প্রবর্তক–-তুমি সহমরণ ও অনুমরণের অন্যথা বিষয়ে যে সকল শ্রুতিস্মৃতিকে প্রমাণ দিলে যদ্যপিও তাহার খণ্ডন কোনোরূপে হইতে পারে না কিন্তু আমরা ঐ হারীতাদি স্মৃতির অনুসারে সহমরণ ও অনুমরণের ব্যবহার করিয়া পরম্পরায় আসিতেছি ॥
নিবর্তক-–তুমি এখন যাহা কহিতেছ যে অতি অন্যায্য ঐসকল বাধিত বচনের দ্বারা এরূপ আত্মঘাতে প্রবর্ত করান সর্বথা অযোগ্য হয় দ্বিতীয়ত ঐ সকল বচনেতে এবং ঐ বচনানুসারে তোমাদের রচিত সঙ্কল্পবাক্যেতে স্পষ্ট বুঝাইতেছে যে পতির জ্বলন্ত চিতাতে স্বেচ্ছাপূর্বক আরোহণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিবেক কিন্তু তাহার বিপরীত মতে তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতির দেহের সহিত দৃঢ়বন্ধন কর পরে ঢাকায় উপর এত কাষ্ঠ দাও যাহাতে ঐ বিধবা উঠিতে না পারে তাহার পর অগ্নি দেণ্ডন কালে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়া চাপিয়া রাখ। ঐ সকল বন্ধনাদি কর্ম কোন হারীতাদির বচনে আছে যে তদনুসারে করিয়া থাকহ অতএব কেবল জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী হত্যা হয়।
প্রবর্তক–যদ্যপি এরূপ বন্ধনাদি করা শাস্ত্রপ্রাপ্ত নহে তথাপি তাবৎ হিন্দুর দেশে এইরূপ পরম্পরা হইয়া আসিতেছে এ প্রযুক্ত আমরা করি ॥
নিবর্তক-–তাবৎ হিন্দুর দেশে এরূপ বন্ধনাদি করিয়া স্ত্রী দাহ করা পরম্পরা হইয়া আসিতেছে যাহা কহিলে তাহা কদাপি নহে যেহেতু হিন্দুর অল্পদেশ এই বাংলা হইতেই কিঞ্চিকাল অবধি পরম্পরায় এরূপ বন্ধন করিয়া স্ত্রী বধ করিয়া আসিতেছেন বিশেষত কোনো ব্যক্তি যাহার লোকভয় ও ধর্মভয় আছে সে এমত কহিবেক না যে পরম্পরা প্রাপ্ত হইলে স্ত্রী বধ মনুষ্য বধ ও চৌর্যাদি কর্ম করিয়া মনুষ্য নিস্পাপে থাকিতে পারে এরূপ শাস্ত্রবিরুদ্ধ পরম্পরাকে মান্য করিলে বনস্থ এবং পার্বতীয় লোক যাহারা যাহারা পরম্পরায় দস্যুবৃত্তি করিয়া আসিতেছে তাহাদিগ্যে নির্দোষ করিয়া মানিতে হয় এবং এসকল কুকর্ম হইতে তাহাদিগ্যে নিবর্ত করণে প্রয়াস পাওয়া উচিত হয় না বস্তুত ধর্মাধর্ম নিরূপণের উপায় শাস্ত্র এবং শাস্ত্র সংমত যুক্তি হইয়াছেন সে শাস্ত্রের সর্ব প্রকারে অসম্মত এরূপ স্ত্রী বধ হয় এবং যুক্তিতেও অবলাকে স্বর্ণাদি প্রলোভ দেখাইয়া বন্ধনপূর্বক বধ করা অত্যন্ত পাপের কারণ হয় ॥
প্রবর্তক–এরূপ সহমরণে ও অনুমরণে পাপই হউক কিম্বা যাহা হউক আমরা এ ব্যবহারকে নিবর্ত করিতে দিব না ইহার নিবৃত্তি হইলে হঠাৎ লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সহমরণ করিলে এর আশঙ্কা থাকে না জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও যদি জীবৎকালে জানিতে পারে তাহার মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনো চিন্তা হয় না ॥
নিবর্তক–কেবল ভাবি আশঙ্কাকে দূর করিবার নিমিত্তে এরূপ স্ত্রী বধে পাপ জানিয়াও নির্দয় হইয়া জ্ঞানপূর্বক প্রবর্ত হইতেছে তবে ইহাতে আমরা কি করিতে পারি কিন্তু ব্যভিচারের আশঙ্কা পতি বর্তমান থাকিতেই বা কোন্ না আছে, বিশেষত পতি দূর দেশে বহুকাল থাকিলে ঐ আশঙ্কার সম্ভাবনা কেন না থাকে অতএব সে আশঙ্কা নিবৃত্তির উপায় কি করিতেছ ॥
প্রবর্তক–… স্ত্রীলোককে স্বামীর সহিত মরণে প্রবৃত্তি দিবার যথার্থ কারণ এবং এরূপ বন্ধন করিয়া দাহ করিবার আগ্রহের কারণ … স্ত্রীলোক স্বভাবত অল্পবুদ্ধি, অস্থিরান্তঃকরণ, বিশ্বাসের অপাত্র, সানুরাগা, এবং ধর্মজ্ঞানশূন্যা হয় ॥
নিবর্তক– … স্ত্রীলোককে যে পর্যন্ত দোষান্বিত আপনি কহিলেন, তাহা স্বভাব- সিদ্ধ নহে। … প্রথমত বুদ্ধির বিষয়, স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়। আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন না, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন? বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাটরাজার পত্নী, কালীদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে যাহাকে বিদ্যাভ্যাস করাইয়াছিলেন তাহারা সর্বশাস্ত্রের পারগ রূপে বিখ্যাত আছে, বিশেষত বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যক্তই প্রমাণ আছে যে অত্যন্ত দুরূহ ব্রহ্মজ্ঞান তাহা যাজ্ঞবল্ক্য আপন স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিয়াছেন, মৈত্রেয়ীও তাহা গ্রহণপূর্বক কৃতার্থ হয়েন।
দ্বিতীয়ত : তাহাদিগকে অস্থিরান্তঃকরণ কহিয়া থাকেন, ইহাতে আশ্চর্য জ্ঞান করি, কারণ যে দেশের পুরুষ মৃত্যুর নাম শুনিলে মৃতপ্রায় হয়, তথাকার স্ত্রীলোক অন্তঃকরণের স্থৈর্য দ্বারা স্বামীর উদ্দেশ্যে অগ্নি প্রবেশ করিতে উদ্যত হয়, ইহা প্রত্যক্ষ দেখেন, তথাচ কহেন যে তাহাদের অন্তঃকরণের স্থৈর্য নাই।
তৃতীয়ত : বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়। এ দোষ পুরুষে অধিক কি স্ত্রীতে অধিক উভয়ের চরিত্র দৃষ্টি করিলে বিদিত হইবেক। প্রতি নগরে প্রতি গ্রামে বিবেচনা কর যে কত স্ত্রী পুরুষ হইতে প্রতারিতা হইয়াছে, আর কত পুরুষ স্ত্রী হইতে প্রতারণা প্রাপ্ত হইয়াছে, আমরা অনুভব করি যে প্রতারিত স্ত্রীর সংখ্যা দশগুণ অধিক হইবেক … অথচ পুরুষে স্ত্রীলোককে প্রতারণা করিলে তাহা দোষের মধ্যে গণনা করেন না।…