জীবনানন্দ দাশের অতিপরিচিত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় বনলতা সেন নামক কয় লাইনের কবিতাটির রস গ্রহণ করতে হলেও প্রাচীন ইতিহাস ভূগোলের জ্ঞান দরকার। ‘বিদর্ভ’, ‘বিদিশা’, ‘শ্রাবস্তী’, ইত্যাদি সম্বন্ধে যার কোনো ধারণা নেই, এসব উপমা তার কল্পনায় কোনো রূপকল্পেরই সৃষ্টি করবে না। ফলে জাগবে না তার মনে কোনো রসবোধ। শব্দগুলির একমাত্র ধ্বনিগত সৌন্দর্যেই তাকে থাকতে হবে পরিতপ্ত। তাই ঐতিহ্যের অন্তরের দিক অর্থাৎ ভাবের দিকের পরিচয় যেমন দরকার তেমনি তার বহিরঙ্গের পরিচয়ও অত্যাবশ্যক। ঐতিহ্যের এই দুই রূপের মিলন ঘটেছে ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বনলতা সেনে’। এর ফলে কবিতা দুটির অর্থ-ব্যাপ্তি ও আকর্ষণ যে বেড়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। ইতিহাস, ভূগোল পুরাণ-কাহিনী, রূপকথা, কিংবদন্তি, লিজেন্ড এপিক আর ব্যাপক অর্থে যাকে ক্লাসিক্স বলা হয় এসবই সাহিত্যের ঐতিহ্য। ক্লাসিকস শুধু যে রচনার দেহ অলঙ্করণের উপকরণ জোগায় তা নয়, রচনার অন্তরলোকের রূপায়ণেও তা সাহায্য করে। সাহিত্যের একটা চিরন্তন নীতি ও নিজস্ব চরিত্র আছে–ঐতিহ্যবোধ সেই ধারণাকে স্পষ্টতর করে তোলে। ফলে লেখকও বেঁচে যায় বহু বিভ্রান্তির হাত থেকে। সাহিত্যের নীতি বা চরিত্র কোনোক্রমেই সাম্প্রদায়িক বা দলীয় নয়। তাই খাঁটি সাহিত্য ব্যক্তিক হয়েও নৈর্ব্যক্তিক, সামাজিক হয়েও অসামাজিক, জাতীয় হয়েও আন্তর্জাতিক।
বলেছি আমাদের এক বড় অভাব–আমাদের নিজস্ব কোনো ক্লাসিক্স নেই। তবে আজকের দিনে তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। কারণ, এখন কোনো দেশই আগের মতো খণ্ড-বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে পারবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এখন সব দেশের মানুষের মনের পটভূমি অন্তত এক হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও আয়ত্ত করতে হবে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের খবরদারি। আজ সাহিত্যের ঐতিহ্য মানে বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিকেও দিতে হবে স্থান এবং তাকে নিতে হবে নিজের করে। শুধু বাপের মিরাছ নিয়ে যেমন কোনো ছেলেরই দীর্ঘকাল চলে না তেমনি শুধু দেশগত ঐতিহ্য নিয়েও আমাদের দীর্ঘকাল চলবে না। শুধু আমাদের কেন কোনো দেশেরই চলে না। এখন দেশের ঐতিহ্য ও বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহ্য–এই দুইয়ের মিলনভূমির ওপর হবে নতুন ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন।
এর মানে এই নয় যে, সমসাময়িককে উপেক্ষা করতে হবে। (সব দেশের) সমসাময়িক সাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় ছাড়া সমসাময়িক যুগের মন, চরিত্র, তার চাহিদা, তার আঙ্গিক ও রূপকল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে কী করে? এ পরিচয় ছাড়া যে কোনো রচনা কালানুসারে আধুনিক হয়েও যেতে পারে সেকেলে বা out of date হয়ে।
