রামমোহনের রচনার বিশিষ্ট সাহিত্যিক সম্পদও লক্ষণীয়। মনন[৫] ও মনুষ্যত্ব দুয়েরই উদ্রেক হয় তাতে–অবশ্য তাঁর বিশিষ্ট ভাষা-সংকেতের ভিতরে প্রবেশ করবার যোগ্যতা পাঠকের থাকা চাই। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষ্ণতা ও মার্জিতত্বও লক্ষণীয়। নতুন চিন্তানেতা বা সংস্কারক রূপে দেশে রামমোহনের কার্যকাল ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু এই ষোলো বৎসর কালে যত কর্মের প্রবর্তনা তিনি করেন, যত গ্রন্থ বা পুস্তিকা প্রণয়ন করেন, সংখ্যার দিক দিয়েও তা বিস্ময়কর। সেসব সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দানের সুযোগ আমাদের এই আলোচনায় নেই। মাত্র তার কয়েকটি কর্মের ও গ্রন্থের কিছু আলোচনা আমরা করব তাঁর চিন্তা ও চরিত্রের দিন্দর্শন হিসাবে।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজি শেখার জন্য আগ্রহ দেশে দেখা দিয়েছিল, সেজন্য একটি ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন সম্পর্কে প্রথমে আলাপ-আলোচনা হয় রামমোহন ও ডেভিড হেয়ার প্রমুখ তাঁর বন্ধুদের মধ্যে। কিন্তু পরিকল্পনাটি যখন বাস্তব রূপ নিতে দাঁড়াল তখন দেশীয় প্রধানেরা বললেন, রামমোহন এই বিদ্যালয়ের সংস্রবে থাকলে তারা এর সংস্রবে থাকবেন না। রামমোহনকে যারা বিশেষভাবে জানতেন তাঁরা এতে চিন্তিত ও দুঃখিত হলেন। কেননা, এমন একটি নতুন ব্যাপারে রামমোহনের মতো জ্ঞানী ও কর্মকুশল ব্যক্তির সাহায্যের প্রয়োজন তারা একান্তভাবে কাম্য জ্ঞান করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠায় কোনো বিঘ্ন না হয় এজন্য রামমোহন নিজের থেকে সরে দাঁড়ালেন, অন্তরে একই সঙ্গে এই দুঃখ ও সান্ত্বনা নিয়ে যে তাঁর সমসাময়িকেরা তাঁকে এত ভুল বুঝলেন কিন্তু ভবিষ্যত-বংশীয়েরা হয়তো তাঁর কথা মনে করবেন। হিন্দু কলেজের মতো একটি বিদ্যালয় রামমোহন নিজের ব্যয়ে স্থাপন করলেন, তাতে বিনা বেতনে। শিক্ষা দেওয়া হত, আর ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চর্চারও সুবন্দোবস্ত ছিল।
কলকাতায় আসার পর বাংলা ইংরেজি সংস্কৃত এই তিন ভাষার সাহায্যেই রামমোহন তাঁর চিন্তার বীজ অকৃপণভাবে ছড়িয়ে চললেন। (হিন্দিতেও তিনি কিছু বই লেখেন।) রামমোহনের এইসব রচনার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একখানি ইংরেজি বই, নাম-Precepts of Jesus-the Guide to Peace and Happiness.
এটি তিনি বাইবেল থেকে সংকলন করেন–ত্রিত্ববাদ, যিশুর রক্তে পাপীর পরিত্রাণ ইত্যাদি দুৰ্জ্জেয়-তত্ত্ব-বর্জিত উপদেশমালা হিসাবে। এর ভূমিকায় তিনি মন্তব্য করেন :
জগতের স্রষ্টা ও বিধাতা একজন আছেন এই বোধ, আর প্রত্যেক মানুষের অন্যের প্রতি তেমন আচরণ করা উচিত যেমন আচরণ অন্যের কাছ থেকে তারা প্রত্যাশা করে এই বিশ্বজনীন নীতির উপলব্ধি, মানুষের জীবন আনন্দপূর্ণ করে আর পরস্পরের উপকার সাধনে প্রণোদিত করে। বিশ্বের এই স্রষ্টা ও বিধাতা সম্বন্ধে কিছু ধারণা অনেকেরই মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু মানুষ পরস্পরের প্রতি কিরূপ আচরণ করবে সে কথা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে আংশিকভাবে থাকলেও খ্রিস্টান ধর্মের এটি একটি প্রধান শিল্প। অথচ খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বহুজনের বহু মত। সেজন্য ত্রিত্ববাদ, যিশুর রক্তে পাপীর পরিত্রাণ, খ্রিস্টীয় ধর্মের এইসব দুৰ্জেয় তত্ত্ব বাদ দিয়ে তার সহজ সরল সর্বজনবোধ্য ও গ্রাহ্য সুনীতিসমূহ এই গ্রন্থে সংকলিত হল। আশা করা যাচ্ছে এতে এ দেশের সর্বসাধারণের যথেষ্ট উপকার হবে।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে রামমোহনের এই আশায় বাদ সাধলেন শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা। তারা বললেন, দুয়ে তত্ত্বগুলোই তো খ্রিস্টান ধর্মের বৈশিষ্ট্য; সেসব বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থকে কতকগুলো নীতি-উপদেশের সমষ্টিরূপে দাঁড় করালে তাকে বিকৃত করে লোকদের সামনে ধরা হয়। রামমোহন এই অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করলেন না। উৎকৃষ্ট নীতিই যে খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্রের প্রধান শিক্ষা এই সিদ্ধান্ত বলবৎ রাখতে তিনি তৎপর হলেন মূল হিব্রু ও গ্রিক বাইবেল থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে। এ ব্যাপারে দীর্ঘ তিন বছর তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। এই বাদানুবাদ সম্পর্কে একজন ইউরোপীয় সাংবাদিক তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেন :
খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে রামমোহন যে এদেশে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন তা বোঝা যাচ্ছে।
রামমোহনের অন্যান্য রচনার মতো এই খ্রিস্টীয় শাস্ত্রের বিচারও যত্নের সঙ্গে বুঝে দেখা দরকার। যিশুর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এতে ব্যক্ত হয়েছে, কিন্তু সেই শ্রদ্ধা তাঁর সম্পর্কে কোনো অলৌকিকতার জন্য নয়, তার মূল্যবান বিশ্বজনীন নৈতিক নির্দেশের জন্যই। বাইবেলকে রামমোহন বলেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ, কিন্তু এই জন্য যে তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হচ্ছে : অন্যের প্রতি তেমন আচরণ করো যেমন আচরণ তুমি প্রত্যাশা কর। তিনি বলেছেন, এমন পূর্ণাঙ্গ নীতি-উপদেশ তিনি আর কোনো ধর্ম গ্রন্থে পাননি। ধর্মের ব্যাপারে সুনীতি, লোকসেবা ইত্যাদি যে রামমোহন বিশেষ অর্থপূর্ণ জ্ঞান করেছেন তার মর্যাদা পরে পরে আমরা দেখব। একালের কোনো কোনো খ্রিস্টান পণ্ডিত বলেছেন, যুক্তির আলোকে রামমোহন যে বাইবেলের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন আজ খ্রিস্টান-জগতেও সেটি একটি প্রধান স্বীকৃত নীতি।