শিগগিরই যে তিনি হয়ে পড়লেন তাঁর সমসাময়িকদের অত্যন্ত বিরাগভাজন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। শোনা যায়, দুইবার তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল। কিছু বন্ধুলাভও অবশ্য তাঁর হয়। তাঁদের নিয়ে অবিচলিত চিত্তে তিনি উদ্যাপন করে। চললেন আপন ব্রত।
সংস্কারবিরোধীদের মধ্যে যাঁরা শাস্ত্রবেত্তা ছিলেন তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরতে দেরি করলেন না। দুই পক্ষের কলমের লড়াই চলে কয়েক বৎসর ধরে। কিন্তু রামমোহনের বিরুদ্ধপক্ষের পণ্ডিতদের কথা আর রামমোহনের কথা আজকে যখন আমরা মিলিয়ে পড়তে যাই তখন বুঝতে দেরি হয় না, সেদিনের গণ্যমান্য পণ্ডিতরাও চিন্তায় গতানুগতিক ছিলেন কত বেশি। সুবিখ্যাত জজ-পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ভট্টাচার্যের সঙ্গে রামমোহনের যে বাদানুবাদ হয় তার কিছু অংশ বাদ প্রতিবাদের আকারে আমরা উদ্ধৃত করছি :
ভট্টাচার্য–পরমাত্মার দেহ আছে।
রামমোহন–ব্রহ্মকে রূপবিশিষ্ট কহা সর্ববেদসম্মত যুক্তির বিরুদ্ধ।
ভট্টাচার্য–সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা মূর্তিতেই কর্তব্য।
রামমোহন–বস্তুকে সগুণ করিয়া মানিলে সাকার করিয়া মানিতে হয় এমত নহে। …তাহাকে যে স্রষ্টা, পাতা, সংহর্তা ইত্যাদি গুণের দ্বারা কহা যায় সে কেবল প্রথমাধিকারীর বোধের নিমিত্ত।
ভট্টাচার্য–ঈশ্বরাদি শরীরের উদ্বোধক প্রতিমাদিতে তদুদ্দেশ্যে শাস্ত্রবিহিত পূজাদি ব্যাপারে লৌকিক প্লীহাচ্ছেন বাণ মারণাদির ন্যায় কেন না হয়? আত্মবৎ সেবা ইহা কি শুন না? যেমন গরুড়ী মন্ত্রশক্তিতে একের উদ্দেশ্যে অন্যত্র ক্রিয়া করাতে উদ্দেশ্য ফলভাগী হয় তেমনি কি বৈদিক মন্ত্রশক্তিতে হয় না?
রামমোহন–এই যে দুই উদাহরণ দিয়াছেন যে বাণ মারিলে প্লীহাচ্ছেদন হয় আর সর্পাদি মন্ত্র অন্যোদ্দেশ্যে পড়িলে অন্য ব্যক্তি ভালো হয় ইহাতে যেসকল মনুষ্যের নিশ্চয় আছে তাহারাই সুতরাং গ্রন্থকর্তার বাক্যে বিশ্বাস করিবেন আর তাহারদিগের চিত্তস্থিরের নিমিত্তে নানা শাস্ত্রে নানা প্রকার কাল্পনিক উপাসনা লিখিয়াছেন, কিন্তু যাঁহারদিগের জ্ঞান আছে তাহারা এই দুই উদাহরণেতে ভট্টাচার্যের সত্যমিথ্যা সকল জানিতেছেন।
ভট্টাচার্য–উপাসনা পরম্পরা ব্যতিরেকে সাক্ষাৎ হয় না। নিরাকার পরমেশ্বরের কথা থাকুক, সামান্য যে লৌকিক রাজাদির উপাসনা বিবেচনা করিয়া বুঝ।
রামমোহন–বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের দ্বারা যে আমরা পরমেশ্বরের আলোচনা করি সেই পরম্পরা উপাসনা হয় আর যখন অভ্যাসবশত প্রপঞ্চময় বিশ্বের প্রতীতির নাশ হইয়া কেবল ব্ৰহ্মসত্তা মাত্রের স্ফুর্তি থাকে তাহাকেই আত্মসাক্ষাৎকার কহি। কিন্তু ভট্টাচার্য অনীশ্বরকে ঈশ্বর এবং নশ্বরকে নিত্য আর অপরিমিত পরমাত্মাকে পরিমিত অঙ্গীকার করাকে পরম্পরা উপাসনা কহেন বস্তুতঃ সে উপাসনাই হয় না কেবল কল্পনা মাত্র। রাজাদিগের সেবা তাহারদিগের শরীর দ্বারা ব্যতিরেকে হয় না ইহা যথার্থ…কিন্তু অশরীরী আকাশের ন্যায় ব্যাপক সদ্ধপ পরমেশ্বরের উপমা শরীরের সহিত দেওয়া শাস্ত্র এবং যুক্তির সর্বথা বিরোধ হয়। তবে এ উপমা দেওয়াতে ভট্টাচার্যের ঐহিক লাভ আছে অতএব দিতে পারেন যেহেতু পরমেশ্বরের উপাসনা আর রাজারদিগের উপাসনা এই দুইকে তুল্য করিয়া জানিলে লোকে রাজারদিগের উপাসনায় যেমন উৎকোচ দিয়া থাকে সেইরূপ ঈশ্বরকে বাঞ্ছসিদ্ধির নিমিত্ত পূজাদি দিবেক, বিশেষ এইমাত্র রাজারদিগের নিমিত্ত যে উৎকোচ দেওয়া যায় তাহা রাজাতেই পর্যাপ্ত হয়, ঈশ্বরের নিমিত্ত যে উৎকোচ তাহা ভট্টাচার্যের উপকারে আইসে।
ভট্টাচার্য–ঐ এক উপাস্য সগুণ ব্রহ্ম এই জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় করিতেছেন ইহাতে তাঁহা হইতে ভিন্ন কি আছে যে তাঁহার উপাসনা করাতে তাহার উপাসনা সিদ্ধ হইবেক না?
রামমোহন–এ যুক্তি ক্রমে কি দেবতা কি মনুষ্য কি পশু কি পক্ষি সকলেরি উপাসনার তুল্য রূপে বিধি পাওয়া গেল। যদি বল…শাস্ত্রে…দেববিগ্রহের পূজা করিবার আধিক্য আছে অতএব শাস্ত্রানুসারে দেববিগ্রহের পূজা করিয়া থাকি। তাহার উত্তর। যদি শাস্ত্রানুসারে দেববিগ্রহের উপাসনা কর্তব্য হয় তবে ঐ শাস্ত্রানুসারেই বুদ্ধিমান ব্যক্তির পরমাত্মার উপাসনা সর্বতোভাবে কর্তব্য।…
ভট্টাচার্য–যদি সর্বত্র ব্রহ্মের স্ফূর্তি না হয় তবে ঈশ্বরের সৃষ্ট এক এক পদার্থকে ঈশ্বর বোধ করিয়া উপাসনা করিলেও ফলসিদ্ধি অবশ্য হয় আপনার বুদ্ধির দোষে বস্তুকে যথার্থরূপে না জানিলে ফলসিদ্ধির হানি হইতে পারে না যেমন স্বপ্নেতে মিথ্যা ব্যাঘ্রাদি দর্শনে বাস্তব ফল প্রত্যক্ষ কি না হয়?
রামমোহন–ভট্টাচার্য আপন অনুগতদিগকে উত্তম জ্ঞান দিতেছেন যে ঈশ্বরের সৃষ্টকে আপন বুদ্ধি দোষে ঈশ্বর জ্ঞান করিলেও স্বপ্নের ব্যাঘ্রাদি দর্শনের ফলের ন্যায় ফলসিদ্ধি হয়। কিন্তু ভট্টাচার্যের অনুগতদিগের মধ্যে যদি কেহ সুবোধ থাকেন তিনি অবশ্য এই উদাহরণের দ্বারা বুঝিবেন যে স্বপ্নেতে ভ্রমাত্মক ব্যাঘ্রাদি দর্শনেতে যেমন ফলসিদ্ধি হয় সেইরূপ ফলসিদ্ধি এইসকল কাল্পনিক উপাসনার দ্বারা হইবে।
ভট্টাচার্য–বেদান্তে সকলই ব্ৰহ্ম ইহা কহিয়াছেন তাহাতে বিহিত অবিহিত বিভাগ কি? তবে কি কর্তব্য বা কি অকর্তব্য কি ভক্ষ্য কি অভক্ষ্য কি গম্যা কি অগম্যা, যখন যাহাতে আত্মসন্তোষ হয় তখন সেই কর্তব্য যাহাতে অসন্তোষ হইবে সে অকর্তব্য।