রামমোহন যে সময়ে এদেশের সরকারকে বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন তখন ইংল্যান্ডেও শিক্ষার ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তিনি যখন এই বিখ্যাত চিঠি লেখেন, অর্থাৎ ১৮২৩ সালে, তার ১৩ বছর পরে সেখানে College of Chemistry প্রতিষ্ঠিত হয়, ৩৭ বছর পরে London University-তে Faculty of Science খোলা হয়, আর ৪৬ বছর পরে অক্সফোর্ডে ও কেম্ব্রিজে বিজ্ঞানের অধ্যাপনা রীতিমতো শুরু হয়।
এই কালের রামমোহনের আর একটি বড় কাজ, দুখানি সংবাদপত্রের পরিচালনা, একখানি বাংলাতে অপরখানি পার্সিতে, আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা। সেই স্বাধীনতা সম্পর্কে আবেদনে তাঁর যে সারগর্ভ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ উক্তি স্থান পায় তার জীবনী-লেখিকা মিস্ কলেট সেসবকে মিল্টনের বিশ্ববিখ্যাত ‘এ্যারিওপেজিটিকা’র মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর Appeal to King in Council-এর শেষ অনুচ্ছেদটি এই :
Your Majesty’s faithful subjects from the distance of almost half the globe appeal to your Majesty’s heart by the sympathy which forms a parental tie between you and the lowest of your subjects, not to overlook their condition; they appeal to you by the honour of that great nation which under your Royal auspices has obtained the glorious title of Liberator of Europe, not to permit the possiblity of millions of your subjects being wantonly trampled on and oppressed; they lastly appeal to you by the glory of your crown on which the eyes of the world are fixed, not to consign the natives of India to perpetual oppression and degradation.
রামমোহনের কথায় অবশ্য কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি। তবে পরে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মেটকাফের যত্নে মুদ্রাযন্ত্র তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। আর রামমোহনকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
খ্রিস্টান শাস্ত্রের আলোচনা করতে গিয়ে রামমোহনের একজন বন্ধুলাভ হয়, তিনি ব্যাপটিস্ট পাদ্রি উইলিয়ম অ্যাডাম। রামমোহনের সঙ্গে আলোচনার ফলে অ্যাডাম সাহেব ত্রিত্ববাদ পরিত্যাগ করে একত্ববাদে বিশ্বাসী হলেন। এ দেশের খ্রিস্টানসমাজ তাতে বিষম আন্দোলিত হয়। অ্যাডামকে তাঁরা বলেন স্বর্গভ্রষ্ট দ্বিতীয় আদম, আর রামমোহন মি. অ্যাডামের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করেন একটি একত্ববাদী প্রার্থনাসমাজ। তিনি ও তাঁর বাঙালি বন্ধুরা আর কয়েকজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক এতে যোগদান করেন। কিন্তু এ প্রচেষ্টাটি তেমন দানা বাঁধল না। কয়েকজন বাঙালি বন্ধুর আগ্রহে (মতান্তরে অ্যাডাম সাহেবের আগ্রহে) এরপর রামমোহন স্থাপন করেন ব্রাহ্মসমাজ-–১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ২০শে আগস্ট তারিখে। এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেই রামমোহনের নাম বিশেষভাবে জড়িত, আর দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। দিন দিন এটির উন্নতি হতে লাগল; ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে এই সমাজের জন্য নতুন গৃহ নির্মিত হল ও সে সম্বন্ধে সুবিখ্যাত Trust-Deed of the Brahmo Samaj রচিত হল। ব্রাহ্মসমাজ জমে উঠছে দেখে এর প্রতিস্পর্ধী ‘ধর্মসমাজ’ও প্রতিষ্ঠিত হল এই বৎসরের সূচনায়।
ধর্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আর একটি কারণ ছিল। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে সতীদাহ রহিত হয়। এর মূলে রামমোহন রয়েছেন। সংস্কার বিরোধীরা স্বতঃই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, এবং সতীদাহ-বিরোধী আইন নাকচ করা এই সভার বড় একটি উদ্দেশ্য হল।
সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহন লেখনি ধারণ করেন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য তার বহু পূর্ব থেকেই তিনি এর বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। সতীদাহ যে রহিত হওয়া উচিত, এটি মুসলমান যুগের কোনো কোনো শাসকের চিন্তায়ও এসেছিল। ইংরেজ শাসকেরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই প্রথার নৃশংসতা সম্বন্ধে সচেতন হন। খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকদের মধ্যে কেউ কেউ এর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু ধর্মাচারে আঘাত পড়লে এদেশের লোক বিগড়ে যাবে, সরকার বিপন্ন হবে, এই ভয়ে এটি রহিত করার কাজে কেউ অগ্রসর হন না। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জজ পণ্ডিতরা এর সম্বন্ধে মত দেন যে এটি হিন্দুর ধর্মকর্ম, আবশ্যিক নয়, প্রশস্ত, তবে গর্ভিণী, ঋতুমতী, যার সন্তান দুগ্ধপোষ্য, এমন সব বিধবার সহমৃতা হওয়া শাস্ত্রবিরুদ্ধ আর বলপ্রয়োগ এতে নিন্দিত। ক্রমে ক্রমে সরকার থেকে নিয়ম করা হল যে পুলিশ দেখবে কোনোরূপ বল প্রয়োগ সতীদাহের ব্যাপারে হচ্ছে কি-না। এই ধরনের নিয়ন্ত্রণের কড়াকড়ির বিরুদ্ধে সনাতনীরা সরকারের কাছে দরখাস্ত করে। তখন রামমোহন পর পর লিখলেন তাঁর ‘সহমরণবিষয়ক’ দুটি প্রস্তাব। তাঁর এই রচনা তার অন্যতম সাহিত্যিক কীর্তি। নারীর প্রতি যে অত্যাচার-অবিচার বহুকাল ধরে চলে আসছে এতে তার বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ ও বেদনাপূর্ণ প্রতিবাদ করা হয়; নারীর প্রতি এদেশের পুরুষেরা সাধারণত যে হীন ভাব পোষণ করত, তারও সমূহ অযৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা হয়, আর শাস্ত্রীয় প্রমাণসহযোগে দেখানো হয় যে, এটি আবশ্যিক নয় আদৌ–বিধবার ব্রহ্মচর্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ধর্মকর্ম। যে নৃশংসতার সঙ্গে এই দাহকার্য সমাধা করা হত তার মর্মস্পর্শী বর্ণনাও তিনি দেন। আমরা এর কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি :