সন্দেহ বা কিছুটা অবিশ্বাসও শিল্পের ক্ষেত্রে মূল্যহীন নয়। ইবনে রুশদ বলেছেন মঙ্গলের গোড়া হলো সন্দেহ। যে বহির্জগতের সঙ্গে নিয়ত সমঝোতার সংগ্রামই মানুষের বিধিলিপি, বিনা প্রশ্নে তার সব কিছু মেনে নিলে হাতিয়ারের ধারটাই যায় ভোতা হয়ে। মানুষের পরিবেশ তথা সমাজ সভ্যতা সব কিছুই তখন হয়ে পড়বে স্থবির। জিজ্ঞাসা তাই শিল্পী-মনের এক বড় শর্ত–বহু প্রেরণার এক উৎস-মুখ। এর ফলে সাহিত্য হয় বিচিত্রগামী, হয়ে ওঠে বহুমুখী।
আমাদের সাহিত্যের আজ এ বহুমুখীনতার অভাব। লেখকের আয়ত্তের বাইরে এমন নানা কারণেও আমাদের লেখকেরা হতে পারছেন না জিজ্ঞাসা-মুখর বা বেপরোয়া। সাহিত্য-শিল্পের ব্যাপারে সমাজ বা রাষ্ট্রকে আরো সহিষ্ণু হতে হবে। এ সহিষ্ণুতার পথ রচনার দায়িত্ব কিন্তু সাহিত্যিক-শিল্পীদের। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে এ পালা বদল ত্বরান্বিত করা যেতে পারে বটে কিন্তু সে তো পেশাদার রাজনীতিবিদদের দ্বারা হবে না। আর সাহিত্যিক-শিল্পীরা বা তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে কোনোদিন শরিক হবে তাও ভাবা যায় না। তাই ওই পথ পরিত্যাজ্য। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক দল যদি আইনের সাহায্যে তেমন একটা পরিবেশ গড়তেও চায়, জনসাধারণের সার্বিক সমর্থন ছাড়া তাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই শেষ। পর্যন্ত সাহিত্যের সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য, নব নব পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুঃসাহসিক অভিযান সব কিছুই নির্ভর করছে পাঠক বা জনসাধারণের ওপর। তাদের গড়ে তোলার দায়িত্ব লেখকদের। বিভিন্ন, বিচিত্র আর নব নব চিন্তা পরিবেশন ছাড়া অবশ্য সাহিত্যের লেবাছ এর অন্য কোনো পথ আমার জানা নেই। ‘আমোদ’ দিয়ে এ হবে না–এ বিষয় আমি স্থির নিশ্চিত। ‘আমোদ’ সংগ্রামের আনুষঙ্গিক হতে পারে০০মৌল উপাদান হতে পারে না কিছুতেই। একমাত্র সুস্থ চিন্তাই জীবনের সমন্বয় সাধনে সক্ষম। সে চিন্তার অভাব আমাদের সাহিত্যে পরিলক্ষিত বলেই কথাটা উত্থাপন করলাম। রচনায় চিন্তার দিগন্ত আরো প্রসারিত করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। আমাদের মানে লেখকদের।
[১৯৬৬]
[‘সাহিত্যের ভূমিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয় মাহেনও পত্রিকার মার্চ ১৯৬৬ সংখ্যায়। পরে এটি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধে সংকলিত হয়।]
সাহিত্যের সঙ্কট
এ যুগের সাহিত্যিক-শিল্পীরা কালের ও রাষ্ট্রের যুপকাষ্ঠের এক রকম বলি বললেই চলে। শহীদ তাঁরা নন। শহীদ কথাটা আরো অর্থপূর্ণ, সঙ্গে সার্থকতার রয়েছে সংযোগ–আদর্শনিষ্ঠা ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আত্মদানের গৌরব। সাহিত্যিক-শিল্পীরা আজ তা নন–তারা আজ হাড়িকাঠের বলি। স্বাধীনতার পর দেশের যা অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থার যুপকাষ্ঠে সাহিত্যিক-শিল্পীরাই হচ্ছে নির্ভেজাল বলি।
