[‘সাহিত্যের একটি সমস্যা’ ১৯৬৪-তে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে বন্ধ্যাত্ব কেন?’ শীর্ষ আলোচনার অংশ হিসেবে ধারাবাহিক ভাবে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত। পরে এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]
সাহিত্যের ঐতিহ্য
শিল্পী ছবি আঁকেন সামনে একটা মডেল রেখে। মডেলটা উপলক্ষ্য, লক্ষ্য নয়। লক্ষ হচ্ছে ছবি–যে ছবিতে মডেলকে ছাড়িয়ে শিল্পীর ভাব ও রূপ-কল্পনা কায়া নেয়। কিন্তু মডেল জোগায় ব্যাকগ্রাউন্ড অর্থাৎ শিল্পীর রূপকল্পনায় প্রতিষ্ঠাভূমি একটা অবলম্বন শুধু। তেমনি সাহিত্য-শিল্পীর জন্যও ঐতিহ্য হচ্ছে রচনার ব্যাকগ্রাউন্ড বা প্রতিষ্ঠাভূমি। একটা মডেল মাত্র। কিন্তু এই মডেলের প্রয়োজন শিল্পীর জীবনে একদিন নিঃশেষ হবেই। না হলে তিনি কখনো শিল্পী হতে পারবেন না– থেকে যাবেন সারাজীবন নকলনবিস। Wiertz যে বলেছেন : Nothing is so tiring as a constant close imitation of life, one comes back to inevitably imaginative work : 71 সত্য। শিল্পীকে নিজস্ব রূপ-কল্পনার জগতে ফিরে আসতেই হবে করতে হবে তাকে আবিষ্কার। কিন্তু তার আগে প্রস্তুতি হিসেবে Close imitation of life-এর প্রয়োজন আছে। এটা শিল্পীর শিক্ষানবিসি। প্রস্তুতি বা শিক্ষানবিসি সব শিল্পের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। চিত্র-শিল্প বা ভাস্কর্য থেকে সাহিত্যের দুনিয়াটা আরো বড়, আরো ব্যাপক, তার এলাকা বহুবিস্তৃত এবং তার অন্ধিসন্ধি অনেক বেশি রহস্যঘন। তাই সাহিত্য শিল্পের শিক্ষানবিসিও হতে হবে দীর্ঘায়ত ও কঠোর। ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় এই প্রস্তুতির প্রথম সোপান–শিক্ষানবিসির প্রথম পাঠ। শিল্পী নিজের কল্পনার সাহায্যে যে শিল্প বা সাহিত্য সৃষ্টি করে তার প্রধান ভূমিকা অন্যের কল্পনাকে স্পর্শ করা, তাকে সচেতন করে তোলা। এ ছাড়া যে কোনো শিল্পকার্যই ব্যর্থ। যে শিল্পকার্য এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ বহু যুগ ধরে যা মানুষের মনকে স্পর্শ করে এসেছে, মানুষের হৃদয়ের সলতেটাকে একটুখানি উসকিয়ে দিতে পেরেছে–তেমন শিল্পকার্যকে কোনো সৎ-শিল্পীই উপেক্ষা করতে পারে না।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিল্পায়ন গ্রন্থের প্রথম নিবন্ধ শুরু করেছেন নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়ে : ‘Art is not a pleasure trip, it is a battle’ (Millet) বলা বাহুল্য, এ সংগ্রাম যাবজ্জীবনের সংগ্রাম। সৈনিককে যেমন যুদ্ধে নামার আগে সব হাতিয়ারের সঙ্গে তথা তার ব্যবহার সম্বন্ধে দক্ষ হতে হয়, তেমনি শিল্পীকেও তার জীবন-যুদ্ধের সব প্রকরণের সঙ্গে পরিচয় করে তাকে আয়ত্ত করে নিতে হয় আগে থেকেই। এ পরিচয়ের প্রথম ভিত হলো ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়।
