গত একশো বছরের মধ্যে দেশ-বিদেশের বহু মানবপ্রেমিক, জ্ঞানানুরাগী ও সন্ধিৎসু ব্যক্তি এবং বহু প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত (academicians) স্বগত সত্তায় কিংবা সচেতন সত্তায় থেকে বাঙালির জাগরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন–লিখেছেন। এ-বিষয়ে গ্রন্থ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সন্দর্ভ-অভিসন্দর্ভের অন্ত নেই। এইসব লেখায় রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারপদ্ধতির বিভিন্নতা। আর আন্তরিকতাও সবার সমান নয়।
বাঙালির এই জাগরণ বা রেনেসাস রবীন্দ্রনাথের চেতনায় সৃষ্টির অদম্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ-নিয়ে তিনি আবেগদীপ্ত ভাষায় মত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। এই জাগরণের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ একদিকে প্রাচীন ভারত এবং অপরদিকে আধুনিক ইউরোপের দ্বারাও অনুপ্রাণিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মত তার সমকালের ও উত্তরকালের ভাবুকদের ক্রমাগত প্রভাবিত করেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধপক্ষের রয়েছে ভিন্ন চিন্তাধারা। কাজী আবদুল ওদুদ রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। বাংলার জাগরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে যখন থেকে বিচার-বিবেচনা আরম্ভ হয়, ওদুদ তখন থেকেই এ-বিষয়ে লিখে আসছেন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে তিনি বাঙলার জাগরণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তখন সেটি শিখায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাটি শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থে সঙ্কলিত আছে। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এমন সুনির্দিষ্টভাবে বাঙালির জাগরণ সম্পর্কে আর কেউ কি লিখেছেন? সুশোভন সরকারের Notes on Bengal Renaissance ১৯৪৬ সালের রচনা। সেটি তিনি। লিখেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনে–পার্টির নেতা ও কর্মীদের ঐতিহ্যচেতন করার জন্য। বিষয়টি নিয়ে তিনি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন। ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ তার সূচনা থেকেই। বাংলার রেনেসাঁস ও ইউরোপের রেনেসাস দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। বাংলার জাগরণ গ্রন্থের গোটা বক্তব্যটি কাজী আবদুল ওদুদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাভবনে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা রূপে ছয় দিনে উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে। ওই বছরই বিশ্বভারতী থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
কাজী আবদুল ওদুদ যখন বাংলার জাগরণ লিখেছিলেন তখনও এ বিষয়ে অনেক তথ্যই সামনে আসেনি। তার ফলে এ গ্রন্থে অনেক কিছুরই অপর্যাপ্ততা উপলব্ধি করা যায়। তা ছাড়া অর্থনৈতিক বিষয় সমূহকে ওদুদ বিবেচনায়ই ধরেননি। কেবল চিন্তা, উপলব্ধি ও বিশ্বাসের বিষয়গুলোকেই তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন এবং সমাজে ও জাতীয় জীবনে সেসবের প্রভাব লক্ষ করেছেন। ওদুদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন রামমোহনে, ব্রাহ্মসমাজের ধারায় এবং রবীন্দ্রনাথে। এটাই তার পছন্দের দিক। তবে অন্য দিকগুলোতেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় এ-বিষয়ের একটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেতে পারে। মোহিতলাল মজুমদার, সুশোভন সরকার, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, যদুনাথ সরকার, এম এন রায়, অচ্যুত গোস্বামী, অরবিন্দ পোদ্দার, গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, নরহরি কবিরাজ, অন্নদা শঙ্কর রায়, সুপ্রকাশ রায়, শিব নারায়ণ রায়, স্বপন বসু, হুমায়ুন কবির, আবুল মনসুর আহমদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার ও আরো অনেকের মতের পাশে কাজী আবদুল ওদুদের মত স্বতস্ত্র ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার চিন্তার ও ভাবান্দোলনের ইতিহাস বিবেচনা করতে গেলে কাজী আবদুল ওদুদের বাংলার জাগরণ গ্রন্থেরও প্রয়োজন অনুভূত হবে।
বাংলার জাগরণ বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর বছরখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। তার পর ক্রমেই গ্রন্থটি দুপ্রাপ্য হয়ে ওঠে। এখন এই ঢাকা শহরে দু-একটি কপি কারো কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকতে পারে। কোনো কোনো গ্রন্থাগারে এবং কারো কারো কাছে এর অপরিচ্ছন্ন ফটোকপি আছে, অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পেলাম। এ অবস্থায় কথাপ্রকাশ এই গ্রন্থটি যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করছে। এতে আগ্রহী পাঠকদের জন্য গ্রন্থটি পাওয়ার সুযোগ হল। এর দ্বারা কথাপ্রকাশের স্বত্ত্বাধিকারী জনাব জসিম উদ্দিন বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে একটি ভালো কাজ করলেন। নটর ডেম কলেজের প্রভাষক, উদীয়মান লেখক, কর্ষণ পত্রিকার সম্পাদক মিজান রহমান গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। বানানের বেলায় প্রুফ-রীডার বাংলা একাডেমীর বর্তমান বানানরীতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছেন। পরিশিষ্টে হুমায়ুন কবির লিখিত, চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গ্রন্থের একটি সমালোচনা এবং ‘রেনেসাঁসের পথ আমাদের পথ’ নামে আমার একটি লেখা সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন এক রেনেসাঁস আজ একান্ত কাম্য–সেই রেনেসাস সৃষ্টিতে এ-গ্রন্থ সহায়ক হোক–এই কামনা করি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক
বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
২০. ০৮, ২০১০
মুখবন্ধ
গত বছর জুলাই মাসে বিশ্বভারতীর স্বর্গত উপাচার্য ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী বিশ্বভারতীতে কয়েকটি বক্তৃতা দেবার জন্য আমাকে বলেন। ঠিক হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার জাগরণ সম্বন্ধে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা দেওয়া হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে বক্তৃতাগুলো তৈরি হবার পূর্বেই ডক্টর বাগচী পরলোকগমন করেন।