কলকাতায় রামমোহন এলেন শুধু একজন অসাধারণ পণ্ডিতরূপেই নয়, একজন বিত্তশালী রূপেও। তখন তার বাৎসরিক আয় প্রায় বারো হাজার টাকা। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীচাঁদ মিত্র রামমোহনের অসাধারণ মনস্বিতার কথা বলতে গিয়ে একটি দীর্ঘ ইংরেজি প্রবন্ধের অবতারণা করেন, তাতে প্রসঙ্গত তিনি বলেন, রামমোহন এত বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন সম্ভবত অবৈধ উপায়ে–যেমন ঘটেছিল অসাধারণ মনসী লর্ড বেকনের ক্ষেত্রে–কেননা, রামমোহনের যুগে এমন প্রবণতা। ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। সঙ্গে সঙ্গে এ মন্তব্যও তিনি করেন যে, এই অনুমানের সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কিশোরীচাঁদের এই অনুমান রামমোহনের সম্বন্ধে একালের কোনো কোনো আলোচনায়ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই সঙ্গে এটিও একালে প্রমাণিত হয়েছে যে, বৈধ উপায়ে এমন বিত্তশালী হবার সুযোগ রামমোহনের ছিল। তা ছাড়া তার প্রকৃতি যে স্বভাবত এমন হীনতা থেকে মুক্ত ছিল তার বহু প্রমাণ তাঁর জীবনকাহিনীতে বিদ্যমান–সেসবের মধ্যে খুব পরিচিত হচ্ছে এই ঘটনাটি :
কলকাতার মুখ্যবিশপ ড. মিটন রামমোহনকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করেন এই বলে যে তাতে তার প্রভূত সম্মান-প্রতিপত্তি লাভ হবে। রামমোহনের খ্রিস্টের প্রতি শ্রদ্ধা সুবিদিত, তবু মুখ্যবিশপের এই প্রস্তাবে তিনি অন্তরে অত্যন্ত পীড়া বোধ করেন। মুখ্যবিশপের বাড়ি থেকে ফেরার পথে অ্যাডাম সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, অ্যাডাম সাহেব মন্তব্য করেছেন–
He felt as if the pure unsullied integrity of his mind, his personal honour and independence had been assailed by the presentation of a low and unworthy motive.
তাঁর এমন বোধ হয়েছিল যেন তাঁর চিত্তের অমল অকলঙ্ক সাধুতায় আর তার ব্যক্তিগত সম্মান ও স্বাধীনতার উপরে আঘাত হানা হয়েছে তার সামনে এক হীন অশোভন অভিসন্ধি তুলে ধরে।
এই অসাধারণ আত্মসম্মানবোধ আর তার সঙ্গে অপরের অধিকার ও মর্যাদা সম্বন্ধে চেতনা রামমোহন-চরিত্রে আগাগোড়া লক্ষণীয়। এটি যে সেদিনের বাঙালিসমাজে অনন্যসাধারণ ছিল, সেদিনের কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত বিদেশী সে মন্তব্য করেছেন।
বলা বাহুল্য এই ঘটনার পর মুখ্যবিশপের বাড়ির পথ তিনি আর মাড়াননি। কলকাতায় সহজেই পদস্থসমাজে তার স্থান লাভ হল আর তার প্রাণের সামগ্রী একেশ্বরবাদ ও যুক্তিবাদের দিকে বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য তিনি আত্মীয় সভা স্থাপন করলেন। অচিরে তাঁর বেদান্তগ্রন্থ, বেদনান্তসার ও কয়েকখানি উপনিষদ এবং সেসবের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হল। কলকাতার তদানীন্তন পদস্থ ও বিত্তশালীদের প্রায় নিরুদ্বিগ্ন জীবনে এইসব গ্রন্থ সূচনা করল এক বিষম আলোড়ন। কলকাতায় ইংরেজের বাণিজ্য ও রাষ্ট্রকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় অনেক দেশীয় লোকেরও ধনাগমের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল। তার ফলে কিছুসংখ্যক লোক হয়ে উঠেছিল হঠাৎ-নবাব-হঠাৎ-নবাবের মতোই বুদ্ধিতে ও চালচলনে তারা ছিল অদ্ভুত। শ্রাদ্ধ বিবাহ দুর্গোৎসব এইসব চিরাচরিত অনুষ্ঠানে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত অবিশ্বাস্য রকমের অমিতব্যয়ে, তার সঙ্গে জুটেছিল তাদের নতুন দেবতা সাহেব জাত’কে দেশীয় মতে নিষিদ্ধ খানাপিনা দিয়ে আপ্যায়িত করার ধুম। বাঈনাচ, বুলবুলির লড়াই, কবি খেউড়, হাফ-আখড়াই এইসব ছিল এই হঠাৎ নবাবদের