বাংলার এই জাগরণের সূচনা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনুষ্যত্বসাধক রামমোহন রায়ের কলকাতায় বসবাস থেকে, আরো ঠিক ঠিক বলতে গেলে তাঁর বেদান্তগ্রন্থ ও তার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের কাল থেকে, অর্থাৎ ১৮১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে–এ মত স্বীকার্য বলেই মনে হয়। এই বেদান্তগ্রন্থ প্রকাশের পূর্বেই রামমোহনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অথবা পুস্তিকা ‘তুহফাতুল মুওহহিদীন’ (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার) প্রকাশিত হয়েছিল, রংপুরে অবস্থানকালে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকদের সঙ্গে আলোচনা ও বাদ-প্রতিবাদও তার হয়েছিল, প্রবল প্রতিপক্ষও তাঁর সেখানে জুটেছিল; তবু তাঁর কলকাতায় বসবাস ও বেদান্তগ্রন্থ প্রকাশই বাংলার রেনেসাঁসের মূল ঘটনা বলে গণ্য হবার যোগ্য এই কারণে যে, দেশের বহু লোকের মধ্যে একটা নতুন চেতনার সূচনা হল এর থেকে, আর নিকটের ও দূরের অনেক জ্ঞানীগুণী বিদেশীর মনেও নতুন করে একটা চমক লাগল পুরাতন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। রামমোহনের বেদান্তগ্রস্থ অবশ্য ধর্মসংস্কারমূলক, কিন্তু রামমোহন ধর্ম বলতে যা বুঝলেন তা বিধিবিধানসর্বস্ব বা পরকালসর্বস্ব ব্যাপার যে নয়, বরং প্রধানত জীবনের উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপার, অচিরে তাঁর বহুমুখী প্রচেষ্টায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। নবযুগের এই মহিমান্বিত প্রবর্তক সম্বন্ধে নানা কথা পরে পরে স্বভাবতই এসে বাংলার জাগরণ। পড়বে। প্রারম্ভে সংক্ষেপে বিবৃত করা যাক এতদিন নেপথ্যে এই অর্থপূর্ণ ব্যক্তিতের। যে প্রস্তুতি চলেছিল।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রামমোহনের জন্ম, এই তাঁর সম্বন্ধে আধুনিক গবেষকদের মত। তাঁর জন্মস্থান রাধানগর গ্রাম সুপরিচিত খানাকুল কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী-বর্তমানে হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতৃপুরুষ এক পুরাতন জমিদার বংশ। তাঁর প্রতিভার পরিচয় অল্প বয়সেই পাওয়া যায়। ধর্মের দিকে তাঁর প্রবণতা সেই সময়েই প্রকাশ পায়। কেউ কেউ বলেছেন তিনি অল্প বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মাতার আগ্রহে সে সংকল্প ত্যাগ করেন। গ্রামের পাঠশালায় বাংলা, শুভঙ্করী আর কিছু আরবি পার্সি শিক্ষা করার পর তিনি পাটনায় যান পার্সি ও আরবি বিদ্যায় আরো পারদর্শী হতে–সেদিনে সেইটেই ছিল উচ্চতর শিক্ষা। মূল কোরআন পাঠ করে তার ভিতরকার একেশ্বরবাদের দিকে তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন, তাঁর চরিতাখ্যায়করা এই কথা বলেছেন। কিন্তু শুধু একেশ্বরবাদ নয়, যুক্তিবাদ, উদার মানবতা, এইসব মহামূল্য সম্পদও যে পার্সি ও আরবি সাহিত্যভাণ্ডার থেকে অল্পবয়সে তিনি আহরণ করেছিলেন পরে তার কিছু কিছু পরিচয় আমরা পাব। পাটনা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে আরবি পার্সিতে তিনি একটি বই লেখেন, সম্ভবত তারই নাম ছিল মনাজেরাতুল আদিয়ান’ অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম বিষয়ে আলোচনা–তাঁর তুহফাতুল মুহহিদী’-এ এই গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ধর্ম বিষয়ে তার প্রচলিত-সংস্কার-বিরোধী মত জানতে পেরে তাঁর পিতা অপ্রসন্নতা জ্ঞাপন করেন। কতকটা তার ফলে আর কতকটা ধর্মবিষয়ে আরো জ্ঞান লাভের জন্য তিনি গৃহত্যাগ করেন পনেরো বছর বয়সে ও তিব্বত পর্যন্ত ভ্রমণ করেন তাঁর শেষ বয়সের বন্ধু ড. কার্পেন্টার এ কথা বলেছেন। তাঁর তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থের প্রথম ছত্রেই ভারতের বাইরে তাঁর এই ভ্রমণের উল্লেখ রয়েছে-’আমি পৃথিবীর নানা স্থানে–পার্বত্য অঞ্চলে ও সমতল ক্ষেত্রে–ভ্রমণ করেছি। মূলে ‘আ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ পৃথিবী, ‘হিন্দ’ অর্থাৎ ভারতবর্ষ নয়। এই ভ্রমণ থেকে বছর-তিনেক পরে দেশে ফিরলে পিতা তাকে গ্রহণ করেন, আর তারপর কাশীতে তিনি দীর্ঘকাল হিন্দুশাস্ত্রের চর্চা করেন।
১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে পিতা তাঁদের তিন ভাইকে সম্পত্তি বণ্টন করে দেন। কতকটা এই পৈতৃক সম্পত্তির সাহায্যে ও অনেকটা তেজারতি ও ভূসম্পত্তি বেচাকেনা করে তিনি বিত্তশালী হন–সেই সঙ্গে কাশীতে তাঁর হিন্দুশাস্ত্রের চর্চাও চলে। তাঁর পিতার মৃত্যু হয় ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে, তারপর তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। এই চাকরির সূত্রে সিভিলিয়ান জন ডিগবির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়-ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে এবং সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজনীতিতে তিনি ব্যুৎপত্তি লাভ করেন প্রধানত এই ডিগবি সাহেবের সহায়তায়। তাঁর পুত্র রমাপ্রসাদ রায় উত্তরকালে বলেন, রামমোহনের দেওয়ানি গ্রহণের প্রধান হেতু ছিল শিক্ষিত; ইংরেজসমাজের সংসর্গলাভ ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করা। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু হয় ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে, তারপর মুর্শিদাবাদে গিয়ে তিনি তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘তুহফাতুল মুওহহিদীন’ মুদ্রিত করেন, ড. কার্পেন্টারের গ্রন্থে এই কথা আছে, কিন্তু ঠিক কখন। তার উল্লেখ নেই।[২] ডিগবি সাহেবের সঙ্গে কয়েকটি জেলায় কাজ করে রামমোহন। রংপুর যান ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ও সেখানে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অবস্থান করেন প্রধানত ডিগবির অধীনে দেওয়ান রূপে। এই রংপুরে নানা সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে রামমোহনের যে আলাপ-আলোচনা ও শাস্ত্ৰবিচার হত তারই পরিণতি স্বরূপ তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন তুহফাত–এই আমাদের ধারণা। আমরা এ কথা বলছি এইজন্য যে, তুহফাত সুপরিণত মনের সৃষ্টি, অপরিণত রচনা এটি আদৌ নয়–যেমন কেউ কেউ ভেবেছেন, এর রচনাশৈলী সুপরিণত–এটি বিশেষভাবে সেদিনের বিদগ্ধসমাজের জন্যই লেখা।[৩] তা ছাড়া ভলটেয়ার, ভনি, এঁদের চিন্তার প্রভাবও তুহফাতে লক্ষণীয়–সেকথা আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলেছেন; কিন্তু ডিগৃবি সাহেবের সঙ্গে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের যখন পরিচয় হয় তখন ডিগবির উক্তিমতে রামমোহনের ইংরেজি জ্ঞান যৎসামান্য ছিল। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে রংপুর ত্যাগ করে রামমোহন কলকাতায় বসবাস করতে আসেন। তাঁর পরবর্তীকালের বন্ধু ও সহকর্মী উইলিয়ম অ্যাডাম বলেছেন,[৪] রামমোহনের রংপুর ত্যাগের একটি কারণ, সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের তাঁর প্রতি অপ্রসন্নতা-হতে পারে তুহফাতে তাঁর যে মন্তব্য রয়েছে যে কোরআন বিধর্মীদের প্রতি কঠোর, সে রকম মন্তব্যের জন্য রংপুরের মুসলমান নেতারা তার প্রতি অপ্রসন্ন হয়েছিলেন।