বিলাতে রামমোহন সফল চেষ্টা যা করেন তার কিছু পরিচয় আমরা পেয়েছি। তাঁর কিছু কিছু চেষ্টা বিফলও হয়, যেমন, বাজেয়াপ্ত নিষ্কর সম্বন্ধে পুনর্বিচারের দাবি। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ রামমোহনের এই ব্যর্থ চেষ্টার উপরে এই উপভোগ্য টিপ্পনী করেন :
এই চেষ্টায় সফল হতে পারলে রামমোহন নিষ্করভোগী ব্রাহ্মণদের প্রিয়পাত্র হতে পারতেন, তাতে বিলাতে গিয়ে তিনি যে জাত খুইয়েছেন সে-সম্বন্ধে একটা সুরাহা হত।
এসব ভিন্ন আর একটি কাজ তিনি করেন, অথবা সে সম্বন্ধে কিছু সত্যাশ্রয়ী ভাবনার পরিচয় দেন, যা অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর সমগ্র জীবনসাধনার উপরে প্রচুর আলোকপাত করেছে। সেটি এই :
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার দেশ ফ্রান্স দেখবার আগ্রহ তাঁর বরাবরই ছিল। কিন্তু সে আগ্রহ কাজে পরিণত করতে গিয়ে দেখলেন ছাড়পত্র সংগ্রহ করবার ঝামেলা ঢের। এই ব্যাপারে ফ্রান্সের বৈদেশিক মন্ত্রীর কাছে তিনি একখানি চিঠি লেখেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শান্তিকামী নাগরিকদের জন্য ছাড়পত্র প্রথা যে অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত সেই চিঠিখানিতে সে-কথা তিনি বলেন আর বলেন পরবর্তীকালের লিগ অব নেশান বা ইউএনও-র মতো একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনের কথা। বিশ্বমানবের মৈত্রী যে কত বড় সত্য ভাবনা হয়ে উঠেছিল তাঁর মনে তার এই প্রস্তাবে সেই পরিচয় রয়েছে। তার সেই পত্রের কয়েকটি ছত্র এই :
It is now generally admitted that not only religion but unbiased common sense as well as accurate deductions of scientific research lead to the conclusion that all mankind are but one great family of which numerous nations and tribes existing are only various branches. Hence enlightened men in all countries feel a wish to encourage and facilitate human intercourse in every manner by removing as far as possible all impediments to it in order to promote the reciprocal advantage and enjoyment of the whole human race. আজকাল সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়ে থাকে যে শুধু ধর্ম নয়, পক্ষপাতহীন কাণ্ডজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে যথাযথ নির্দেশ এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে সমস্ত মানবজাতি এক বৃহৎ পরিবার, বিভিন্ন জাতি বা গোত্র হচ্ছে তার বিভিন্ন শাখা। সেজন্য সব দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিরা আকাভক্ষা করেন সব প্রতিবন্ধকতা যথাসম্ভব দূর করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সর্ব প্রকারের সংস্রব ঘটাতে সাহায্য করবেন, তাতে মানবজাতির পারস্পরিক সুবিধা ও আনন্দ-সম্ভোগ বৃদ্ধি পাবে।
এই সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য, বিশ্বমানবের একত্বের ও মৈত্রীর ভাবনা রামমোহনের পরমপ্রিয় পারসিক কবি সাদির কাব্যেও চিত্তাকর্ষক ভাষা পেয়েছে। সাদির এইসব চরণ বিখ্যাত :
আদম-সন্তানেরা একে অন্যের অঙ্গস্বরূপ,
কেননা তাদের উৎপত্তি একই মূল থেকে।
যদি এক অঙ্গে বেদনা বাজে,
তবে অন্য অঙ্গ শান্তিতে থাকতে পারে না।
মানুষের দুঃখ তুমি যদি না বোঝে
তবে মানুষ নাম নেওয়া তোমার অন্যায় হয়েছে।
অবশ্য বিশ্বমানবের একত্ব ও মৈত্রীর ভাবনা সাদির আগেও অনেকে করেছেন। সেই প্রাচীন মহামানবদের শুভানুধ্যান রামমোহনের প্রতিভায় যোগ্য রূপ লাভের আত, অর্জন করল।
বেদান্ত আর মসনবির[৮] অদ্বৈত তত্ত্ব, সাদি প্রমুখ সুফিদের জ্ঞান ও প্রেমের সাধনা, আর ইউরোপীয় মনীষীদের জীবনের সুবিকাশতত্ত্ব বিচিত্র কালের এ se” দেশের এইসব ভাবনা ও সাধনা কেমন করে যে রামমোহনের ভিতরে সস। হয়েছিল, সে তত্ত্ব দুরবগাহ। কিন্তু বাস্তবিকই এমন একটি অপূর্ব সামঞ্জস্য, ভিতরে ঘটেছিল, আর তাতেই একালের জীবনসাধনার ক্ষেত্রে তাঁর সাধনার এত মর্যাদা। তিনি যে প্রাচীনকালের ব্রহ্মবাদীদের মরমি সাধনা, মধ্যযুগের সফিদের মানবপ্রীতির সাধনা, আর আধুনিক কালের ইউরোপীয়দের বস্তুনিষ্ঠ সাধনা, এষ কোনো একটির দিকে ঝুঁকে পড়েননি, বরং এর প্রত্যেকটি তার ভিতরে একই সঙ্গে লাভ করেছিল সুবিকাশ ও সুসঙ্গতি, এই ঘটনা যে কত অর্থপূর্ণ তা আজো আমরা যোগ্যভাবে বিচার করে দেখিনি। বাংলার জাগরণের ধারার পরে পরে যেসব শক্তিশালী সাধকের আবির্ভাব হয় তাঁদের সাধনা ও সিদ্ধির সঙ্গে তুলনায় রামমোহনের এই বিশিষ্ট সাধনার মর্যাদা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলে রামমোহনকে বুঝবার পথে আমরা অগ্রসর হতে পারব।
নতুন গণতন্ত্র আমেরিকাও রামমোহন দেখতে ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেল। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল নগরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস মোচন করেন।
—
১. রেনেসাস অবশ্য বহুদেশে ঘটেছে; ফেরদৌসির পরে ইরানে, পাঠান রাজত্বের শেষের দিকে ভারতে চিন্তার ক্ষেত্রে ও সমাজজীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয় তাও রেনেসাস-জাতীয়। তবে ইউরোপের রেনেসাঁস অনেক বেশি পরিচিত, মানুষের একালের ইতিহাসের উপরে তার প্রভাবও বড় রকমের হয়েছে।
২. মিস্ কলেট যে তুহফাতের রচনাকাল ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ বলেছেন, ড. কার্পেন্টারের উক্তি অনুসারেও তা ভুল। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের পিতার মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁর ভ্রাতার মৃত্যু হয় পরে, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে।