শাস্ত্রীয় লৌকিক ও সামাজিক শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছেন বলেই শরৎচন্দ্রের পক্ষে শ্রীকান্ত বা রাজলক্ষ্মীকে, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে গোরা বা আনন্দময়ীকে আঁকা-নজরুল ইসলামের পক্ষে বিদ্রোহী’ বা ‘বারাঙ্গনা’ লেখা সম্ভব হয়েছে। শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে। বিচার করলে এসব চরিত্র বা লেখা নিশ্চয়ই দণ্ডনীয়। শাস্ত্রের বিচারে রাজলক্ষ্মী বা সাবিত্রী পতিতা ছাড়া কিছুই না। জীবনে সেকুলার আইন তাদের আশ্রয় দিলেও, মৃত্যুর পর শাস্ত্র নরকবাসের কম কোনো দণ্ডই দেবে না। কিন্তু সাহিত্যের বিচারে তারা শুধু। স্মরণীয় নয়, চিরস্মরণীয়ই। বিদ্রোহী’ ও ‘বারাঙ্গনার বেলায়ও তাই। ওই দুই কবিতায় শাস্ত্রের বহু বিধান ও বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। আমীর খসরুর সেই বিখ্যাত উক্তি : ‘কাফিরে ইশকাম মুসলমানি মারা দরকার নিস্ত’ অর্থাৎ আমি প্রেমের কাফের, মুসলমানি দিয়ে আমার দরকার নেই–কবিতা হিসেবে অনবদ্য কিন্তু শাস্ত্রের দিক থেকে মারাত্মক, চুড়ান্ত ব্লাসফেমি! খ্রিস্টানি শাস্ত্র বা মতবাদকে ভিত্তি করে শেক্সপিয়র যেমন তার অমর নাটকগুলি লেখেন নি, তেমনি রবীন্দ্রনাথও হিন্দু শাস্ত্র বা আচার-বিচারকে ফলাও করার জন্য লেখনী ধরেন নি। বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, কোনো কালে কোনো মহৎ শিল্পীই কোনো বিশেষ শাস্ত্র, রাষ্ট্র বা মতবাদের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েন নি। সাহিত্যের এই ঐতিহ্য সৎ-সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরই ঐতিহ্য।
সাহিত্যের ঐতিহ্যের এ গেল অন্তরের দিক অর্থাৎ ভাবের দিক, কিন্তু তার একটা বাইরের দিকও আছে অর্থাৎ ভাষা ও আঙ্গিকের দিক। প্রাণের সঙ্গে দেহের যে সম্পর্ক ভাবের সঙ্গে ভাষারও সেই সম্পর্ক। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকের অর্থাৎ শব্দ, উপমা, ছন্দ, রূপক, প্রতীক, রূপকল্প ইত্যাদিরও পরিবর্তন ঘটে, ঘটেছে। ভাষা নিত্য বহু নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করেছে–এ না করে কোনো জীবন্ত ভাষাই চলতে পারে না। তা হলেও এর অনেক কিছু প্রয়োগনৈপুণ্যে, দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে, অর্থ ব্যাপ্তি ও ইঙ্গিতময়তার জন্য এমনভাবে সাহিত্যের অঙ্গ ও ঐতিহ্য হয়ে পড়েছে যে তা কখনো সাহিত্যের আঙ্গিক থেকে বাদ যাবে না। জোর করে বাদ দিলে ভাষা দুর্বল হবে। তার অঙ্গহানি ঘটবেই। ‘মরিয়া না মরে রাম’–রামায়ণ কাহিনীর সঙ্গে বহু পরিচয় ও ব্যবহারের ফলে এই উক্তিটির বিশেষ অর্থ ও ইঙ্গিত বাংলা ভাষা-ভাষীদের ‘স্মৃতি’ ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি নতুন ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার মতলবে লিখতে বা বলতে শুরু করেন। ‘মরিয়া না মরে রহিম’ তা হলে কোনো allusion-এর স্মৃতি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো অর্থ বা ইঙ্গিত কারো মনে জাগাবে না বলে পাঠক বা শ্রোতার কাছে এ এক অর্থহীন উক্তি হয়েই থাকবে। ‘মজনু পাগল লাইলি প্রেমে, আমি পাগল লা-ইলা’র’–লাইলি-মজনুর কাহিনী আর মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যার পরিচয় নেই নজরুলের এই উক্তির পুরোপুরি তাৎপর্য সে কখনো বুঝতে পারবে না। আর স্বয়ং লেখকের যদি না থাকতো এই ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর পরিচয় তাহলে এমন অর্থ-গর্ভ ও ইঙ্গিতময় উক্তি করা তার পক্ষেও অসম্ভব হত। ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কিংবদন্তি ও সাহিত্যের মাধ্যম বহু বাগধারা ও প্রকাশপদ্ধতি সাহিত্যিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যিক তথা ভাষাশিল্পীর পক্ষে এই ঐতিহ্যকে না মেনে উপায় নেই। মানা মানে বিশ্বাস করা নয়–মানা মানে প্রয়োগ করা। ‘মরিয়া না মরে রাম’ এই উক্তির শব্দহত অর্থে বিশ্বাস না করেও একে প্রয়োগ করা যায়। বিশ্বাস সত্য মিথ্যা বা বাস্তব অবাস্তবের দৃষ্টি দিয়ে সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যের বিচার করতে গেলে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। আমার এক অধ্যাপক বন্ধু হাড়গোড় বের করা কোনো কুৎসিৎ মেয়েকে দেখলে বলে উঠতেন শেক্সপিয়রের তৃতীয় ডাইনির অস্তিত্বে বিশ্বাস করার দরকার হয় না। শেপিয়রের লেখার গুণে অবাস্তব ডাইনিও এভাবে প্রকাশের ঐতিহ্যে তথা সাহিত্যের সত্যে পরিণত হয়েছে। নুরুল মোমেনের এক রচনার নাম নেমেসিস। মরহুম এস. ওয়াজেদ আলী তার এক রচনার নাম দিয়েছিলেন কিউপিডের দুষ্টামী, বিষ্ণু দে তাঁর এক গ্রন্থের নাম দিয়েছেন উর্বশী ও আর্টেমিস; গ্রিক ও হিন্দু পুরাণের সঙ্গে পরিচয় ছাড়া এসব নামের তাৎপর্য বোঝাই তো মুশকিল। দেবতা বা অপদেবতায় বিশ্বাস না করেও আঙ্গিকের এসব ঐতিহ্য যে কোনো লেখকের রচনার অঙ্গ হতে পারে। বরং যত বেশি ঐতিহ্যের সঙ্গে লেখকের পরিচয় হবে তার রচনায় ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্যও তেমনি তত বাড়বে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এমনি বিচিত্র ঐতিহ্যেরই এক লীলাভূমি, ওই কবিতার শব্দগত অর্থ বুঝতে হলেও হিন্দু, মুসলমান ও গ্রিক পুরাণের কিছুটা জ্ঞানের দরকার। যিনি নিজস্ব ধর্মীয় ও খাস জাতীয় ঐতিহ্যের পক্ষপাতী তাঁর কাছে এই কবিতা অস্পৃশ্য বিবেচিত না হয়ে পারে না। ‘ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’, ‘ধরি স্বর্গীয় দূত জিবরাইলের আগুনের পাখা সাপটি,’ আমি অফিসের বাঁশরী এই তিনটি পংক্তি হিন্দু মুসলমান ও গ্রিক এই তিন ঐতিহ্যের ত্রিবেণী সঙ্গম। সাহিত্যে যারা নিছক সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের পক্ষপাতী তারা নজরুলের এই তিনটি পংক্তি নিয়ে কী যে দুরবস্থায় পড়বেন একবার ভেবে দেখুন। তিনটি সম্প্রদায়ের তিন তিনটি সাম্প্রদায়িক মাথা একত্র হলেই তবে এই লাইন তিনটির মর্মোদ্ধার সম্ভব হতে পারে, তার আগে নয়। একতরফা ও বিচ্ছিন্ন ঐতিহ্য-বিশ্বাসের এ হচ্ছে শোচনীয় পরিণাম। অথচ আপনি যদি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী হন তাহলে এক মাথা দিয়েই আপনি তিন তিনটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাদী মাথাকে ঘায়েল করে দিতে পারেন অর্থাৎ এক মাথা দিয়ে তিন মাথার কাজ সারতে পারেন। যেমন নজরুল সেরেছেন।