রামমোহনের এই সাক্ষ্য মুদ্রিত হয়ে যখন ভারতবর্ষে পৌঁছল তখন তার যেসব প্রতিক্রিয়া হল তা খুব অর্থপূর্ণ। অনেকে বললেন, রামমোহন অনেক কাজের কথা বলেছেন, তাঁর সাক্ষ্যের ফল ভারতের জন্য ভালো হবে। সংস্কারবিরোধী দলের মুখপত্র ‘সংবাদচন্দ্রিকা’য় বলা হল, রামমোহন জমিদারদের দুঃখের দিকে আদৌ তাকাননি, তাঁর সাক্ষ্য মূল্যহীন। আর ‘বেঙ্গল হরকরা’য় করা হল তাঁর অনেক মন্তব্যের কড়া সমালোচনা, বলা হল, তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে খুব খাতির করে কথা বলেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই তৈরি আইনের সুযোগ নিয়ে জমিদাররা প্রজার উপরে যে অকথ্য অত্যাচার করে, সেকথা তার আরো স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল। জমিদারদের এই অত্যাচারের চাপে জনসাধারণের দুঃখ-কষ্ট সেদিন যে কীরূপ মর্মান্তিক রূপ ধারণ করেছিল সে সম্বন্ধে কিছু বর্ণনা বিদেশি পর্যটকদের লেখা থেকে ‘হরকরা’ উদ্ধৃত করেন। বেঙ্গল হরকরা তখন ইংরেজদের কাগজ ছিল–অবশ্য উদারপন্থী ইংরেজদের কাগজ, ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল, আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি বিরূপ। কিন্তু যে আবেগ নিয়ে এই সংখ্যার হরকরা এদেশের জনসাধারণের দুঃখ-দারিদ্র্যের কথা বলেন তাতে মনে হয় হরকরার এই লেখাটি ছিল কোনো ইয়ং বেঙ্গলের। (ইয়ং বেঙ্গলদের কথা দ্বিতীয় বক্তৃতায় আমরা বলব।) কিন্তু কেন রামমোহন কোম্পানির কড়া সমালোচনা করেননি সে উত্তর পাওয়া যায় রামমোহনের বন্ধু ও সহকর্মী উইলিয়ম অ্যাডাম ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার বন্টন নগরে যে বক্তৃতা দেন তাতে। তিনি বলেন :
He saw-a man of his acute mind and local knowledge could not but see–the selfish, cruel and almost insane errors of the English in governing India, but he saw also that their system of government and policy had redeeming qualities not to be found in the native governments. Without seeking to destroy, therefore, his object was to reform the system and without stimulating his countrymen to discontent or disaffection his endeavour was by teaching them a pure religion, and promoting among them an enlightened education to qualify them for the enjoyment of more extensive civil and political franchises then they yet possessed.
তাঁর চোখে পড়েছিল–তার মতো প্রখরবুদ্ধি ও স্থানীয় ব্যাপার সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল ব্যক্তির চোখে না পড়ে পারবেই বা কেন–ইংরেজরা ভারত শাসন ব্যাপারে স্বার্থপর হয়ে, নিষ্ঠুর হয়ে, প্রায় পাগলের মতো যেসব ভুল করে চলেছিলেন; কিন্তু সেই সঙ্গে তার চোখে এও পড়েছিল যে ইংরেজদের শাসনব্যবস্থায় ও নীতিতে এমন সমস্ত ভালো গুণ বর্তমান যা দেশীয় কোনো শাসনব্যবস্থায় ছিল না। ধ্বংস না করে তাই তিনি চেয়েছিলেন সেই শাসনব্যবস্থার সংস্কার করতে; তাঁর দেশবাসীদের অন্তরে অসন্তোষ অথবা অপ্রীতি না জাগিয়ে তিনি চেষ্টা করছিলেন নির্দোষ ধর্মনীতি শিক্ষা দিয়ে আর উন্নত ধরনের শিক্ষার বিস্তারের দ্বারা তাঁর দেশবাসীরা এ পর্যন্ত যেসব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করছিল তাদের তার চাইতে আরো বিস্তৃততর অধিকার ভোগের যোগ্য করতে।
এই সঙ্গে স্মরণীয়, বিলাতে রামমোহনের এই মর্মে ঘোষণা : ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টে যদি Reform Bill পাস না হয় তবে ব্রিটিশের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি আমেরিকায় গিয়ে বসবাস করবেন।
