রামমোহন বিলেত যাবার কথা ভেবেছিলেন কলকাতায় বাস করতে এসেই, তার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ইউরোপীয় বিদ্যার চর্চা করবেন। কিন্তু একের পর এক নানা কাজ এসে জুটল–সেসবের সঙ্গে কিছু পরিচয় আমাদের হয়েছে। শেষের দিকে তিনি জড়িয়ে পড়লেন এক প্রকাণ্ড মিথ্যা মোকদ্দমার জালে। মোকদ্দমাটি দায়ের করা হয়েছিল দৃশ্যত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিরুদ্ধে তহবিল তসরূপের অভিযোগে, কিন্তু আসলে তাঁর বিরুদ্ধে, অর্থাৎ তাঁর মতবাদের বিরুদ্ধে। এই মোকদ্দমার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নাকি বর্ধমানের মহারাজা।
কোনো কোনো পদস্থ ইংরেজের উস্কানিও এতে ছিল একথা আছে কর্নেল ইয়ং তাঁর গুরু জেরেমি বেন্থামকে রামমোহন সম্বন্ধে যে চিঠিখানি লেখেন তাতে। দুই বছর ধরে মোকদ্দমা চলে, শেষে রামমোহনের পুত্র নির্দোষ প্রতিপন্ন হন এবং রামমোহনের দুশ্চিন্তার অবসান হয়। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য অনেকখানি ভেঙে পড়ে। স্বাস্থ্য একটু ভালো হলে তিনি বিলেত যাত্রা করেন ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর তারিখে।
বিলেত যাত্রায় তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুইটি : সতীদাহ সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে বিলাতে যে দরখাস্ত করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধাচরণ করা, আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল, ভবিষ্যত শাসন-ব্যবস্থায় ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য কিছু করা যায় কি-না তা দেখা। এর সঙ্গে তাঁর আর একটি কাজও জুটেছিল, সেটি হচ্ছে সেদিনের দিল্লির মোগল সম্রাটের ভাতা বৃদ্ধির জন্য দরবার।
সেদিনে হিন্দুর জন্য সমুদ্রযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, কাজেই মহা ভয়ঙ্কর। সেই মহা ভয়ঙ্কর কাজে রামমোহন অগ্রসর হলেন হালকা মনে। তাঁর সঙ্গে গেল চারজন ভত্য আর পুত্রের মতো পালিত কিশোর রাজারাম। রামমোহনের সমসাময়িক এক কবিতাকার তাঁর সম্বন্ধে একটি ছড়ায় লেখে যে রামমোহনের এক মুসলমানি প্রণয়িনী আছেন। কবি-খেউড়ের সেই হীরক যুগে এমন মজাদার ছড়া বোধ হয় অনেকেই উপভোগ করেছিল। কিন্তু একালে মানুষের হাসবার ক্ষমতা বড় কমে গেছে, তাই একালের কোনো কোনো গবেষক এক মহামূল্য ঐতিহাসিক তথ্যজ্ঞানে এর পিছনে যথেষ্ট কালিকলম খরচ করেন। কিন্তু ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত হাসির ব্যাপারই রয়ে গেছে, অর্থাৎ প্রমাণিত হয়েছে এটি একটি মজাদার ছড়া ভিন্ন আর কিছু নয়–রাজারাম ছিল একটি অনাথ ছেলে, রামমোহনের স্নেহে পালিত হয়ে কালে সে হিন্দুসমাজেই গণ্যমান্য হয়, এ সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। পথে উত্তমাশা অন্তরীপে ফরাসি জাহাজে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা চিহ্নিত পতাকা দেখে রামমোহন আনন্দে তার প্রতি অভিবাদন জানান। স্বাধীনতা রামমোহনের কাছে কত বড় সম্পদ ছিল সে সম্বন্ধে আর দুটি বড় ঘটনা তার জীবন-কাহিনিতে স্মরণীয় হয়ে আছে–একটি, দূর স্পেনের স্বাধীনতা লাভে উল্লসিত হয়ে নিজ ব্যয়ে তিনি একটি ভোজসভা করেন, অপরটি, নেপলস-এর পরাধীনতা-দুঃখের অবসান হয়নি জানতে পেরে মর্ম বেদনায় তিনি বন্ধুকে লেখেন : জগতে স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারব সে আশা করতে পারছি না। আর সেই সঙ্গে এই চিরস্মরণীয় উক্তি করেন : যারা স্বাধীনতার শত্রু আর স্বেচ্ছাতন্ত্রের সমর্থক তারা কখনো সফলকাম হয়নি, কখনো সফলকাম হবে না।
রামমোহন বিলাতে পৌঁছেন ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ৮ এপ্রিল তারিখে। সতীদাহ সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধে যারা চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা বিফল হলেন–এই দলে কিছু সংখ্যক শিক্ষিত ইংরেজও ছিলেন, তা আমরা জেনেছি। এ ভিন্ন আরো বড় দুটি কাজ বিলাতে তিনি করেন, অথবা তার দ্বারা সমাধা হয়। তার একটি, বিলাতে পার্লিয়ামেন্টের এক কমিটিকে ভারতের রাজস্বব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত জানানো; অপরটি, তার মতো একজন অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তিকে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি রূপে পেয়ে বিলাতের সর্বসাধারণ ও জ্ঞানীগুণীরা যে শ্রদ্ধান্বিত হতে পারলেন বিজিত ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের প্রতি। দিল্লির সম্রাট রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেদিনের ভারত সরকার তার সে-উপাধি স্বীকার করেননি। কিন্তু ইংল্যান্ডের সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁকে রাজদূতের সম্মান দেন।
বিলাতের পার্লিয়ামেন্টের কমিটিকে তিনি তার মতামত যা জানান, আজো সে সব পড়লে দেশের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপকতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। তার কয়েকটি মত এই–চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে তিনি বলেন : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের লাভ হয়েছে, সে লাভ থেকে জমিদারদের বঞ্চিত করবার প্রয়োজন নেই, কেননা আগে তারা পেত আদায় করা মোট রাজস্বের শতকরা দশ ভাগের মতো, সেই জায়গায় এখন পায় শতকরা বিশ থেকে ত্রিশ ভাগ। কিন্তু এতে প্রজার ক্ষতি হয়েছে খুব, কেননা প্রজার দেওয়া খাজনার পরিমাণ অনেক বাড়ানো হয়েছে। সরকারের উচিত এমন ব্যবস্থা করা যাতে প্রজার খাজনা বৃদ্ধি না হয় সেজন্য যদি জমিদার যে রাজস্ব সরকারকে দেয় তা কমাতে হয়, তবে তা কমানো সঙ্গত হবে। বিলাসদ্রব্যের উপরে ট্যাক্স বসিয়ে সরকার এই ক্ষতি পূরণ করতে পারেন। দেশের লোকদের দিয়ে ভারতবর্ষের জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন করার কথাও তিনি বলেন।