চতুর্থ : যে সানুরাগা কহিলেন, তাহা উভয়ের বিবাহ গণনাতেই ব্যক্ত আছে অর্থাৎ এক এক পুরুষের প্রায় দুই তিন দশ বরঞ্চ অধিক পত্নী দেখিতেছি, আর স্ত্রীলোকের এক পতি সে ব্যক্তি মরিলে কেহ কেহ তাবৎ সুখ পরিত্যাগ করিয়া সঙ্গে মরিতে বাসনা করে, কেহ বা যাবজ্জীবন অতিকষ্ট যে ব্রহ্মচর্য তাহার অনুষ্ঠান করে।
পঞ্চম : তাহাদের ধর্মভয় অল্প, এ অতি অধর্মের কথা, দেখ কি পর্যন্ত দুঃখ, অপমান, তিরস্কার, যাতনা তাহারা কেবল ধর্মভয়ে সহিষ্ণুতা করে। অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ যাহারা দশ পনর বিবাহ অর্থের নিমিত্ত করেন, তাহাদের প্রায় বিবাহের পর অনেকের সহিত সাক্ষাত হয় না, অথবা যাবজ্জীবনের মধ্যে কাহারো সহিত দুই চারিবার সাক্ষাত করেন, তথাপি ঐ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে অনেকেই ধর্মভয়ে স্বামীর সহিত সাক্ষাত ব্যতিরেকেও এবং স্বামীর দ্বারা কোনো উপকার বিনাও পিতৃগৃহে অথবা ভ্রাতৃগৃহে কেবল পরাধীন হইয়া নানা দুঃখ সহিষ্ণুতা পূর্বক থাকিয়াও যাবজ্জীবন ধর্ম নির্বাহ করেন; অনেকেই ধর্মভয়ে লোকভয়ে ক্ষমাপন্ন থাকে, যদ্যপিও কেহ তাদৃশ যন্ত্রণায় অসহিষ্ণু হইয়া পতির সহিত ভিন্নরূপ থাকিবার নিমিত্ত গৃহত্যাগ করে তবে রাজদ্বারে পুরুষের প্রাবল্য নিমিত্ত… পূর্বজাতক্রোধের নিমিত্ত নানা ছলে অত্যন্ত ক্লেশ দেয়, কখনো বা ছলে প্রাণ বধ করে; এসকল প্রত্যক্ষ সিদ্ধ, সুতরাং অপলাপ করিতে পারিবেন না। দুঃখ এই যে এই পর্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনী, তাহারদিগকে প্রত্যক্ষ দেখিয়াও কিঞ্চিৎ দয়া আপনকারদের উপস্থিত হয় না, যাহাতে বন্ধনপূর্বক দাহ করা হইতে রক্ষা পায়।
হিন্দুনারীর দায়াধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে রামমোহনের প্রয়াসও সুবিদিত। রামমোহন যে শৈববিবাহ সমর্থন করেন তাতে প্রকারান্তরে অসবর্ণ বিবাহ ও বিধবা বিবাহ সমর্থন করা হয়।
রামমোহনের পূর্বে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ভট্টাচার্য সতীদাহ যে আবশ্যিক নয় সেই মত দেন সেইজন্য কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে সতীদাহ নিবারণ সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম লেখনি ধারণের গৌরব মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের প্রাপ্য। কিন্তু তারা ভুলে যান ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জজ-পণ্ডিতেরা সতীদাহ সম্বন্ধে যে শাস্ত্রীয় মতের উল্লেখ করেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তার বেশি কিছু করেননি। কেউ কেউ বলেছেন, সতীদাহ নিবারণ ব্যাপারে বিশেষ গৌরব লর্ড বেন্টিঙ্কের প্রাপ্য, কেননা, এটি আইনের দ্বারা রহিত করেন তিনি, আর এমনভাবে রহিত না করলে এই প্রথা আজও রহিত হত কিনা কে জানে। সতীদাহ সম্পর্কে লর্ড বেন্টিঙ্ক যা করেছিলেন তা যে অত্যন্ত প্রশংসাৰ্হ তাতে সন্দেহ নেই; বিশেষ করে এ সম্বন্ধে তিনি যে মনোভাবের পরিচয় দেন তা অতি শ্রদ্ধেয়। তিনি বলেন :
The first and primary object of my heart is the benefit of the Hindus. I know nothing so important to the improvement of their future condition, as the establishment of a purer morality, whatever their belief, and a more just comprehension of the will of God. The first step to their better understanding will be dissociation of religious beliefs and practice from blood and murder. They will then, when no longer under this brutalizing incitement, view with more calmness acknowledged truths. They will see that there can be no inconsistency in the ways of Providence, that to the command received as divine by all races of men. ‘No innocent blood shall be spilt’, there can be no exception; and when they shall have been convinced of the error of this first and most criminal of their customs, may it not be hoped that others which stand in the way of their improvement may likewise pass away and that thus emancipated from those chains and shackles upon their minds and actions, they may no longer continue, as they have done, the slaves of every foreign conqueror but that they assume their just place among the great nations of mankind.
I disown in these remarks or in this measure any view whatever to conversion to our own faith. I write and feel as a legislator for the Hindus and as, I believe, many enlightened Hindus think and feel. (Minute, Nov. 8, 1829)
আমার হৃদয়ের প্রথম ও অগ্রগণ্য ঈপ্সিত হচ্ছে হিন্দুদের কল্যাণ সাধন। ধর্মবিশ্বাস তাদের যাই হোক, তাদের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য আমি সর্বাগ্রগণ্য বিবেচনা করি আরো নির্দোষ নীতির প্রতিষ্ঠা, আর ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্বন্ধে আরো ন্যায়ানুমোদিত ধারণা। ধর্মবিষয়ক বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে রক্তপাত ও নরহত্যার বিযুক্তিসাধন হবে তাদের উন্নততর বোধের প্রথম সোপান। যেসব উত্তেজনা মানুষকে পশুর স্তরে নিয়ে যায় সেসব থেকে মুক্ত হয়ে তারা তখন শান্ত হয়ে ভাববে স্বীকৃত সত্যসমূহের কথা। তারা বুঝবে, বিশ্ববিধাতার বিধানে কোনো স্ববিরোধ ঘটতে পারে না, জগতের সব জাতির মানুষ ঈশ্বরদত্তরূপে পেয়েছে এই যে নির্দেশ : নির্দোষের রক্তপাত নিষিদ্ধ, এর কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না; আর যখন তাদের এই সর্বাগ্রগণ্য ও গর্হিততর প্রথার ভ্রান্তি সম্বন্ধে তারা অবহিত হবে তখন কি আশা করা যাবে না, অন্য যেসব প্রথা তাদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে আছে সেসবও দূর হয়ে যাবে, আর তাদের মনের ও কর্মধারার উপরে যেসব বন্ধনের সৃষ্টি হয়েছে সেসব থেকে এমনিভাবে মুক্ত হওয়ার ফলে এতকাল তারা যেভাবে প্রতি বিদেশী বিজেতার দাস হয়েছে তার অবসান হবে, আর মহাজাতিসমূহের ভেতরে তাদের প্রাপ্য স্থান তারা অধিকার করবে।
আমার এইসব মন্তব্য অথবা এই প্রস্তাবিত বিধির সঙ্গে, এদেশের লোকেরা যে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করবে, এমন ধারণার কিছুমাত্র যোগ নেই। আমি লিখছি আর অনুভব করছি হিন্দুদেরই একজন বিধিপ্রণেতা রূপে, আমার ধারণা অনেক জ্ঞানী হিন্দুও এমনি ভাবছেন ও অনুভব করছেন।