ভারতের স্বাধীনতালাভে বেশি দেরি হবে না, এমন ধারণাও তার হয়েছিল।
বাস্তবিক রামমোহন জনগণের দুর্দশা সম্বন্ধে একটুও কম সচেতন ছিলেন না; বার বার তিনি বলেছেন, প্রজাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বেদনা বোধ করেন।
তাদের দুর্দশার কথা ভেবে তিনি যে অঞসংবরণ করতে পারতেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা এ কথাও বলেছেন।[৭] কিন্তু তাড়াতাড়ি এর প্রতিকার যে সম্ভবপর সে আশ্বাসে তিনি আশ্বস্ত হতে পারেননি। তাই তিনি অবলম্বন করেছিলেন অক্লান্ত প্রয়াস ও ধৈর্যের পথ, বিপ্লবের পথ নয়। চিন্তায় রামমোহন সত্যই বিপ্লবী ছিলেন। একটা ভাবধারার বা জীবনধারার যুগ গত হয়ে অন্য একটা নতুন ভাবধারা বা জীবনধারার যুগ আসছে, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু সেই নতুনকে রূপ দেবার ব্যাপারে তিনি যা করতে পেরেছিলেন অনেক ক্ষেত্রেই তা পর্যাপ্ত নয়, এমনকি যৎসামান্যও বলা যেতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়–ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্ট ডিডে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের সভ্য ও ভব্য মানুষদের এক ধর্মমিলনকেন্দ্র, একস্রষ্টা ও পাতার ছত্রছায়াতলে, এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে, পরস্পরের প্রতি প্রেমসম্পন্ন হবে ও পরস্পরের হিতসাধনে তৎপর হবে, কিন্তু কাজে তিনি করতে পারলেন একটি কক্ষে প্রাচীন রীতির বেদপাঠের ব্যবস্থা যাতে ব্রাহ্মণেতর জাতির প্রবেশাধিকার নেই, আর তার সঙ্গে অপর একটি কক্ষে প্রধানত হিন্দুশাস্ত্র থেকে কিছু পাঠ ও ব্যাখ্যা আর কিছু ধর্মসঙ্গীত, সেই কক্ষে অবশ্য সভ্যভব্য সবশ্রেণির লোকের প্রবেশাধিকার রয়েছে। কিন্তু এতে বিব্রত বোধ না করে যদি ভাবা যায়, যে-সমাজের ভিতরে তিনি তাঁর আদর্শের বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলেন তাদের অনেকেরই তাঁর যুগান্তকারী ভাবনার ধারণা করবার সামর্থ্যও ছিল না, অথচ তাদের নিয়েই তাঁকে কাজ শুরু করতে হয়েছিল–যেমন চিরকাল হয়ে থাকে। তখন তাঁর এমন সম্ভাবনাপূর্ণ ভাবনার এমন আংশিক রূপদানেও যে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন তাতে আনন্দিত হবারই কারণ ঘটে। এর সঙ্গে আরো স্মরণ রাখবার প্রয়োজন আছে ব্যক্তির স্বাধীনতায় রামমোহনের শ্রদ্ধা–তার পুত্রদেরও নিজের ধর্মমতে আনবার বিশেষ চেষ্টা তিনি করেননি, তারা বড় হয়ে তাঁর অনুবর্তী হয়েছিলেন।–চিন্তানেতাদের মোটামুটি দুই বড় দলে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। একদল চিন্তা ও কর্মে ব্যবধান সহ্য করতে অনিচ্ছুক, অপরদল চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও সত্যাশ্রয়িতার দিকে প্রখরদৃষ্টি, চিন্তায় ও কর্মে সঙ্গতিও তাঁরা চান, কিন্তু সে সম্বন্ধে ধৈর্য ধারণের প্রয়োজন আছে সে বিষয়েও তারা সচেতন। বলা যেতে পারে এই শেষোক্ত দলের সিদ্ধান্ত to think is to act, যদি ভাবনা শুরু হয়ে থাকে তবে কাজও শুরু হয়েছে। এর কোন দল বেশি ভালো বা বেশি কাজের তা বলা কঠিন, হয়তো-বা অসম্ভব; তবে রামমোহনকে শেষোক্ত দলের অন্তর্গত করে দেখলে বোঝবার পক্ষে কিছু সহায়তা হয় বলে আমাদের ধারণা। একটা বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ নতুন ভাবনা যে দানা বেঁধেছিল তার মনে, প্রকাশের পথও খুঁজেছিল বিচিত্রভাবে, এইটিই এক মহা ঘটনা। দেখা গেছে কাল এমন ঘটনাকে সার্থকতার পথে নিয়ে যায়।