মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান এই তিন সম্প্রদায়ের ধর্মাচার্যদের সঙ্গে রামমোহনের তর্কবিতর্কের সংবাদ আমরা পেলাম। রামমোহন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ধর্মের দিকে তাকিয়েছিলেন এইবার সেই ব্যাপারটা একটু বুঝতে চেষ্টা করা যাক। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আলোচনাও তিনি করেছিলেন, কিন্তু সে সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্য সংগৃহীত হয়েছে মনে হয় না। তুহফাত’ পুস্তিকাখানি পার্সিতে লেখা আর তার ভূমিকা আরবিতে লেখা। ভূমিকায় রামমোহন বলেছেন : তিনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং সর্বত্রই দেখেছেন জগতের একজন কর্তা ও পালয়িতা আছেন এ বিষয়ে লোকেরা একমত; কিন্তু কি তার স্বরূপ লক্ষণ, কোন ব্যাপার বৈধ কোন ব্যাপার অবৈধ, এসব ব্যাপার সম্পর্কে লোকেরা একমত নয়। তা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এক শাশ্বত মহাসত্তার সন্ধানী হওয়া যেন মানুষের স্বভাবগত, আর সেই মহাসত্তার বিশেষ বিশেষ রূপের কথা ভাবা, বিশেষ বিশেষ পদ্ধতিতে তার উপাসনা বা গুণকীর্তন করা, এসব মানুষের শিক্ষালব্ধ ব্যাপার। তিনি আরো বলেছেন, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোকে একে অন্যের মতের দোষ ধরে, কিন্তু ভুলে যায় তাদের দলের আচার্যরাও অন্যান্য মানুষের মতো ভুল-ভ্রান্তির অধীন ছিলেন। এইসব আলোচনা করে রামমোহন মন্তব্য করেন : তা হলে আমাদের বিচার্য দাঁড়ায়–হয় সব ধর্মমতই সত্য, নাহয় সব ধর্মই অসত্য। কিন্তু ধর্মমতগুলো পরস্পরবিরোধী, সেজন্য সব ধর্মমত সত্য হতে পারে না, আর এরূপ ক্ষেত্রে কোনো একটিকে সত্য বলা পক্ষপাতিত্ব করা। কাজেই সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় : সব ধর্মের মধ্যেই কিছু কিছু ভ্রান্তি আছে। বিভিন্ন ধর্মমতের ভিতরে ভুল কীভাবে আছে, মধ্যবর্তী অবতার-পয়গম্বর-আদির ধারণা কীভাবে অযৌক্তিক, তুহফাতে সেসবই সংক্ষেপে কিন্তু অপর্ব দক্ষতার সঙ্গে দেখানো হয়েছে। আরবি তর্ক-বিজ্ঞানে রামমোহনের সবিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল, সেই বিজ্ঞানের সাহায্য তিনি তার যুক্তিধারায় গ্রহণ করেন। তুহফাতের একটি অংশের মর্ম এই :
সব ধর্ম আত্মা ও পরকালে বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত; যদিও এই দুয়ের স্বরূপ দুয়ে, তবু এতে বিশ্বাস তেমন দোষাৰ্থ নয়, কেননা মানুষ দুষ্কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে পরলোকের ভয়ে ও রাজভয়ে। কিন্তু এই দুই প্রয়োজনীয় বিশ্বাসের সঙ্গে পান আহার পবিত্রতা-অপবিত্রতা শুভ-অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে কত শত অকল্যাণকর ও বুদ্ধিনাশকর বিশ্বাস সম্মিলিত হয়েছে ও তাতে মানুষের দুঃখ বেড়ে গেছে। তবু মানুষের অন্তরে এই শক্তি নিহিত আছে যে, এইসব বিশ্বাস সত্ত্বেও সে যদি নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন জাতির ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাস হয়, তা হলে কি সত্য আর কি-ই বা অসত্য, তা সে নিরূপণ করতে পারবে আশা করা যায়; ও এইভাবে অর্থহীন ধর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এক অদ্বিতীয় মঙ্গলবিধাতার প্রতি ও সমাজকল্যাণের প্রতি মনোযোগী হতে পারবে।
তুহফাতের শেষে হাফিজের দুটি চরণ উদ্ধৃত হয়েছে, তার বাংলা অনুবাদ এই :
অত্যাচারী হয়ো না, আর যা খুশি করো।
আমাদের পন্থায় এ ভিন্ন আর কোনো পাপ নেই।।
এটি রামমোহনের একটি অতি প্রিয় পার্সি বয়েতের প্রতিধ্বনি; সেই বয়েতটির অনুবাদ এই :
ধর্ম জীবের সেবা ভিন্ন আর কিছু নয়
জপমালা, আলখাল্লা ও আসনে ধর্ম নেই।
তা হলে তুহফাতে রামমোহনের সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে এই :
সহজভাবে মানুষ বিশ্বের স্রষ্টা ও পালয়িতার সন্ধানী হোক আর পরস্পরের হিত সাধন করুক। এই-ই মানুষের জন্য চিরন্তন ধর্ম। বিভিন্ন ধর্মে অবতার পয়গম্বর ইত্যাদিকে যে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মনে করে পরমেশ্বর ও মানুষ এই দুয়ের মধ্যবর্তী ভাবা হয়, তা ভ্রান্তিপূর্ণ। প্রকৃতির দিকে তাকিয়েই মানুষ জগতস্রষ্টা মঙ্গলবিধাতা পরমেশ্বরের সন্ধান পেতে পারে।[৬]
তুহফাতের পরে হিন্দুশাস্ত্রের চর্চার কালে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, রামমোহন তাঁর ধারা বদলেছেন–তুহফাতে প্রত্যাদিষ্ট শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়নি, কিন্তু হিন্দুশাস্ত্রের বিচারের কালে দেখা যাচ্ছে, তিনি শাস্ত্রকে প্রামাণ্যরূপে অবলম্বন করে মীমাংসা করতে চাচ্ছেন ধর্মপথ বা কল্যাণপথ কী। এ সম্বন্ধে কেন উপনিষদের ইংরেজি তর্জমার ভূমিকায় তিনি বলেছেন : প্রাচীন জাতিগুলোর ধর্মমতের দিকে যখন তাকাই তখন দেখি সেইসব মতের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা বর্তমান। সেইসব ধর্মমত সম্বন্ধে নিরূৎসাহ হয়ে যখন যুক্তির দিকে তাকাই তখন দেখি যুক্তি নিয়ে যায় ব্যাপক সংশয়ে–তাতে চিত্তের অসন্তোষ ও সুখের বিলোপ ঘটে। সেজন্য শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে হয় এই দুয়ের কোনো একটির পক্ষপাতী না-হওয়া বরং দুয়েরই যথাযোগ্য সাহায্য নিয়ে আমাদের বৌদ্ধিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করা, আর সর্বশক্তিমানের সদয়তার উপর নির্ভরশীল হওয়া, কেননা তা থেকেই আমাদের সমস্ত আকাক্ষা ও শ্রমের সার্থকতা। খ্রিস্টান শাস্ত্রের বিচারেও রামমোহনের এই দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তাঁর সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে যে তুহফাত রচনার কাল পর্যন্ত তার ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত ছিল শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তিবাদের উপরে, কিন্তু পরে তাঁর মতের পরিবর্তন হয়, তিনি অবলম্বন করেন শাস্ত্রাশ্রয়ী যুক্তিবাদ।