যে ঐতিহ্যের কথা আমি এতক্ষণ ধরে বললাম তাকে গ্রহণ করতে হলে আমাদের মনের গ্রহণশীলতাকে আরো বাড়াতে হবে–সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে আমাদের মনের চাহিদা ও দিগন্তকেও।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই চমৎকার উক্তিটা স্মরণীয়; ‘পাত্র যত বড়ো জল তাহার বেশি ধরে না।’ যত বেশি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে আমাদের মনের পাত্রও তত বেশি বড়ো হবে, বাড়বে তার পরিধিও। যে মনে যত বেশি নানা ঐতিহ্যের সম্পদ সঞ্চিত হবে সে মন তত সহজে কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে সমুদ্র উত্তরণে সক্ষম হবে। বলা বাহুল্য, একমাত্র বড় মনেই জাগবে বড় কিছু সৃষ্টির তাগাদা।
কিন্তু একমাত্র সচেতন বিবেকী মনই পারে যে কোনো ঐতিহ্যের মূল্য বুঝতে ও তাকে নিজের করে নিতে। অতীতকে অতীত জেনে ও সাময়িককে সাময়িক জেনেই গ্রহণ করতে হয়। ঐতিহ্যও ঐতিহ্যই শুধু। ঐতিহ্যের জাবরকাটা কখনো ঐতিহ্যকে গ্রহণ নয়। গ্রহণ মানে যাচাই করে গ্রহণ–নির্বিচারে গ্রহণ নয়। এ বিষয়ে সাহিত্যের ইতিহাসে গ্যেটে, শেকস্পিয়র ও রবীন্দ্রনাথ তিন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এঁরা অতীত থেকে প্রচুর মাল মসলা নিয়ে নিজেদের কল্পনার সাহায্যে যুগোপযোগী বহু ইমারত গড়ে তুলেছেন; যে সব ইমারত অতীতকে বহু পেছনে ফেলে এসেছে। এর জন্য বুদ্ধি ও মনের চর্চা অত্যাবশ্যক; যে মন যাচাই করবে, গ্রহণ করবে, বর্জন করবে আর শিল্পীর কল্পনাকে দেবে কায়া। এই প্রসঙ্গে টি. এস. এলিয়টের মন্তব্যও শোনা যেতে পারে : ‘What we can do is to use our minds, remembering that a tradition without intelligence is not worth having, to discover what is the best life for us not as a political abstraction, but as a particular people in a particular place; what in the past is worth preserving and what should be rejected; and what conditions, within our power to bring about, would foster the society that we desire.’
সমাজ-সচেতন সাহিত্য শিল্পীর যেমন এই ভূমিকা তেমনি ঐতিহ্যেরও সীমা এ পর্যন্তই।
[‘সাহিত্যের ঐতিহ্য’ প্রথম প্রকাশিত হয় উত্তরণ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় (১৯৬০)। পরে তা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা গ্রন্থে সংকলিত হয়।]
সাহিত্যের ভূমিকা
চিন্তা, ভাব, আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা–এ সবই যেমন একদিকে সাহিত্যের উপজীব্য, তেমনি অন্যদিকে এ সবকে জাগিয়ে তোলা, এ সবের দিগন্ত প্রসারিত করাও সাহিত্য শিল্পের এক প্রধান ভূমিকা। আর এ সবেরই ফলশ্রুতি যে সভ্যতা, সংস্কৃতি, তমুদুন ও সার্বিক মানব-চেতনা এ বিষয়েও বোধ করি দ্বিমত নেই। বলা বাহুল্য, চিন্তাই এসব কিছুর মৌল উৎস। তাই চিন্তার উত্তরাধিকার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার–মহত্তম মিরাছেহ। চিন্তার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশ একই সূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রথিত। যুগ যুগ ধরে চিন্তার বিচিত্র ধারা আত্মপ্রকাশের প্রধান বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছে ভাষা আর সাহিত্যকে। ফলে চিন্তার বৈচিত্র্য আর সমদ্ধির সাথে সাথে ভাষা আর সাহিত্যও হয়ে উঠেছে বিচিত্র আর সমৃদ্ধ। ভাবের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে ও চিন্তায় জোয়ার এলে তার প্রকাশেও গতিশীলতা আর বর্ণবৈচিত্র্য অনিবার্য। তাই ভাবের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও বিকাশ হয়েছে অবাধ ও বহুমুখী।