রামমোহন সম্বন্ধে বিভিন্ন রচনায় আমরা নিবেদন করতে চেয়েছি–এই প্রচলিত মত বিচারসহ নয়। আমাদের বক্তব্য সংক্ষেপে এই :
১. যুক্তি ও শাস্ত্ৰ দুয়েরই সাহায্য গ্রহণ করতে রামমোহন বলেছেন, শাস্ত্রকে বাদ দিয়ে যুক্তির উপরে নির্ভর করতে কখনো কখনো বলেছেন, কিন্তু যুক্তিকে বাদ দিয়ে শাস্ত্রের উপরে নির্ভর করতে তিনি কখনো বলেননি–হিন্দু শাস্ত্রের আলোচনা কালেও নয়, খ্রিস্টান শাস্ত্রের আলোচনা কালেও নয়।
২. তুহফাতে তিনি বলেন শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তিবাদের কথা, তার পরে, হিন্দু শাস্ত্রের বিচার ও খ্রিস্টান ধর্মের বিচারের কালে, শাস্ত্রাশ্রয়ী যুক্তিবাদের কথা। কিন্তু তারপর পুনরায় তিনি শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তিবাদের দিকে প্রবণতা দেখান লর্ড আমহার্স্টকে লেখা তাঁর সুবিখ্যাত পত্রে তো বটেই, ব্রাহ্ম সমাজের ট্রাস্টডিডেও, কেননা, সেই ট্রাস্টডিডে পরমেশ্বরকে স্মরণ করতে বলা হয়েছে জগতের স্রষ্টা ও ত্রাতা রূপে আর তারই সঙ্গে বলা হয়েছে। মানুষের মনুষ্যত্বজ্ঞাপক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন করতে, আর সেই সঙ্গে পরস্পরের হিতসাধনায় রত হতে, কিন্তু কোনো বিশেষ শাস্ত্রের কিংবা কোনো বিশেষ মধ্যবর্তীর কিছুমাত্র উল্লেখ এই ট্রাস্টডিডে নেই। এর সঙ্গে আমাদের আরো বক্তব্য–যারা মনে করেন তুহফাতের যুগে ভক্তিভাব রাজার ভিতর ছিল না কিন্তু পরে সেটি বিকশিত হয় তাঁরা তুহফাত যত্ন করে পড়ে দেখলে বুঝবেন, সেই কালেও পরমেশ্বর সম্বন্ধে চেতনা ও সেই পরমেশ্বরের প্রতি তাঁর অনুরাগ কত নিবিড়। তুহফাতের উপরে ভলটেয়ার, ভলনি এদের প্রভাব পড়েছে এমন মনে করবার হেতু আছে, কিন্তু এদের প্রভাবে মধ্যবর্তী পয়গম্বর-অবতারাদি রামমোহনের দৃষ্টিতে মহিমাচ্যুত হয়েছেন, বিশ্ববিধাতা নন।
লর্ড আমহার্স্টকে লেখা রামমোহনের পত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেটি রামমোহনের জীবনে ও দেশের পক্ষে একটি বড় ঘটনা, তাই সে-সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইংরেজ সরকার বিব্রত হলেন দেশে জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, এসব অপরাধের ব্যাপকতা লক্ষ করে। মুসলমান ও হিন্দু কোনো সম্প্রদায়েই যে ধর্মের বিধি-নিষেধ ও সুনীতি শিক্ষার উপযুক্ত বন্দোবস্ত নেই তাও তাঁদের চোখে পড়ল। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মার্চের মিনিটে লর্ড মিন্টো বললেন–পুলিশের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই দেশের সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের সম্প্রসারণ। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস্ ঘোষণা করলেন :
A sum of not less than a lac of rupees shall be annually applied to the revival and improvement of literature and the encouragement of the learned natives of India.
অন্যূন এক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হবে দেশীয় সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উৎকর্ষ সাধনে আর ভারতীয় বিদ্বন্মণ্ডলীর উৎসাহ বর্ধনে। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত কাজে কিছু হয়নি। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে A General Committee of Instruction গঠিত হল ড. হোরেস হেম্যান উইলসন ও আরো কয়েকজন প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদকে নিয়ে, তাদের মন্ত্রণায় লর্ড আমহার্সট ঠিক করলেন, কলকাতায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হবে। অবশ্য তার সঙ্গে কিছু বিজ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করার কথাও হয়েছিল, কিন্তু ঝোঁক দেওয়া হয়েছিল প্রাচ্যবিদ্যার চর্চার উপরেই। এই সম্পর্কেই লর্ড আমহার্সটুকে রামমোহন পত্রখানি লেখেন। সেই পত্রের একটি অংশ এই :
ইংরেজ জাতিকে বাস্তবের জ্ঞান বর্জিত করে রাখা প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলে মধ্যযুগে যে শিক্ষার ধারা প্রচলিত ছিল তা পরিবর্তিত করে বেকনীয় দর্শনকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে দেওয়া হত না, তেমনিভাবে এ দেশকে অজ্ঞান-অন্ধকারে আবৃত রাখার প্রয়োজন হলে প্রাচীন সংস্কৃতশিক্ষা-পদ্ধতি বলবৎ রাখা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পক্ষে সঙ্গত হত। কিন্তু সরকার চাচ্ছেন এদেশের লোকের মানসিক উন্নতি, সেজন্য প্রয়োজন হচ্ছে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শরীরবিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের চর্চার সুব্যবস্থা করা…।
সরকারের পক্ষ থেকে এই চিঠিখানির কোনো উত্তর দেওয়া প্রয়োজনীয় বিবেচিত হল না, শুধু নথিতে এই মন্তব্য করা হল : রামমোহন রায় সরকারের উদ্দেশ্য ভুল বুঝেছেন, তাঁর মত তার একার মত, এ দেশের লোকমত নয়। এই চিঠিখানি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার উপরে এতে যে জোর দেওয়া হয় পরবর্তীকালে সরকারও সেই পথ অবলম্বন করেন। তবে রামমোহনের শিক্ষানীতিতে শুধু ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য আর পাশ্চাত্য দর্শন-বিজ্ঞান শিক্ষার দিকেই ঝোঁক ছিল না, ধর্মশিক্ষা, এদেশে দর্শনের চর্চা, বিশেষ করে মাতৃভাষার চর্চার দিকেও ঝোঁক ছিল। (ধর্মশিক্ষা সম্বন্ধে ড. ডফের কাছে তার উক্তি তার স্কুলের কথা, আর ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে বেদান্ত কলেজ স্থাপন করেন সেসব এই সম্পর্কে স্মরণীয়)। এই চিঠিখানিতে অবশ্য রামমোহন পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষার উপরেই জোর বেশি দিয়েছিলেন। তার কারণ সম্বন্ধে পরবর্তীকালে স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন : শুধু পরমার্থের দিকে আমরা বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম, বাস্তবের জ্ঞান আমাদের দেশে লোপ পেয়েছিল। রামমোহন আমাদের এই বড় ত্রুটি সংশোধন করতে চেয়েছিলেন।