এই প্রসঙ্গে এ যুগের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাদী লেখক টি. এস. এলিয়টের মন্তব্য 2002: Tradition cannot be inherited, and if you want it you must obtain it by great labour.’ কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা ছাড়া কোনো ঐতিহ্যই আয়ত্ত হয় না। এ পরিশ্রম স্বীকার না করে কোনো সাহিত্য-শিল্পীরই রেহাই নেই–অবশ্য যদি তিনি সত্যিকার সাহিত্যিক হন বা হতে চান। Millet-এর যে কথাটা ওপরে উদ্ধৃত হয়েছে অর্থাৎ Art is not a pleasure trip তার বক্তব্য এই একই। ছোট বড় সব শিল্পীকে নিজ নিজ শিল্প-ইমারত গড়ে তুলতে হলে শিল্পের পূর্বাপর সব ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কোনো শিল্পই ভূঁইফোড় নয়–সাহিত্য তো নয়ই। মানুষের ধারাবাহিক সাধনারই ফসল সাহিত্য ও শিল্প।
আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি–কিছুই আর আগের মতো একই ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়–সাহিত্য-শিল্প তো নয়ই। অধিকন্তু সাহিত্য শিল্প কালের সীমায়ও নয় আবদ্ধ। কালের ক্ষয় ও বিচার পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে যেসব সাহিত্য-শিল্প মানুষের চিরন্তন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তা যে দেশের যে জাতের, যে ভাষারই হোক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তা কিছুতেই উপেক্ষণীয় হতে পারে না। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নামে অথবা জাতি কি ভাষাগত কারণে সাহিত্য-শিল্পের স্মরণীয় ঐতিহ্য বিশেষকে উপেক্ষা করা মানে নিজের শিল্প সাধনাকে খর্ব করা–ছোটর জন্য বড়কে ত্যাগ করা।
ঐতিহ্যকে মানা মানে অতীতের ও বর্তমানের যা কিছু স্মরণীয় তাকে যথাযথ মূল্য দেওয়া–এই মূল্য দেওয়ার ওপরই নির্ভর করে সাহিত্য-শিল্পের তথী সভ্যতার ধারাবাহিকতা। সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলি চন্দ্ৰসূর্যের মতোই। এগুলি পরীক্ষিত, অনস্বীকার্য ও সন্দেহাতীতভাবে প্রামাণ্য। বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক Andre Maurois এই প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘Let us have faith in the choice of past centuries. A man may be wrong; so may a generation, but humanity does not make mistakes.’
.
সাহিত্যের ভাষায় যাকে ক্লাসিকস বলা হয়–এইভাবে মানবজাতির পরীক্ষাশালায় তার চুড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক রুচি ও সংস্কারের ফলে সাহিত্যিক বিশেষ বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং অন্যকেও হয়তো সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করতে পারেন। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় যে শিল্পকর্ম টিকে গেছে তার মূল্য তাতে কখনো কমবে না। সত্যনিষ্ঠ সাহিত্যিক-শিল্পীরা চিরকাল ওই দিয়েই নিজেদের মন-মানসের পুষ্টিসাধন করবেই। টলস্টয় শুধু মহামনীষী ছিলেন না, ছিলেন মহাশিল্পীও। তাঁর War and Peace কে অনেকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস মনে করেন, অনেকে মনে করেন তাঁর সৃষ্ট আনা কারেনিনা বিশ্ব সাহিত্যের সেরা নারী-চরিত্র। এমন কি কোনো কোনো ইউরোপীয় সমালোচক এমন মন্তব্যও করেছেন–আনা কারেনিনা ছাড়া রুশ ভাষায় যদি অন্য কোনো বই লেখা নাও হতো তা হলেও রুশ ভাষাকে উপেক্ষা করা যেত না। এহেন টলস্টয় সম্বন্ধে বলা হয়েছে, তাঁর প্রথম জীবনে অর্থাৎ সাহিত্যিক জীবনের প্রস্তুতি ও শিক্ষানবিসির কালে তাঁর প্রথম পাঠ্য ছিল গ্যেটে, ভিকটর হুগো, প্লেটো ও হোমার। বলা বাহুল্য, এরা কেউই টলস্টয়ের স্বজাতি বা রাশিয়ান নন।