আহা, উনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের মডেল করে যত বিখ্যাত রংচিত্র আর ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে, আজ দেখলে কি মনে হবে না, সব মেয়েই বুঝি ন’ মাসের গর্ভবতী ছিল! মেয়েদের যে শরীরটিকে কিছুকাল আগেও স্বাভাবিক বলে ভাবা হত, আজ সেটিকে অস্বাভাবিক বলা হচ্ছে। মেয়েদের শরীর কী হবে কেমন হবে তার সিদ্ধান্ত মেয়েরা কোনওদিনই নিতে পারেনি। যে মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের কোলাবরেটর হিসেবে নাম করছে, সেই আধুনিক মেয়েরা এখন মেয়েদের সাজাবার দায়িত্ব নিয়েছে। পণ্যকে আরও আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে পুরুষের সামনে পরিবেশন করার দায়িত্ব।
‘মেয়েরা সুন্দর’, — নারী-প্রগতির বিরুদ্ধে এটি একটি ধারালো রাজনৈতিক অস্ত্র। মেয়েদের এই সৌন্দর্য যেন টিকে থাকে, তারা যেন অসুন্দর হিসেবে চিহ্নিত না হয়—এই চাপটি মেয়েদের ওপর প্রচণ্ড। তাদের এখন দিনরাত গাধার খাটনি খাটতে হচ্ছে, অঢেল খরচা করতে হচ্ছে প্রসাধনের পেছনে। দিনে কত কোটি টাকার প্রসাধন সামগ্রী মেয়েরা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে! মুখে, গালে, নাকে, চোখে, ভুরুতে, চুলে, চিবুকে মাখবার জন্য কত রং, কত কেমিক্যাল, কত আঠা, কত কালির এখন রমরমা বাজার! কেন? মুখ যা আছে তার, তা যথেষ্ট নয়? গাল চোখ ভুরু পারফেক্ট নয়? মেয়েরা তবে কি জন্মায় ‘ইমপারফেক্ট’ হয়ে? অ্যাবনরমাল হয়ে? পঙ্গু হয়ে? তাই কি তাদের এটা ঝরিয়ে, ওটা বাড়িয়ে, এটা মাখিয়ে, ওটা তাড়িয়ে পারফেক্ট হতে হবে! তাদের পঙ্গুত্ব দূর করতে হবে? নিজেদের পারফেক্ট বানানোর দায়িত্ব যে মেয়েরা নিচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করে যে এছাড়া তারা ঠিক ‘সঠিক’ বা ‘সম্পূর্ণ’ নয়। এই মিথ্যেটি তারা ত্তানে বা অত্তানে স্বীকার করে বা মেনে নেয়। এই মিথ্যেটি মেনে নেওয়া মানে মেয়েদের মানুষ বলে মোটেও মূল্য না দেওয়া। এই মিথ্যেটি মেনে নেওয়া মানে মেয়েদের ঘৃণা করা, জঘন্যভাবে তাদের অপমান করা, এবং তাদের পণ্য করার রাজনীতিতে সক্তিয় অংশগ্রহণ করা।
মেয়েরা দেখতে কেমন হবে, তার বিত্তাপন সবখানে। সিনেমায়, টিভিতে, বিলবোর্ডে, পত্রিকায়, পুতুলে। নিস্তার নেই। সৌন্দর্যের গ্যাঁড়াকলে মেয়েদের এমন আটকে দেওয়া হয়েছে যে সৌন্দর্যচর্চার পেছনেই ব্যয় করতে হবে জীবন, জীবনের সব উপার্জন। নিজের অধিকার-অনধিকার বিষয়ে ভাবনার কোনও অবকাশ পাবে না। গাঁটের টাকা এমন ফুরোবে চর্চায়, যে, শেষ সম্বল বলেও কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। ধূর্ত জালে আটকা পড়েছে আমাদের চারাপোনারা। জরিপ করলে দেখা যাবে শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে মনে করছে তারা যথেষ্ট সুন্দর নয়, বুকগুলো ছোট, ঠ্যাংগুলো চিকন, কোমরটা মোটা, পাছাটা বেঢপ, চুলগুলো পাতলা, রংটা