রামমোহন–যে ব্যক্তি এমত কহে যে সকলই ব্রহ্ম তাহাতে বিহিত অবিহিতের বিভাগ কি, তাহার প্রতি ভট্টাচার্যের এ আশঙ্কা করা যুক্ত হইতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি কহে যে লোকেতে প্রত্যক্ষ যাহা যাহা হইতেছে তাহার বাস্তব সত্তা নাই যথার্থ সত্তা কেবল ব্রহ্মের, আর সেই ব্রহ্মসত্তাকে আশ্রয় করিয়া লৌকিক যে যে বস্তু যে যে প্রকারে প্রকাশ পায় তাহাকে সেই সেই রূপে ব্যবহার করিতে হয়, যেমন এক অঙ্গ হস্তরূপে অন্য অঙ্গ পাদরূপে প্রতীত হইতেছে, যে পাদরূপে প্রতীত হয় তাহার দ্বারা গমন। ক্রিয়া নিস্পন্ন করা যায়, আর যে হস্তরূপে প্রতীত হয় তাহার দ্বারা গ্রহণ রূপ ব্যাপার। সম্পন্ন করা যায়… তাহার প্রতি ভট্টাচার্যের এ আশঙ্কা কদাপি যুক্ত হয় না। ভট্টাচার্যের মতানুযায়ীদিগের প্রতি এ আশঙ্কার এক প্রকার সম্ভাবনা আছে যেহেতু তাঁহারা জগতকে শিবশক্তিময় অথবা বিষ্ণুময় কহেন। অতএব এরূপ জ্ঞান যাহারদিগের তাঁহারা খাদ্যাখাদ্য ইত্যাদির প্রভেদ চক্রে অথবা পঙ্গতে করেন না এবং যে ব্যক্তি ধ্যান সময়ে ও পূজাতে যুগলের সাহিত্য সর্বদা স্মরণ করেন এবং যাহার বিশ্বাস এইরূপ হয় যে আমার আরাধ্য দেবতারা নানা প্রকার অগম্যাগমন করিয়াছেন এবং ঐ সকল ইতিহাসের পাঠ শ্রবণ ও মনন সর্বদা করিয়া থাকেন তাঁহার প্রতি এক প্রকার অগম্যাগমনাদির আশঙ্কা হইতে পারে কিন্তু যে ব্যক্তি এমত নিশ্চয় রাখে যে বিধিনিষেধের কর্তা যে পরমেশ্বর তিনি সর্বব্যাপী সর্বদ্রষ্টা সকলের শুভাশুভ কর্মানুসারে সুখ দুঃখ রূপ ফল দেন সে ব্যক্তি ঐ সাক্ষাৎ বিদ্যমান পরমেশ্বরের ত্রাসযুক্ত তাহার কৃত নিয়মের রক্ষা নিমিত্ত যথাসাধ্য যত্ন অবশ্যই করিবেক।
ভট্টাচার্য–হে অগ্রাহ্য নাম রূপ অমুকেরা তোমাদিগকে জিজ্ঞাসি তোমরা কি?
রামমোহন–আমারদিগকে সোপাধি জীব করিয়া বেদে কহেন ইহা দেখিতেছি। ব্রহ্মতত্ত্ব বিদিত না হইলে উপাধির নাশ হয় না এ কারণ তাহার জিজ্ঞাসু হই সুতরাং তাহার প্রতিপাদক শাস্ত্রের এবং আচার্যোপদেশের শ্রবণের নিমিত্ত যত্ন করিয়া থাকি। অতএব আমরা বিশ্বগুরু ও সিদ্ধপুরুষ ইত্যাদি গর্ব রাখি না, এবং ভট্টাচার্যের উপকৃতি স্বীকার করি, যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি আপনার আপনি প্রিয় হয়, এই নিমিত্তে স্বকীয় দোষ সকল দেখিতে পাইতেছিলাম না, ভট্টাচার্য তাহা জ্ঞাত করাইয়াছেন, উত্তম লোকের ক্রোধও বর তুল্য হয়।
যদি বল আত্মোপাসনার যে সকল নিয়ম লিখিয়াছেন তাহার সম্যক প্রকার অনুষ্ঠান হইতে পারে না অতএব সাকার উপাসনা সুলভ তাহাই কর্তব্য। উত্তর, উপাসনার নিয়মের সম্যক প্রকার অনুষ্ঠান না হইলে যদি উপাসনা অকর্তব্য হয় তবে সাকার উপাসনাতেও প্রবৃত্ত হওয়া উচিত হয় না যেহেতু তাহার নিয়মেরও সম্যক প্রকার অনুষ্ঠান করিতে কাহাকেও দেখিতে পাই না। বস্তুত সম্যক প্রকার অনুষ্ঠান যাবৎ উপাসনাতেই অতি দুঃসাধ্য অতএব অনুষ্ঠানে যথাসাধ্য যত্ন কর্তব্য হয়। বরঞ্চ যজ্ঞাদি এবং প্রতিমার অর্চনাদি কর্মকাণ্ডে যথাবিধি দেশ কাল দ্রব্য অভাবে কর্ম সকল পণ্ড হয়, কিন্তু ব্রহ্মোপাসনা স্থলে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের প্রতি যত্ন থাকিলেই ব্রহ্মোপাসনা সুসিদ্ধ হইতে পারে, কারণ এই যত্নকরণের বিধি মনুতে প্রাপ্ত হইতেছে।
যথোক্তান্যপি কৰ্ম্মাণি পরিহায় দ্বিজোত্তমঃ।
আত্মজ্ঞানে শমে চ স্যাদ্বেদাভ্যাসে চ যত্মবান্। মনুঃ ॥
শাস্ত্রোক্ত যাবৎ কর্ম তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াও ব্রহ্মোপাসনাতে এবং ইন্দ্রিয়নিগ্রহে আর প্রণব এবং উপনিষদাদি বেদাভ্যাসে উত্তম ব্রাহ্মণ যত্ন করিবেন।
‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ থেকে কিছু দীর্ঘ অংশের উদ্ধৃতি আমরা দিলাম, এতে ভট্টাচার্য ও রামমোহন দুজনের দৃষ্টিকোণের বিভিন্নতা বুঝে দেখার সহায়তা হবে আশা করি। মনে হয় ভট্টাচার্যের চোখে ধর্ম মুখ্যত একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতির অনুসরণ, এরূপ পদ্ধতির অনুসরণে মানুষের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ কিছু হবে কি না সেটি যেন তাঁর ভাবনার বিষয় নয়, ধর্ম-কর্ম যেন মন্ত্রপ্রয়োগ করে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির পন্থা–একটা তুকতাকের ব্যাপার। অপর পক্ষে রামমোহন। তাকাচ্ছেন, ধর্ম-কর্ম একটি সদযুক্তিপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে কি-না সেদিকে, বিশেষ করে তাতে অনুষ্ঠাতায় নৈতিক সমুন্নতির সম্ভাবনা আছে কি-না। ধর্ম বলতে রাময়ে নৈতিক বা আত্মিক উন্নতি বিশেষভাবে বুঝতেন তার পরিচয় রয়েছে ধর্মশিক্ষা সস ড, ডফের কাছে তিনি যে উক্তি করেন তাতেও। সেই উক্তিটি এই;
All true education ought to be religious, since the object was not merely to give information but to develop and regulate all the powers of the mind, the emotions and the workings of the conscience. সব রকমের যথার্থ শিক্ষা হওয়া চাই ধর্মানুগত, কেননা তার লক্ষ্য শুধু তথ্য সরবরাত নয়, বরং তার লক্ষ্য হচ্ছে চিত্তের সমস্ত শক্তির, অনুভূতিসমূহের, আর বিবেকের ক্রিয়ার বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ।
বলা বাহুল্য এ বড় রকমের পার্থক্য। কিন্তু এই পার্থক্য সম্বন্ধে চেতনা সেদিনের পণ্ডিত ও অপণ্ডিত সব সনাতনীর মধ্যেই যেন লোপ পেয়েছিল।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ভট্টাচার্য ভিন্ন আর যাদের সঙ্গে রামমোহনের শাস্ত্ৰবিচার হয় তাঁদের মধ্যে মাদ্রাজের সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী প্রসিদ্ধ। সেই বিচারে সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর প্রতিপাদ্য ছিল–বেদজ্ঞান না থাকলে ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে না। রামমোহন প্রতিপন্ন করেন–বেদে এমন সমস্ত ব্রহ্মজ্ঞানীর নাম পাওয়া যায় যাঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন না। সুতরাং বেদ পাঠ না করে তাঁদের ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল। বিশ্বসৃষ্টি-কৌশলের বিষয় অনুধাবন করলেই এই বিশ্বজগতের কর্তা যে পরমেশ্বর তাঁর ধারণা হয়, আর চিন্তনের দ্বারা সেই ধারণায় স্থিতি লাভ করতে হয়।