সাহিত্যের মূল্য ও ভূমিকা বুঝতে হলে সাহিত্যকে সাহিত্য হিসেবে দেখার একটা নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি অত্যাবশ্যক। রাজনৈতিক দল ও সুবিধা সন্ধানীরা এই দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারছে না বলে আজ সাহিত্যিক, সাহিত্য-প্রতিষ্ঠান ও সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদি এক অবাঞ্ছিত শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে। ফলে জাত লেখক ও সাহিত্য-সেবীরা আজ অনেকটা দিশেহারা। সব দেশের মতো আমাদের দেশেরও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয়তার সুষ্ঠু রূপ গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ যদ্দিন না হচ্ছে তদ্দিন সাহিত্য সাহিত্যিকের দুর্গতির অবসান ঘটবে না। বর্তমানে যারা প্রগতিশীল বলে পরিচিত, যারা লেখায় কিছুটা তেল-নুন-লাকড়ির কথা বলেন, তাঁদের পক্ষে কোনো সাহিত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়া পর্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, কাগমারিতে যে কয়টা বড় আকারের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে, যদিও এর কোনোটাই নিছক বামপন্থীদের অনুষ্ঠান ছিল না, তবুও এর প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিরোধিতার ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকার কোনো কোনো দৈনিক প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন। তারপর দিনের পর দিন চলতে থাকে নিন্দার খেউড়! এ হচ্ছে এই অভিযোগের প্যাটার্ন! এঁদের চোখা নিন্দা হচ্ছে, ‘ওরা কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল অথবা যুক্তবঙ্গের সমর্থক। কোনো যুক্তি নেই, কোনো প্রমাণ নেই–একটা rational উক্তি পর্যন্ত নেই। শুধু কটুক্তি। এদের মনে এ প্রশ্ন উদয় হয় না যে, আমাদের অত বড় গোয়েন্দা বিভাগ কী করতে আছে? এ সব তাদের কাজ। অতগুলি ভারতের দালাল আর কমিউনিস্ট এখানে অত বড় বড় সভা করে বেড়াচ্ছেন আর তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন–এটা তাদের পক্ষে কিছুমাত্র প্রশংসার কথা নয়! আশ্চর্যের বিষয়–যুক্তবঙ্গের ধুয়া আজ পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থীদের হাতে একটা মোটা লাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সুযোগ-সুবিধা মতো তাঁরা বামপন্থী লেখক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাথায় ভাঙতে কিছুমাত্র দ্বিধা করেন না। স্বয়ং শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এই লাঠির ঘা থেকে বাঁচতে পারেন নি। অথচ বামপন্থী রাজনৈতিক মতবাদের তার চেয়ে বড় দুশমন বোধ করি আর দ্বিতীয়টি নেই। মুশকিল হচ্ছে, সুবিধাবাদী রাজনীতি ন্যায় ও সত্য ধর্ম কিছুরই তোয়াক্কা করে না। ফলে ‘ইসলাম’ ও ‘পাকিস্তান’ শব্দ দুটিও আজ এদের সুবিধা হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
এক মন্ত্রিসভার পতনের পর কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন উপলক্ষে আমাদের এক অতি প্রবীণ জননায়ক যখন করাচি যাওয়ার সংকল্প করেন তখন তিনি কাগজে এই মর্মে এক বিবৃতি দেন যে, শুধু ইসলামের জন্যই তিনি করাচি যাচ্ছেন। কিন্তু তার যাত্রার আগেই মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে যাওয়ায় তিনি আর করাচি যান নি। লজিক অনুসারে, আর একটা বিবৃতি দিয়ে ইসলামের জন্যই তিনি যাওয়ায় সংকল্প ত্যাগ করেছেন–একথা বলা উচিত ছিল, বোধ করি চক্ষু-লজ্জার খাতিরে বলেন নি। বাঘের রাজনীতিতে যেমন কোনো লজিক নেই, তেমনি সুবিধাবাদী রাজনীতিতেও লজিকের বালাই নেই। থাকলেও সেই লজিক জঙ্গলের লজিক। অর্থাৎ শেরে পাকিস্তান আর শেরে জঙ্গলিস্থান একই লজিকের ম্যাজিসিয়ান–এঁরা নিজস্ব লজিক দিয়ে ম্যাজিক দেখান–কেউ মেষশাবককে, কেউ আমাদের মত বাঙালকে, তাই এ দুটি শব্দকে নিজেদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দিকে চোখ রেখে ইচ্ছামতো বাকানো হচ্ছে, মোচড়ানো হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে। যাক এ সবই রাজনীতির কথা। আমি সাহিত্যের সঙ্কট নিয়েই আলোচনা শুরু করেছিলাম। তার জের টেনেই এই আলোচনা শেষ করা যাক। দেশের রাষ্ট্ররূপ স্থিতিশীল ও সুস্থভাবে গড়ে উঠছে না বলে সাহিত্যিকরাও আজ সাহিত্য-সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। নিকট ভবিষ্যতেও অনুকূল পরিবেশের কোনো রকম আভাস দেখতে পাচ্ছেন না বলে এক সর্বাঙ্গীণ হতাশার মধ্যে তার জীবন্ত অবস্থায় কোনো রকমে বেঁচে আছেন শুধু। সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আশা আজ পাকিস্তানে রীতিমত দুরাশাই। ফলে প্রবীণরা আজ হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের অনেকে অনন্যোপায় হয়ে এমন সব চাকুরিতে ঢুকে পড়ছেন, যে চাকুরির সঙ্গে সাহিত্যের প্রায় অহি-নকুল সম্পর্ক।
তরুণ-প্রবীণ সকলের মুখে আজ এক কথা–কেন লিখব? কার জন্য লিখব? কে ছাপবে? কে পড়বে?
এসব প্রশ্নের কি কোনো উত্তর নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে সেই উত্তরের অনুকূল পরিবেশ রচনার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। বিশেষ করে রাষ্ট্রের কারণ রাষ্ট্রের–আদর্শেই সমাজ রূপায়িত হয়ে ওঠে।
আর একটা কথা। পাকিস্তান আন্দোলন ও তার অভাবিত সাফল্য কী মাহেন্দ্র মুহূর্তই না নিয়ে এসেছিল আমাদের সামনে। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি নি। সুদীর্ঘকালে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝায় টিকে থাকা একই রাষ্ট্রীয় কাঠোমো ভেঙে দু-দুটা স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে।
এই জন্ম-বেদনার বেদীমূলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, বাস্তুহারা হয়েছে। অনেকে সর্বহারা হয়ে পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংখ্যক সরু সরু আঙুল যে ফুলে কলাগাছ হয় নি তা নয়। তবে বৃহত্তর জনসংখ্যার তুলনায় তা নগণ্য। লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্তের এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে ছিন্নমূল হয়ে ভেসে গেছে, ভেসে এসেছে। দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, আমরা এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী হয়েছি, এ যেমন অভাবিত আনন্দ-উল্লাসের বস্তু–তেমনি, অগণিত বাস্তুহারার বেদনামথিত চোখের জলে দেশের আকাশ-বাতাস হয়েছে আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ। সীমান্তের দুই পারেই লাঞ্ছিত মানবতার বহু মর্মন্তুদ দৃশ্যই সাহিত্যিক-শিল্পীদের চোখের সামনে অভিনীত হয়েছে। মানুষের বেদনাহত চিত্তের এই গভীর সুখ-দুঃখ ও হাসি অশ্রুর বিচিত্র কাহিনীই তো যুগে যুগে মহৎ শিল্পের প্রেরণা জুগিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, এসব এখনো আমাদের কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা হয় নি, কোনো কবির কণ্ঠে সংগীত হয়ে ঝরে পড়ে নি, কোনো সাহিত্যিকের লেখনীতে রূপ নেয় নি। আমাদের সাহিত্যিকরা কেউ অল কোয়াইট বা ঝড় কী নবম তরঙ্গ লিখতে পারেন নি। অথচ হাতের কাছে চোখের সামনে লেখার যথেষ্ট উপকরণ ছিল। এমন কি কাণ্ডারি হুঁশিয়ারের মত একটা জাতীয় সংগীতও আমাদের কবিরা দেশকে দিতে পারেন নি। যার সুর ও বাণী-রূপ দেশের আপামর জন-চিত্তে বর্ষার বন্যা-বেগ সঞ্চার করে দিতে পারে। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিকতার আগে জাতীয়তা। জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলার পরই আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বিচরণ সহজ ও সম্ভব। যে মানুষ পুকুরে সাঁতার কাটতে অক্ষম তার পক্ষে সমুদ্র সন্তরণের বুলি না আওড়ানোই ভাল।