ময়লা, নাকটা বোঁচা, চোখদুটো ছোট, চামড়াটা কোঁচকানো — নিজের শরীরের কিছু না কিছু নিয়ে মেয়েদের অসন্তোষ আর গ্লানি দিন দিন বাড়ছে। মেয়েদের নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার রাজনীতিটি ভয়ংকর। আত্মবিশ্বাস না থাকলে, নিজেকে নিয়ে ভয়ভাবনা দূর না হলে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস এবং শক্তি দুটোই কর্পূরের মতো উবে তো যায়ই, নিজের স্বাধীনতার প্রশ্নে জরুরি সচেতনতাও মরে পচে নষ্ট হয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক এই যে, শিক্ষা স্বনির্ভরতা মেয়েদের সামনে এগিয়ে নিচ্ছে এক পা, পিছিয়ে নিচ্ছে দুই পা। শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়েদের মধ্যে নিজের শরীর নিয়ে হতাশা হুহু করে বাড়ছে, বাড়ছে বলেই সমস্ত মেধা খরচ হচ্ছে শরীরের পেছনে। মৌলিকতা বিদেয় করে কৃঙ্গিমতা দিয়ে তারা এমন মুড়ে রাখার চেষ্টা করে শরীর, যেন এ শরীর প্রসাধন বাণিজ্য, প্রচার মাধ্যম আর পুরুষতন্ত্রের যোগসাজসে প্রস্তাবিত নারীর শরীরের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। মিলে গেলেই জয়। নারীকে এভাবেই জয়ী হতে শিখিয়েছে সমাজ। নারীর বোধ বুদ্ধি বিসর্জন দিতে এভাবেই নারী শিখেছে।
আজকালকার মেয়েদের থেকে শুধু তাদের দিদিমারা নয়, দিদিমাদের মা- দিদিমারাও এ ব্যাপারে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। সুন্দর হওয়ার চাপ তাদের ওপর ছিল না। দাসী হওয়ার গুণ থাকলেই চলতো তখন। এখন শুধু দাসী হলেই চলবে না, ‘রূপসী দাসী’ হতে হবে। সঠিক মাপের বুক কোমর ঠ্যাং নিতম্ব না হলে পাশ হবে না। ত্বক টানটান না হলে, ত্বকে সঠিক রং না হলে পাশ নেই। জগত পুরুষের, সমাজ সংসার পুরুষের, এখানে নারী আসলে গোটাটাই ‘শরীর’, আর কিছু নয়।
পুরুষতন্ত্রের নিয়মই হল, মানুষ হিসেবে মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করা, মেয়েদের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার না করা, নিজেদের স্বার্থে মেয়েদের ব্যবহার করা। মেয়েদের মূল্য না দেওয়া। নারী-অধিকার আন্দোলনের ফলে যখনই মেয়েদের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলে, তখনই তা যে করেই হোক কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা পুরুষতন্ত্রের পবিত্ত কর্তব্য।
মেয়েদের মূল্য যখন কমতে থাকে, শরীরই মেয়েদের একমাত্র পরিচয়পত্র হয়ে দাঁড়ায়, যেটি দেখিয়ে তার জীবন চলে। মূল্য কমলে মেয়েদের সাজগোজ বাড়ে, বিউটি পার্লারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূল্য কমলে পণের টাকা বাড়ে। গৃহবধূত্ব বাড়ে। বেশ্যাবৃঙ্গি বাড়ে। কন্যাভ্রুণহত্যা বাড়ে। গৃহনিগ্রহ বাড়ে। ধর্ষণ বাড়ে। নারীহত্যা বাড়ে। সমাজে মেয়েদের মূল্য কম বলেই নারীবিরোধী সব ক্তিয়াকাণ্ড এত নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্তে চলতে পারছে।