, এই জীবনের দূতগুলোই আসলে মৃত্যুর দূত।
কেন তারা গর্ভপাত ঘটাচ্ছে, কেন মেয়েশিশুকে বাঁচতে দিচ্ছে না। মেয়েরা বলেছে, ‘কেন আমরা বাঁচতে দেব? আমরা কোনও মেয়ে চাই না। কেন আমরা মেয়েদের জন্মাতে দেবো আমরা যে কষ্ট পাচ্ছি তা পাওয়ার জন্য?’ তারা বলে, ‘বেঁচে থেকে আমাদের কী লাভ হচ্ছে? দুঃসহ জীবন শুরু হওয়ার আগেই মরে যাওয়া ভালো। দুনিয়ায় লাত্থি গুতো খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সোজা স্বর্গে যাওয়াই ভালো।’ তারা কি ভুল বলে?
পাঞ্জাব হরিয়ানায় এখন ব্যাকল্যাশ শুরু হয়েছে। পাঁচ ভাই-এর এক বউ। বউ কোথায় পাবে, গ্রামে কোনও মেয়ে নেই। বড় ভাইয়ের বউকে বাকি ভাইয়েরা ব্যবহার করছে। এ ছাড়া উপায় নেই। ‘দ্রৌপদী সিনড্রোম’ যাকে বলে। ঙ্গিপালা কুমারি নামে ঝাড়খজ্ঞের এক উপজাতি মেয়েকে এক লোক চাকরি দেবে বলে হরিয়ানায় নিয়ে যায়। সেখানে আজমের সিং নামের এক লোক তাকে বিয়ে করে এবং বলে তার আর ভাইয়ের সঙ্গে শুতে। মেয়ে রাজি হয়নি বলে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল।