নারীরা কাজের মেয়েকে নির্যাতন করছে। সমাজের এক নির্যাতিত শ্রেণী সমাজের আরেক নির্যাতিত শ্রেণীকে নির্যাতন করছে। এই ছোট নির্যাতন আমাদের চোখে পড়ে, আর বড় নির্যাতন, যেটি ক্ষমতাশালীরা করে, দরিদ্রকে আজীবন দরিদ্র করে রাখার রাজনীতি, সমতার সমাজকে ধারে কাছে ভিড়তে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র, — সেটি খুব বেশি কারওর চোখে পড়ে না।
গোমাংস নিষিদ্ধ
কী করতে যে দেশটা ভাগ হয়েছিল! কোনও দেশই তো পুরোপুরি হিন্দুর দেশ বা মুসলমানের দেশ হতে পারেনি। মাঝখান থেকে খুনোখুনিটা বাড়ছে। বাংলাদেশে নামকরা হিন্দু হও, টিকে যাবে। মহাদেব সাহা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, সৌম্য সরকার, মুন্নী সাহা –এরা সেলেব্রিটি হিন্দু। এঁদের দেশ ছাড়ার দরকার কখনও হবে না। কিছু মুসলমান ভারতেও খুব নামীদামী। বলিউডের শাহরুখ খান, সালমান খান, আমীর খান তো আছেনই, রাজনীতি, সাহিত্য শিল্পের জগতেও মুসলমানরা সেলেব্রিটি। এ আর রহমানের কথাই ধরা যাক। ভারতীয়রা তাঁদের নিয়ে গর্বিত। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দুরা ভুগছে, ভারতের সাধারণ মুসলমানরাও মাঝে মাঝে ভোগে। কিছুদিন আগে ইখলাক নামের এক লোককে যে মেরে ফেলা হলো গোমাংস খেয়েছে বলে, তা নিয়ে এখন ভারত ভীষণরকম দুভাগে ভাগ হয়ে আছে। একদল বামঘেঁষা, উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, আরেকদল কট্টর ডানপন্থী, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, মুসলিম বিরোধী। এই দুই দলে পত্র পত্রিকায়, টিভিতে, ব্লগে, টুইটার ফেসবুকে গালাগালি চুলোচুলি করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সাহিত্যিকরা তাঁদের পুরস্কার ফেরত দিচ্ছেন। ডানপন্থীরা এই পুরস্কার ফেরত দেওয়া মোটেও পছন্দ করছে না। এখন তো বিজ্ঞানীরাও, চলচ্চিত্র পরিচালকরাও তাঁদের জাতীয় পুরস্কার ফেরত দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মতো প্রতিবাদ করছেন। অনেক কট্টর ডানপন্থী লোক, শিল্পী সাহিত্যিক যারা পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের গালমন্দ করছে। এই বলে দোষ দিচ্ছে যে অন্যায় তো আগেও ঘটেছে, মুসলমান মৌলবাদীরা সালমান রুশদি বা তসলিমা নাসরিনের ওপর যখন আক্রমণ করেছে, তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? তখন কেন আপনাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেননি। তখন পুরস্কার ফেরত দেননি বলে এখন দিতে পারবেন না, এ আমি মানি না। তখন প্রতিবাদ করেননি বলে এখন প্রতিবাদ করবেন না, তা ঠিক নয়। তখন না হয় বিবেক জাগেনি, এখন জেগেছে। যখনই জাগুক, জাগাটাই জরুরি। এতে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে অনেকে। রাজনীতি কোথায় নেই! শিল্পী সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে নেই, কে বলেছে?
আমি কিন্তু এসব বিতর্কের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। কিন্তু মত জানতে চাইলে ঝট করে সেদিন নিজের মত জানিয়ে দিয়েছি। আমার কথা, দেশে গোমাংসের জন্য মরতে হচ্ছে, এমন খারাপ দিন আগে কখনও দেখিনি। ভারতে প্রায় দশ বছর আমি বাস করেছি। কখনো গোমাংস কিনিনি। খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, মুরগির মাংসই কেনা হয়েছে। কবুতরের আর হাঁসের মাংস কিনতে চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি কোথাও। এদেশে গোমাংসের দুটো গল্প আছে আমার। প্রথম গল্পটি আশির দশকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। উনি আমার কাছে আবদার করলেন, গোমাংস খাবেন। গোমাংস বাংলাদেশ থেকে আনতে হবে। আমাকে কথা দিতে হলো, ফের যখন আসবো কলকাতায় বেড়াতে, গোমাংস নিয়ে আসবো। নিয়ে এসেছিলাম। তিনি খুশিতে উঠোনময় নেচেছিলেন। দ্বিতীয় গল্পটি দুহাজার পাঁচের দিকে। তখন আমি কলকাতায় থাকি, আমার এক বন্ধু সুমিতাভ ঘোষালের শখ হলো সে গরুর মাংস খায়নি কখনও, খাবে। আমি যদি রান্না করে দিই, তবেই সে তার স্বপ্ন পুরন করতে পারবে। একবার সে এক কিলো গরুর মাংস পার্ক সার্কাসের কোনও এক মুসলিম দোকান থেকে কিনে আমার বাড়িতে এলো। মাংসগুলো দেখে খুব ভালো কোয়ালিটির মাংস বলে আমার মনে হলো না। সুমিতাভের আবদারে আমার সেদিন রান্না করতে হয়েছিল গরুর মাংস। তবে বাড়ির কাজের মেয়েটিকে আমি মাংস রান্নার ধারে কাছে আসতে দিই নি, তাকে খেতেও দিইনি ওই মাংস। মাংসের জন্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা কাটতে হয়, ওসবও আমি নিজে কেটে নিয়েছি। ওকে কাজ থেকে ছুট্টি দিয়ে দিয়েছিলাম সারাদিনের জন্য। বলবো না আমি ওর অন্ধ বিশ্বাসের শুশ্রষা করেছি, নিতান্তই ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের মর্যাদা দিয়েছি মাত্র। শুধু সুমিতাভ আর আমি খেয়েছি সেদিনের রান্না করা মাংস। ইউরোপ আমেরিকায় যে গোমাংস আমি খাই, সে খুব ভালো জাতের। বাংলাদেশ বা ভারতের গোমাংসের মতো নয়। আমি গরুর মাংসের ভক্ত কখনও ছিলাম না। যখন দেশে ছিলাম, বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হলে মন খারাপ হয়ে যেতো, কেন খাসির মাংস বা মুরগির মাংস রান্না হলো না, সে নিয়ে অনুযোগ করতাম। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় থাকাকালীন দেখলাম ওসব দেশে গরুর মাংসই সব মাংসের সেরা। ধীরে ধীরে রুচি বদলেছে আমার।
দিল্লিতে শুনেছি গরুর মাংস পাওয়া যায় না। গরুর মাংস বলে যা বিক্রি হয়, তা হলো মোষের মাংস। না, মোষের মাংস খাওয়ার আমার কোনও ইচ্ছে নেই।
আমি কী খাবো না খাবো, তা কে বলে দেবে? আমি। তুমি যদি শাকসবজি খেতে চাও, আমার কোনও আপত্তি নেই, যত খুশি শাকসবজি খাও। আমি তোমাকে কখনও জোর করি না, বলি না, তোমাকে মাছ মাংস খেতে হবে। কিন্তু, লক্ষ করেছি, প্রায়ই শাকাহারি লোকেরা ঘৃণা ছুঁড়তে থাকে মাংসাশিদের দিকে। আমরা নাকি নৃশংস, আমরা বর্বর। যে প্রাণীগুলোকে খাদ্য হিসেবে চাষ করা হচ্ছে, সে প্রাণীগুলোর মাংস শুধু আমরা খাচ্ছি। আমরা তো বন-জঙ্গলের কোনও প্রাণীকে হত্যা করে তাদের মাংস খাচ্ছি না! মাংসাশিরা পশুপাখির অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসে। কজন নিরামিষাশীপশুপাখির সেবাযত্ন করে, রাস্তার কুকুর বেড়ালকে পোষার জন্য ঘরে আনে? নিরামিশাসীরা নিরামিষাশীকারণ তাদের ধর্ম বলেছে নিরামিষাশীহতে, নিজের জন্য পুণ্য কামাতে, ভগবানের কৃপা পেতে তারা মাছ মাংস খায় না, জীবজন্তুর প্রতি দয়ায়, মায়ায় নয়।