আশ্চর্য, আমাদের দেশে এরি মধ্যে নাকি কোথাও কোথাও রব উঠেছে যেহেতু রবীন্দ্র-সাহিত্যের ঐতিহ্য বিদেশী, অতএব পরিত্যাজ্য। রামায়ণ মহাভারতের তো কথাই নেই। এ যুগে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের এ এক চমৎকার হাস্যকর নজির। নজরুলকে নিয়ে এখনো অবশ্য মনকে চোখ ঠারানো হচ্ছে। তার নামের জোরেই বোধ হয় তিনি বেঁচে গেলেন। অথচ তার রচনা বহু ঐতিহ্যের সংমিশ্রণেরই ফল।
রাষ্ট্র ও জাতীয়তার দিক দিয়ে ইকবালের সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব নেই সত্য কিন্তু ভাষার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে তার সঙ্গে দূরত্ব অনেক বেশি। বিশেষত ইকবালের প্রায় সব শ্রেষ্ঠ রচনাই পারসিতে লেখা, দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশ থেকে পারসির পাঠ উঠে গেছে–যেটুকু আছে তাও উঠে গেল বলে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে আমি এটাকে অত্যন্ত শোচনীয় মনে করি। কারণ, মুসলমানদের সাহিত্যিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হচ্ছে পারসি। শিক্ষা ও চর্চার অভাবে এর ভাণ্ডার-দ্বার যদি রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে যারা সাহিত্যে ও মননশীলতায় খাস মুসলিম ঐতিহ্যের পরশ পেতে চায়, ওই থেকে নিজেদের মন-মানসের খোরাক সংগ্রহ করতে চায় তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ভূমিকা একরকম আমাদের ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ–তা কখনো আমাদের মনকে কল্পনার রঙে রাঙাতে পারে নি। কিন্তু পারসির বেলায় তা বলা যায় না। পারসি সাহিত্য, বিশেষ করে তার কাব্যাংশ, একদিন আমাদের দেশের বহু বিদ্বজ্জনের রসবোধ তৃপ্তির ও মানস-চেতনার খোরাক হয়েছিল। উর্দু-পারসি বাংলা একই ভাষাগোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখা মাত্র। আরবির তুলনায় এ কারণেও পারসি আমাদের ভাবুকদের মনে অধিকতর সহজগম্য ছিল ও অনায়াসে হতে পেরেছিল তাদের মনের দোসর। তদুপরি পারসি ছিল সুদীর্ঘ কাল ধরে পাক ভারতে শিক্ষা, রাজকার্য ও মননশীলতার বাহন। ফলে পারসি ভাষার কবিরাও এদেশের সাহিত্য-শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়েছিল। সেই ঐতিহ্য ধারা থেকে আজ আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। এ কারণেই পারসি পাঠ উঠে যাওয়াকে আমি শোচনীয় বলেছি। পারসি কাব্যে মাধুর্যের সঙ্গে যে অপূর্ব সৌন্দর্য-চেতনা, জীবনের প্রতি যে সকৌতুক দৃষ্টি আর তার যে রূপকল্প ও প্রকাশের কলাকৌশল দেখা যায় তা যে শুধু মনোহর তা নয়, স্বাস্থ্যপ্রদও। সমুদ্রের বিস্তৃতি এতে না থাকলেও নিস্তরঙ্গ সরোবরের অনাবিল সৌন্দর্যে জীবনের বোধকে এ সাহিত্য জাগিয়ে তুলতে ও জাগিয়ে রাখতে সক্ষম। জীবিকার তাড়নায় আজ আমার সৌন্দর্য ও রসের সেই ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হতে চলেছি, এ কি দুঃখের বিষয় নয়?
পারসি সাহিত্যের আর একটি বড় সম্পদ সুফি ভাবধারা–এই ভাবধারার অন্য ত্রুটি যাই থাক, এ মানুষকে অনেক গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে সহিষ্ণু করে তোলে। এই সহিষ্ণুতা ও মনের উদার পরিমণ্ডল সাহিত্যিক-শিল্পীর অত্যাবশ্যক। তাই আমার বিশ্বাস, পারসি সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে মনের অনেক মূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকা। অথচ আমাদের নিজেদের অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব কোনো সাহিত্যিক ঐতিহ্য নেই–নেই আমাদের কোনো ক্লাসিকস বা এপিক। এদিক দিয়ে উর্দু-বাংলার অবস্থা প্রায় সমান। উর্দুরও নেই কোনো উল্লেখযোগ্য ক্লাসিকস বা এপিক। ফলে আমাদের সাহিত্য জীবনের বুনিয়াদ কিসের ওপর প্রতিষ্ঠা করা হবে তা আমাদের সাহিত্যসেবীদের সামনে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সবাই প্রায় দিশেহারা। তাই কেউ আশ্রয় নিতে চাইছে ইসলামে, কেউ দেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে, কেউ সাম্যবাদে, কেউবা অন্য কিছুতে। সাহিত্যিক-শিল্পীর জন্য এর কোনোটাই নিরাপদ আশ্রয় নয়। ধর্মের কাজ মানুষের সামজিক নীতিবোধ জাগিয়ে তোলা ও মানুষের মনকে দেওয়া আধ্যাত্মিক খোরাক। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ছাড়া ধর্ম কখনো সাহিত্যের পথ ও পাথেয়। হতে পারে না। ধর্ম ব্যাপারটি অত্যন্ত অনড়, যাকে বলে rigid; তাতে পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই। তেমনি রাষ্ট্র, রাজনৈতিক মতবাদ বা ইজমগুলিও তাই। এ সবের কোনো একটাকে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাভূমি করতে গেলে বনের বাঘকে খাঁচায় বন্ধ করলে যে দশা হয় সাহিত্য শিল্পেরও সেই ঘটে। তেমন বাঘের স্থান চিড়িয়াখানা বা সার্কাস ছাড়া আর কোথাও নয়। কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো সাহিত্যিক শিল্পীও কি আজ এ করুণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি? শাস্ত্র, রাষ্ট্র ও মতবাদ–এ সবই এক একটা শৃঙ্খল। সাহিত্য হল মানুষের মনের মুক্তির ক্ষেত্র। তাই সাহিত্যিককে এসব শৃঙ্খল ভেঙে ভেঙেই এগুতে হয়। শৃঙ্খল বা শাসন সবই সামাজিক মানুষের জন্য। লেখকের জন্য লেখার শাসন ছাড়া অন্য কোনো শাসন নেই, অন্তত যখন তিনি লিখতে বসেন তখনকার মতো তিনি সামাজিক বা শাস্ত্রীয় মানুষ নন। তখন তিনি শুধু শিল্পী। শিল্পের শাসনে তিনি যুগপৎ বন্দি ও মুক্ত। নিজের শিল্পের কাছে তিনি বন্দি কিন্তু বাইরের আচার অনুষ্ঠান ও নানা সংস্কারের শৃঙ্খল থেকে তিনি মুক্ত। এ যুগে রাষ্ট্র ও মতবাদের শৃঙ্খল ভাঙার এ স্মরণীয় দৃষ্টান্ত পাস্তেরনাকের ডক্টর জিভাগো। বাংলা সাহিত্যে শাস্ত্রের শৃঙ্খল ভাঙার নজির দেদার। এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম তো রীতিমতো কালাপাহাড়।