পাকিস্তান হওয়ায় পর ভাষার ওপর চলেছে এক উৎপাত–যে ভাষা হচ্ছে। সহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। যে আবেগ ও প্রেরণা মহৎ রচনার প্রাণ, যা সাহিত্য-শিল্পীকে রচনায় করে তোলে উদ্বুদ্ধ, যা নিয়ে আসে এক অনির্বচনীয় তন্ময়তা তা আজ অনুপস্থিত–দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য সেই আবেগ ও প্রেরণা আজ রুদ্ধগতি। দেশ বা জাতির কোনো চেহারাই আজ আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে না। আবেগ ও প্রেরণার দেশগত ও জাতিগত ঐক্য-বোধ আজ নিশ্চিহ্ন। ফলে আমাদের বাইরে ও ভেতরে সর্বত্র এক নৈরাজ্য। এ অবস্থা সাহিত্য শিল্পের অনুকূল অবস্থা মোটেও নয়–না সাহিত্য-সৃষ্টির, না সাহিত্য-উপভোগের।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে বিখ্যাত আইরিশ কবি W. B, Yeats ‘Popular memory’ ও ‘ancient imagination’-এর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এসব দেশের ভূগোল ইতিহাস কিংবদন্তি কেচ্ছাকাহিনী ও রূপকথা ইত্যাদি অবলম্বন করে, বংশানুক্রমে জাতির স্মৃতি ও কল্পনায় মিশে, ঐতিহ্য হয়ে শিল্পীর আবেগ। ও প্রেরণার উপকরণ হয়ে ওঠে। popular memory ও ancient imagination কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ধর্ম-ভিত্তিকও হতে পারে কিন্তু তার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। দেশ ও দেশের ঐতিহ্যভিত্তিক স্মৃতি ও কল্পনার ক্ষেত্র আরো ব্যাপক, সামগ্রিক ও সার্বজনীন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তাঁর ‘মোহরম’ থেকে অনেক উচ্চাঙ্গের কবিতা, তার কাব্যগত আবেদনও অনেক বেশি ও ব্যাপকতর। ‘বিদ্রোহী’তে কবির বাণী-মূর্তির সঙ্গে popular memory ও ancient imagination-এর এক চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে। কোনো কোনো স্তবক গঠনে ক্রটি ও ভাবের অসঙ্গতি সত্ত্বেও এ কবিতার আবেগ ও ব্যক্তিত্ব যে নির্বিশেষ ও অপ্রতিরোধ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আজ আমাদের popular memory ও ancient imagination খণ্ডিত শিল্পীর মন মানস বিপর্যস্ত, ছিন্নমূল ও নোঙরহীন। এ অবস্থায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য হতে পারে কিনা জিজ্ঞাস্য।
আমাদের যা কিছু উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বা রচনা সবই আমরা যখন বাঙালি ছিলাম তখনকার–বিষাদ সিন্ধু, উন্নত জীবন, মহৎ জীবন, পারস্য প্রতিভা, মানব মুকুট, শান্তিধারা, আবদুল্লাহ, মোমেনের জবানবন্দী, নকসী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ইত্যাদি। নজরুলের রচনার উল্লেখ নাই বা করলাম। তথাকথিত এ স্বাধীনতার পর আমাদের প্রবীণরা যেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন নি, তেমনি পারেন নি তরুণরাও। এমন কি জয়নুল আবেদিনেরও যা কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি তাও সব স্বাধীনতার আগেই আঁকা। সাহিত্য যতখানি জীবনের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ছবি ততখানি নয়। ‘ব্যক্তি’র প্রাধান্য ছবিতে অনেক বেশি। তাই মনে হয়, বর্তমান পরিবেশে ছবির ভবিষ্যৎ কিছুটা উজ্জ্বল হলেও সাহিত্যের মোটেও নয়। জাতির পুরনো ঐতিহ্য, প্রবহমান স্মৃতি ও কল্পনা ছবির ক্ষেত্রেও যে কতখানি প্রেরণার উৎস হতে পারে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রভৃতি শিল্পীর বহু নামকরা ছবিই তার দৃষ্টান্ত। পুরনো স্মৃতি ও কল্পনা অবলম্বন করে আবদুর রহমান চাঘতাই বহু স্মরণীয় ছবি এঁকেছেন। কিন্তু চাঘতাইর জন্য যা স্বাভাবিক জয়নুল আবেদিনের জন্য তা স্বাভাবিক নাও হতে পারে। উভয়ের ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনার’ ঐতিহ্য এক নয়, তার ওপর নন উভয়ে এক স্কুলের শিল্পী,–দুইয়ের মন-মানস ও ধ্যান-ধারণার পটভূমিও ভিন্নতর। তাই উভয়ের ছবি সম্পূর্ণ আলাদা জাতের ও আলাদা জগতের।