চিত্তবিনোদনের সুপরিচিত উপায়। বহুকালের অজ্ঞতা ও অত্যাচারে জনসাধারণ হয়ে পড়েছিল দিশাহারা, এই হঠাৎ-নবাবদের আচরণ তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিল প্রায় আদর্শের মর্যাদা নিয়ে। অবশ্য এই দুর্দিনে কিছু কিছু ভালো লোকও যে দেশে না-ছিলেন তা নয়; জনহিতকর কাজে তারা অকাতরে অর্থব্যয় করতেন। কিন্তু, মোটের উপরে, এই যুগ ও পরিবেশ ছিল জীবনের প্রধান প্রধান দায়িত্ব সম্বন্ধে অত্যন্ত অচেতন আর তুচ্ছ সব বিষয়ে মাত্রাতিরিক্তভাবে আগ্রহান্বিতকবিগুরু যেমন বলেছেন : ‘যত আদেশ তোমার পড়ে থাকে, আবেশে দিবস কাটে তার।’
এমন মানসিকতা যে-যুগের, সে-যুগের লোকদের কানে রামমোহনের বহু পুরাতন শাস্ত্রের বিচার ও একেশ্বরবাদের বাণী তেমন তীক্ষ্ণ হয়ে প্রবেশ করবার কথা নয়। কিন্তু তাতে তীক্ষ্ণতার সঞ্চার হল সম্ভবত এই কারণে যে হিন্দুর শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রের মতে একেশ্বরবাদে উচ্চ মর্যাদা আর পৌত্তলিকতার হীন মর্যাদা প্রতিপন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ধর্মের নামে যেসব আচার-আচরণ তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে সেসব সুনীতি ও সুরুচির দিক দিয়ে শুধু অকিঞ্চিৎকর নয়, অত্যন্ত আপত্তিকর-ভদ্রসমাজে সেসব প্রচলিত থাকার অযোগ্য। আর এইসব উক্তি তিনি করলেন শুধু দেশীয় লোকদের বোধগম্য গৌড়ীয় ভাষায় নয়, মহাসম্মানিত সাহেবজাতের বোধ্য ইংরেজি ভাষায়ও। তাঁর কড়া উক্তিগুলো বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কোমল একটি উক্তি আমরা উদ্ধৃত করছি। কেন তাকে এমন অবাঞ্ছিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হতে হয়েছিল তার কৈফিয়ত সেই উক্তির মধ্যেই রয়েছে :
My constant reflections on the inconvenient, or or rather injurious rites introduced by the peculiar practice of Hindu idolatry which, more than any other pagan worship, destroys the texture of society, together with compassion for my countrymen, have compelled me to use every possible effort to awaken their dream of error; and by making them acquainted with their scripture, enable them to contemplate with devotion the unity and omnipresence of Nature’s God.
By taking the path which conscience and sincerity direct. I hom a Brahmin, have exposed myself to the complainings and reproaches even of some of my relations, whose prejudices are strong, and whose temporal advantage depends on the present system.
হিন্দুর যে বিশেষ পৌত্তলিক ধর্মাচার, অন্যান্য ধরনের পৌত্তলিক ধর্মাচারের সঙ্গে তুলনায় তা সমাজবন্ধনের পক্ষে আরো বেশি হানিকর; হিন্দু-পৌত্তলিকতার সেইসব অস্বস্তিকর–শুধু অস্বস্তিকর নয় ক্ষতিকর–আচার-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে নিরবচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা, আর দেশবাসী হিসাবে তাদের জন্য মমতা, আমাকে বাধ্য করেছে তাদের এই ভুলের স্বপ্ন থেকে জাগাবার জন্য সব রকমের চেষ্টায় তৎপর হতে, আর তাদের যে (মূল) ধর্মশাস্ত্র তার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির যিনি অধীশ্বর তাঁর একত্ব ও সর্বত্রবিদ্যমানতা অনুরাগের সঙ্গে ধ্যান করতে তাদের সমর্থ করতে।
বিবেক ও অকপটতার নির্দেশিত পথ অবলম্বন করার ফলে ব্রাহ্মণকুলে জন্মেও আমাকে সহ্য করতে হয়েছে আমার কিছুসংখ্যক আত্মীয়েরও অনুযোগ আর ভর্ৎসনা; তাঁদের সংস্কার বলবান, আর তাদের সাংসারিক সুখসুবিধা নির্ভর করছে বর্তমান ব্যবস্থার উপরে।