সাত
পরিশষ্ট : ১. বাংলার জাগরণ; সমালোচনা–হুমায়ুন কবির
২. রেনেসাঁসের পথ আমাদের পথ–আবুল কাসেম ফজলুল হক
১. বাংলায় রেনেসাঁসের বা নবজাগরণের সূচনা
এক
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে যে ব্যাপক জাগরণ ঘটে তার কথা ভাবতে গিয়ে স্বতঃই মনে পড়ে ইউরোপের সুবিখ্যাত রেনেসাঁসের কথা।
মধ্যযুগের শেষের দিকে পশ্চিম-ইউরোপের ফ্রান্স ইতালি ইংল্যান্ড জার্মেনি এবং আরো কয়েকটি দেশে মানুষের অন্তর ও বাহির দুই ক্ষেত্রেই কয়েক শতাব্দী ধরে চলে নতুন নতুন উদ্যম-কাব্যকলা দর্শন-বিজ্ঞান এসব ক্ষেত্রে ঘটে বহু প্রাচীন সম্পদের সঙ্গে নতুন পরিচয় আর নতুন নতুন সৃষ্টি, ভারতবর্ষ ও আমেরিকার মতো দূরদূরান্তের দেশ হয় আবিষ্কৃত, আর বহু-কাল-ধরে-চলে-আসা ধর্মব্যবস্থা প্রায় আগাগোড়া বদলে যায়। এইসব ঘটনা যা ঘটে বা ঘটাবার চেষ্টা যা হয় তার সবটাই যে ভালো, অর্থাৎ বাঞ্ছনীয় হয়েছিল তা বলা যায় না; বরং সময় সময় অবাঞ্ছিত অনেক ব্যাপারও এই যুগের লোকদের জীবনে দেখা দিয়েছিল, তবু মোটের উপরে, চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত, অথবা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, এক অসাধারণ প্রাণসমৃদ্ধ ধারাবাহিক প্রচেষ্টা যে এইসব দেশে লক্ষণীয় হয়েছিল, তা সর্ববাদিসম্মত বলা চলে।
এই অভিব্যক্তির সাধারণ নাম–রেনেসাঁস, অর্থাৎ নবজন্ম। সাধারণত তিনটি ধারায় ভাগ করে দেখা যেতে পারে এই নবজন্মকে–প্রাচীন জ্ঞান ও কাব্যকলার নতুন নতুন আবিষ্কার, জীবন সম্বন্ধে মানুষের নতুন আশা আনন্দ, ধর্ম বা জীবনাদর্শ সম্বন্ধে নতুন বোধ। এই নবজন্মের বা ব্যাপক জাগরণের প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। প্রধানত এর সাহায্যে ইউরোপ, অথবা পাশ্চাত্যজগত তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যযুগীয় খোলস চুকিয়ে দিয়ে আধুনিক হয়ে ওঠে।[১]
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় যে জাগরণ ঘটে তাও এমনি একটি রেনেসাস : তার প্রভাবও হয়েছিল সুদূরপ্রসারী–সমস্ত ভারতবর্ষ তার দিকে তাকিয়েছিল বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে, ধর্ম সংস্কৃতি সাহিত্য রাজনীতি রাষ্ট্রীয় আদর্শ-সব ক্ষেত্রেই নবীন ভারতে যে রূপান্তর ঘটল তার মূলে এক বড় শক্তিরূপে কাজ করেছে এই রেনেসাঁস!
কিন্তু এই জাগরণ সম্বন্ধে যোগ্য চেতনার অভাব একালে সুস্পষ্ট–বাংলার বাইরে তো বটেই, বাংলার বুদ্ধিজীবীরাও এ-সম্বন্ধে যে চেতনার পরিচয় দিচ্ছেন তা ক্ষীণ। এর একটি কারণ মনে হয় এই : বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের স্বদেশী আন্দোলনে এই জাগরণ নিজেকে জানান দেয় এক অসাধারণ বিক্রমে; কিন্তু তার পর বাংলায় শুরু হয় এক উন্মাদনার কাল–সন্ত্রাসবাদ, রাজরোষ, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এমনি বিচিত্রমূর্তির উন্মাদনার দীর্ঘকালব্যাপী রাজত্ব। সেই প্রলয়রাত্রির অবসান হয়েছে বটে, তারপর ঘটেছে স্বাধীনতার নব অরুণোদয়; কিন্তু সাধারণ ভাবে আজো বাংলার ও বাঙালির অবস্থার তুলনা হতে পারে অশেষ দুর্ভোগে সন্তানের জন্ম দিয়ে মাতার যে দশা হয় তার সঙ্গে।
হয়তো সেইজন্যই যে-জাগরণ বাংলার ও সমস্ত দেশের এমন সৌভাগ্যের মূলে, তাকে যোগ্য অভিনন্দন জানাবার আগ্রহ বাঙালিদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই জাগরণ যোগ্য অভিনন্দনেরই দাবি রাখে। সেই দাবি মিটানোর উপরেই হয়তো নির্ভর করছে বাংলার ও ভারতের ভবিষ্যত। যা সুন্দর মহৎ ও সার্থক, বিশেষ করে। নিজেদের ইতিহাসের ভেতরে, তার খোঁজ মানুষকে নিতে হয় চিরকাল-সুন্দর ও সার্থক হবার গরজ যখনই তাদের ভেতরে দেখা দেয়।
কিন্তু বাংলার এই জাগরণের সূচনা কখন থেকে ধরা হবে? সে-সম্বন্ধে উত্তর নির্ভর করে, এই জাগরণ বলতে কি বোঝা হবে প্রধানত তার উপরে। পরকালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ যখন ইহকালের দিকে ভালো করে তাকিয়েছিল তখন সূচনা হয়েছিল রেনেসাঁসের, এই ধারণা থেকে কেউ কেউ কবি ভারতচন্দ্রের কাল থেকে এর সূচনা দেখেছেন। তাদের যুক্তি, ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেবদেবীরা মানব মানবী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয়, তার কারণ, যে মানবিকতা রেনেসাঁসের মূল্য বহন করে, অর্থাৎ বিকাশধৰ্মী মানবিকতা, সে-মানবিকতা ভারতচন্দ্রের দেবদেবীতে নেই। ভারতচন্দ্রের দেবদেবীদের মানবিকতা অনেকটা তাঁর পরবর্তীকালের কবি-খেউড়ের পতনধর্মী মানবিকতার সঙ্গে তুলনীয়–ভারতচন্দ্রের বহু আগে থাকতে মঙ্গলকাব্যগুলোতে দেবতার এই ধরনের মানবিকতা চিত্রিত হয়ে আসছিল। বলা বাহুল্য, বাংলার একালের জাগরণে এই ধরনের মানবিকতার প্রতিবাদ–অবশ্য নীরব নবপ্রত্যয়-সমৃদ্ধ প্রতিবাদ–সুস্পষ্ট। বাংলার জাগরণ ভারতচন্দ্রের পরে অষ্টাদশ শতাব্দীর বড় কবি রামপ্রসাদ। তাঁর জনপ্রিয়তা আজো ব্যাপক এবং গভীর; আর বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম ধুরন্ধর পরমহংস রামকৃষ্ণ মুখ্যত তার ভাবধারায় বর্ধিত। তবু রামপ্রসাদ থেকেও এই জাগরণের সূচনা ধরা যায় না। কেননা, রামপ্রসাদের জীবনবোধ ও সাধনা প্রধানত মধ্যযুগীয় ও ইহবিমুখ, কিন্তু বাংলার জাগরণের একটি বড় ঘোষণা, বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’। বাংলায় ইংরেজের রাজত্ব ও নতুন যন্ত্রপাতির আমদানি থেকেও এ রেনেসাঁসের সূচনা ধরা যায় না, তার কারণ, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলেও ইংরেজের রাজ্যলাভ ঘটেছিল, নতুন যন্ত্রপাতির আমদানিও হয়েছিল, কিন্তু সেসব জায়গায় রেনেসাঁস দেখা দেয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকেও এই রেনেসাঁসের আরম্ভ ভাবা যায় না, কেননা, ফোর্ট ইউলিয়ম কলেজ ছিল বিদেশী শাসকদের প্রয়োজনে গড়া প্রতিষ্ঠানমাত্র, তাতে বাংলা গদ্যের গোড়াপত্তনের সহায়তা যা হয়েছিল তার ঐতিহাসিক মূল্য আছে, কিন্তু সাহিত্যিক মূল্য কিছু যে আছে তা স্বীকার করা কঠিন–অন্তত তার প্রভাব বাংলার জীবন অথবা সাহিত্যের উপরে কিছু পড়েনি, অথবা যা পড়েছে তা সামান্য। রেনেসাঁস, অর্থাৎ কোনো জাতির বা দেশের ব্যাপক জাগরণ–মুখ্যত চিৎসম্পদ, বস্তুসম্পদ তাতে কম অর্থপূর্ণ নয়, কিন্তু তা আনুষঙ্গিক–এই গোড়ার কথাটা ভুললে বস্তুর ও ঘটনার অরণ্যে দিশাহারা হওয়াই হবে আমাদের ভাগ্য।