পাশে থাকা মানে কিন্তু এই নয় যে তার সঙ্গে পে্রতিরাতে আমার বিছানা ভাগ করতে হবে বা তার সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে হবে। হৃদয়ে যে থাকে, সে যোজন দূরে থাকলেও হৃদয়ে থাকে। তার সঙ্গে যখন আমার ইচ্ছে হবে, শরীর বিনিময় করবো। আমার বাড়িতে, অথবা তার, অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু রাঙ্গির বারোটার মধ্যেই আমার বাড়ি থেকে তাকে বেরোতে হবে। তাকে অসম্মান করে বের করে দিচ্ছি না। ভালোবেসে চুমু খেতে খেতেই তাকে দরজা দেখিয়ে দিচ্ছি। কখনও রাতও কাটাতে পারে একসঙ্গে তবে আমার বাড়ির অতিথি হয়ে, সদস্য হয়ে নয়। এ আমার সিদ্ধান্ত, প্রেমিকের সঙ্গে ততদিন আমি একত্রবাস করবো না যতদিন না প্রেমিকের মাথা থেকে পুরুষতন্ত্রের শেষ কণাটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়। বিয়েতে আমি বিশ্বাস করি না। লিভ টুগেদার বা একত্রবাসে বিশ্বাস অনেককাল করেছি, এখন তাও করি না। কারণ একত্রবাসে পুরুষের স্বরূপ অল্প কিছুদিনেই এমন বিকট আকারে বেরিয়ে আসে যে পুরুষটি নিজেকে স্বামী ভাবতে শুরু করে, এবং স্বামীরা যে ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার মেয়েদের করে, ঠিক তাই তাই করতে শুরু করে দেয়। এই ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একত্রবাসের বদলে আমি তাই গভীরভাবে পৃথকবাসে বিশ্বাসী। পশ্চিমের পুরুষের বেলায়ও আমার আদর্শ একই। পুব পশ্চিমের পুরুষের চেহারা শুরুতে একটু হেরফের থাকতে পারে, কিন্তু পুরুষ মূলত একই। ভেতরের মশলাটা এক।
একা থাকার আনন্দ আমি জানি। একা থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, নিজের ওপর শ্রদ্ধা বাড়ে। একা থাকলে মনের জোর বাড়ে, নিজে কী এবং কে, সে সম্পর্কে ধারণা গাঢ় হয়। একা থাকলে অন্যকে তুষ্ট তৃপ্ত করে তোলার দাস-দায়িত্ব থাকে না ঘাড়ে। স্বাধীনতার সত্যিকার অর্থ অনুধাবন করা যায়। একা থাকলে জীবনকে আদ্যোপান্ত উপভোগ করা যায়। জীবন তো মানুষের একটিই এবং সব কিছুর পর, সব কোলাহলের শেষে মানুষ তো আসলে একাই।
আমি জাত গোত্র সম্প্রদায় ইত্যাদিতে বিশ্বাস করি না। যারা মানুষকে নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে, তারাই তো সাম্প্রদায়িক। লিঙ্গ-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-জাত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমি মানুষকে মানুষ বলে বিচার করি।
১০. অসভ্যতা
কদিন পর পর আজগুবি আর উদ্ভট সব কাণ্ড ঘটায় মুসলমান উগ্রপন্থীরা । সকলে হাঁ হয়ে দেখে এসব। বোমা মেরে এটা সেটা উড়িয়ে দেওয়া, ত্রাস সৃষ্টি করা — এসব তো আছেই, এসব হয়তো যে কোনও সন্ত্রাসী দলই করে বা করতে পারে, ধর্ম তাদের যা-ই হোক না কেন। কিন্তু কদিন পর পরই মেয়েদের নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ খেলে পুরো ভারতবাসীকে চমকে দেওয়ার কাজ ওরাই করছে। দেখে মনে হয় একরকম দায়িত্বই ওরা নিয়েছে এ-কাজের। আমি বলতে চাইছি না অমুসলমান মেয়েদের নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ হয় না, বলছি না যে তারা অফুরন্ত স্বাধীনতা ভোগ করছে। মোটেও তা নয়। ভারতবর্ষের মেয়েরা সর্বত্রই কম বেশি দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি। তবে অমুসলমান মেয়েদের ওপর যে অসভ্যতা চলে, সেসব অসভ্যতার একটা সীমা আছে। কিন্তু মুসলমান মেয়ের ওপর অসভ্যতা প্রায়ই সীমা ছাড়িয়ে যায়। মেয়েরা যে কেবলই পুরুষের যৌনইচ্ছে মেটাবার খেলনা, কেবলই যে পুরুষের সুখভোগের বস্তু, কেবলই যে পুরুষের দাসী বা ক্রীতদাসী — তা এত তীব্র করে অন্য কেউ বোঝায় না, যত বোঝায় মুসলমান পুরুষেরা। শ্বশুর ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ পুরুষমাত্রই হয় মনে মনে নয় শরীরে শরীরে করে — পুরুষাঙ্গে তাদের মুসলমানি বা খৎনা নামের ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক। কিন্তু তাই বলে ধর্ষককে স্বামী বলে মানতে হবে! এরকম ফতোয়া জগতের সেরা অসভ্যরাও কোনওকালে দিয়েছে বলে শুনিনি। মুসলমান-মৌলবাদীদের অসভ্যতার অবশ্য দেশকালপাত্র ভেদ নেই। ধর্ষক-শ্বশুর স্বামী বনে যাবে, নিজের স্বামী বনে যাবে নিজের ছেলে – এসব কি লোক হাসানো ছাড়া আর কিছু? যদি ঠাকুরদা ধর্ষক হয় তিন বছরের শিশুর? তবে কি শিশুটিকে হতে হবে ঠাকুরদার স্ত্রী? শিশুটির বাবা হবে শিশুটির ছেলে? শিশুটির মাকে হতে হবে শিশুটির পুত্রবধূ? এই তো মনে হচ্ছে ওদের বিচার!
এসব শুনলে গা হাত পা ঠাত্তা হয়ে আসে। গুড়িয়াকে নিয়েও ‘ছেলেখেলা’ চলেছিল। ‘এই স্বামীর সঙ্গে বাস করা চলবে না, ওই স্বামীর সঙ্গে বাস কর।’ গুড়িয়ার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য কেউ দেয়নি। তা দেবে কেন! মেয়েরা তো মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছু নয়, মেয়েদের তো ‘মস্তিস্ক নেই, মগজ নেই, মাথা নেই’। তাদের আবার ইচ্ছে কী, অনিচ্ছে কী! ইমরানার বেলাতেও তাই। ইমরানার ইচ্ছে অনিচ্ছের ধার ধারার জন্য কেউ বসে নেই কোথাও। তাকে ধর্ষক-শ্বশুরের অবাধ কামের, পত্তায়েতের অশ্লীল অন্যায়ের আর মুসলিম ল বোর্ডের অবিশ্বাস্য অসভ্যতার শিকার হতে হয়। ধর্মতন্ত্রে এবং পুরুষতন্ত্রে বুঁদ হয়ে তাকে নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ খেলেই চলেছে মানুষ। ‘ছেলেখেলা’ না বলে একে এখন ‘পুরুষখেলা’ই বলা ভালো। ছেলেখেলা এত ভয়ঙ্কর হয় না, যত ভয়ঙ্কর হয় ‘পুরুষখেলা’। ‘ছেলেখেলা’য় উদ্দেশ্য এত কুৎসিত থাকে না, যত কুৎসিত থাকে পুরুষখেলায়। পুরুষ যখন খেলে, নারীকে চিরকালই পায়ের তলায় পিষে মারতে পারার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য খেলে। ‘আজ খেলে জিতে গেলাম, হিপ হিপ হুররে’ – অমন ‘ছেলেখেলা’ হয়তো তারা ছেলেবয়সে খেলতো, পুরুষবয়সে আর খেলে না। পুরুষবয়সে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে। চিরকালই খেলতে পারার বন্দোবস্ত। নিজেদের চিরস্থায়ী আরামের আমোদের আয়েশের বন্দোবস্ত। পুরুষের হাতের মুঠোয় ধর্ম, হাতের মুঠোয় সমাজ, হাতের মুঠোয় রাজনীতি অর্থনীতি। এগুলো যেন সহজে পুরুষের মুঠোবন্দি হয়, তার জন্য নারী কম ত্যাগ, কম তিতিক্ষা এ যাবৎ করেনি। নারী যদি নিজেকে নিঃস্ব ক’রে পুরুষকে শক্তিমান, শৌর্যবান না করে, তবে সে আর নারী কিসে! এই বিশ্বাসে ভর করে পুরুষের সংত্তা মেনে চমৎকার আদর্শ নারী হয়ে উঠেছে নারীকুল। এই নিঃস্ব রিক্ত নারীকে কথায় কথায় পুরুষেরা গুঁতো দিলে, লাথি দিলে, চেপে মারলে, টিপে মারলে, মুচড়ে মারলে, পুড়িয়ে মারলে, পুঁতে মারলে, ডুবিয়ে মারলে, কুপিয়ে মারলে কার কী বলার আছে? কিচ্ছু বলার নেই কারওর।