আমরা কী লিখলে, কেমন করে লিখলে শাসকদের বিষনজরে পড়ব না তাও আমাদের এক মহা দুশ্চিন্তা। ফলে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, বিনা আবেগ ও বিনা প্রেরণায় আমরা সাহিত্যিকরাও বহু শ্লোগান আউড়িয়েছি এই কবছর ধরে। তা সত্ত্বেও সাহিত্যের অগ্রগতির চেয়ে পশ্চাদগতিই হয়েছে বেশি। বরং যারা এসব বেশি করে আউড়িয়েছেন তাঁদের পদক্ষেপ সামনের চেয়ে পেছনের দিকেই হয়েছে দ্রুততর। কারণ, পেশাগত তথা অর্থকরী আবেগ ও প্রেরণা ছাড়া এসবের পেছনে আন্তরিকতার লেশমাত্রও ছিল না। যে আন্তরিকতা হচ্ছে সাহিত্য-শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের মনের আন্তরিকতাকে শুধু যে অঙ্কুরিত হতে দেয় নি তা নয়, যা ছিল সহজাত তাকেও অনেকখানি বিনষ্ট করে ছেড়েছে। আর বলেছি আমাদের নতুন ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনা’ ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে, আবেগ ও প্রেরণায় অনুরঞ্জিত হয়ে, সাহিত্যের উপকরণ হয়ে উঠতে বেশ সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। জাতির মন-মানস স্থিরতা পেতে ও স্থির হয়ে যা আত্মস্থ করার তা আত্মস্থ করতে, যা বর্জন করার তা বর্জন করতে বেশ সময় নিয়ে থাকে। এভাবে ‘গ্রহণ’ ও ‘বর্জনের’ ফলে জাতীয় ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনা’ স্থিতি লাভ করে। দেশ যেমন আমাদের ছোট হয়ে গেছে, আমাদের আবেগ, প্রেরণা ও উপকরণের ক্ষেত্রও হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র, এমন কি পাঠকও হয়ে পড়েছে শোচনীয় রূপে সীমিত। ভাল ছাত্র ও বড় ক্লাস যেমন অধ্যাপককে ভাল অধ্যাপক হওয়ার ও পঠনীয় বিষয় সম্বন্ধে সর্বাঙ্গিন প্রস্তুতির তাগিদ দিয়ে থাকে, তেমনি ভাল তথা সমজদার পাঠকও বহু সাহিত্যিককে রচনার মান উন্নয়নের প্রেরণা জুগিয়ে থাকে। ইংরেজি সাহিত্য এর বড় দৃষ্টান্ত। আমাদের মনের সামনে, চোখের সামনে পাকিস্তান বলে কোনো দেশ নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। সমগ্র পাকিস্তানের পটভূমিতে, তার ঐতিহ্য ও মানুষের জীবন নিয়ে কিছু লেখা আজ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মন-মানসে আমরা আজ হয় পূর্ব পাকিস্তানি না হয় পশ্চিম পাকিস্তানি, এ সত্যকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ হতে পারে কিন্তু বাস্তববোধের পরিচায়ক নয়। আমরা হয় পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক, না হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যিক। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের সাহিত্যিক আমরা কেউই নই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যের শুধু যে ভাষা পৃথক তা নয়–তার মন-মেজাজ, জীবন-জিজ্ঞাসা, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গি আর শিল্পরূপও পৃথক। পাকিস্তানের দুই অংশের ইতিহাস ভূগোল ও ঐতিহ্য সম্পূর্ণ আলাদা। দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব এত দুস্তর যে কল্পনায়ও সাধারণ নাগরিক একটার সঙ্গে আর একটার যোগসাজস করতে অক্ষম। এই দূরত্ব প্রাকৃতিক বলেই দুর্লঙ্ঘ্য। ইংরেজের সঙ্গে। আমেরিকাবাসীর যতখানি মিল আমাদের ততখানি মিলও নেই। ওদের বংশ এক, ধর্ম এক, ভাষা এক; আচার-বিচার, পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত প্রায় এক। তবুও ওরা এক রাষ্ট্র বা এক জাতি হতে পারে নি। আমাদের এক ধর্ম ছাড়া সব ব্যাপারেই গরমিল। একমাত্র ধর্মই যদি রাষ্ট্র বা জাতির মূলভিত্তি হয় তাহলে আফগানিস্তান আর পাকিস্তান এক রাষ্ট্র বা এক জাতি নয় কেন? ইংরেজ আর ফরাসিই বা নয় কেন? অথচ ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মাঝখানে একটি মাত্র খালের ব্যবধান, যে খাল পূর্ব পাকিস্তানের ব্রজেন দাসও সতরে পার হতে পারে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুধু ইতিহাস-ভূগোলে যে পার্থক্য তা নয়; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা এবং ধ্যান-ধারণায়ও রয়েছে আসমান-জমিন ফারাক। পশ্চিম পাকিস্তান পুরোপুরিই সামন্ততান্ত্রিক–পূর্ব পাকিস্তান তার ঠিক উল্টো, একদম সাধারণ মানুষের দেশ এটা। সামন্ততান্ত্রিক অবস্থার প্রধান গলদ তা মর্মান্তিকভাবেই ব্যক্তিগত স্বার্থকেন্দ্রিক।
এত সব বৈষম্য রয়েছে বলেই তো পাকিস্তানের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছুতেই স্থিতিশীলতা আসছে না। কেন্দ্রে রাজনৈতিক ব্যারোমিটার ওঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রদেশের রাজনৈতিক ব্যারোমিটারও বিনা কারণে ওঠানামা করে, করতে বাধ্য হয়; ফলে কোথাও স্থিতিশীলতা ও আর্থিক নিরাপত্তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সাহিত্যিক শিল্পীদের সামনে এই তো আজ দেশের রাষ্ট্র-রূপ। এই রূপ সাহিত্য রচনার অনুকূল কিছুতেই নয়।
ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচ্ছিন্ন ও খুচরো কিছু কিছু ফসল যে এ অবস্থায় ফলে না তা নয়। কিছু ভাল গল্প-কবিতা এখানে ওখানে হয়ত লেখা হতে পারে, হচ্ছেও। কিন্তু বৃহত্তম পরিধিতে ব্যাপকতর ছকে মহত্তর সাহিত্য–যে সাহিত্য দেশ ও জাতির জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মোপলব্ধি রূপায়িত হয়ে ওঠে, জাতির মন-মানস ও আত্মা প্রতিফলিত হয়, তা কিছুতেই সম্ভব নয়। যে কোনো বড় সৃষ্টির জন্য আর তার সমজদারি তথা appreciation–এর জন্য যে অনুকূল পরিবেশ দরকার তা আজ কোথায়? গুণ-গ্রাহিতার কোনো লক্ষণ আজ কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে কি? প্রেসিডেন্টের পুরস্কার বড়, বয়স্ক ও veteran-দের জন্যে তোলা থাক। আমি সাধারণ, মাঝারি ও তরুণ লেখকদের কথা বলছি–এঁদের জন্য অনুকূল পরিবেশ চাই। প্রকাশক, ক্রেতা ও সাধারণ পাঠকের আনুকূল্য ছাড়া এসব লেখক লেখক হিসেবে বাঁচতে পারেন না। এঁদের লেখায় আসতে পারে না ক্রমোন্নতি। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন বিষয়ে এঁরাই একাগ্র সাধনায় সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও প্রসার বাড়িয়ে থাকেন। শেপিয়র বা রবীন্দ্রনাথ আর কয়টা? সংখ্যাতীত মাঝারি লেখকরাই পৃথিবীব্যাপী সাহিত্যকে গড়ে তুলেছেন ও দিয়েছেন বৈচিত্র্য। আমাদেরও এই মাঝারিদের সাধনা-নিষ্ঠার ওপর নির্ভর করতে হবে। জীবন ও জীবনের সমস্যা সম্বন্ধে যে যে মতই পোষণ করুক, অথবা রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা যার যেমন হোক–দল মত নির্বিশেষে সব লেখককে লেখার স্বাধীনতা দিতে হবে। এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য বিশেষ করে পাকিস্তানের দুই অংশে দৃষ্টিভঙ্গির যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, তার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের লেখকরা কিছুতেই দ্বিধামুক্ত হতে পারছে না। এমন কি দক্ষিণপন্থী মন্ত্রীসভা কায়েম হলে বামপন্থী লেখকদের বুক দুরু দুরু করতে থাকে আবার বামপন্থী মন্ত্রীদল গঠিত হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিলে দক্ষিণপন্থী লেখকদের মুখ কালো হয়ে যায়।