সাহিত্যের জন্যও আত্মরক্ষা বড় কথা–এ আত্মরক্ষার জন্য ‘ক্ষুদ্রতা’ আর ‘সংকীর্ণতার’ অপবাদ কিছুটা শুনতে হলেও আপত্তি নেই। যদি বিশ্বসাহিত্য প্রতিষ্ঠাই আমাদের কাম্য হয়, তা হলে সব রকম ‘ক্ষুদ্রতা’ আর ‘সংকীর্ণতা’ পরিহার করে দেশগত বা জাতিগত কোন সাহিত্যের কথা না ভেবে, সহজেই আমরা সংরক্ষণ নীতি ছেড়ে ‘উন্মুক্ত বাজারে’ পা বাড়াতে পারি। কিন্তু দেশগত ও জাতিগত সাহিত্যের যদি কোন মূল্য থাকে আর তা যদি স্বীকৃত হয় তা হলে কোন না কোন রকমের সংরক্ষণ নীতির প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় অন্তত মানতেই হবে। চারা গাছে বেড়া দেওয়ার নিয়ম খুব অস্বাভাবিক নয়।
সাহিত্য গাছের ফল নয় যে আপনা-আপনি ফলবে, বাতি হয়ে পেকে ঝরে পড়বে, কেউ কুড়িয়ে চেখে দেখলেও দেখলে, না-হয় শিয়াল কুকুরে খেয়ে শেষ করলে–সে পরিত্যক্ত বীজ বা আঁটি থেকে আরো গাছ জন্মে দেশটাকে ফলফলান্ত করে তুলবে।
ঠাকুর বাড়ির ফুটফুটে ছেলেটার মোহে নিজের খাদা-নাকা আর কাদা-মাখা ছেলেটাকে অবহেলা করলে বংশ উজাড় হতে বেশি দেরি লাগবে না। কোলে তুলে নেবেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেটা আর নিজের কালো ছেলেটা রবি ঠাকুর হলো না বলে আফসোস করবেন–এ আফসোসের কোনো মানে হয় না। নিজের ছেলেটাকে প্রতিপালন করে বাড়বার সুযোগ দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, ভালোবেসেও প্রতিবেশীর ছেলেকে ভালোবাসা যায়, যায় আদর করা, প্রয়োজন হলে নেওয়া যায় পোষ্য। প্রতিবেশীর ছেলের চেয়ে নিজের ছেলে অপকৃষ্ট বলে তাকে উপেক্ষা করাতেই আপত্তি। এটা ‘সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বিদেশ-বিদ্বেষ বা বিজাতি-ঘৃণা নয়। এ নেহাত জৈবিক আর স্বাভাবিক মানবীয় ব্যাপার।
পরলোকগত বল্লভ ভাই প্যাটেল একবার কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন, ভারতীয় কাপড় বিলাতের শিলমোহর নিয়ে এখন বাংলাদেশের বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। একমাত্র সংরক্ষণ নীতির সাহায্যে আমরা সেই অসহায় অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। একদিন বস্ত্র শিল্পের বাজারে যা ঘটেছিল এখন কি অবিকল সাহিত্যের বাজারে তা ঘটছে না? বাংলাদেশের ভারতীয় পুস্তকের ব্যাপক মুদ্রণ কি আমাদের সাহিত্য-প্রীতির পরিচায়ক, না কি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির নমুনা? এতে কি আমাদের সাহিত্যের অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে? বিলাতের শিলমোহর মারা কাপড়ের সঙ্গে এর তফাত কোথায়? দুই-ই তো ফাঁকি আর দেশের অর্থনীতির ওপর চোরা আঘাত। বইয়ের ব্যাপারে শুধু অর্থনীতির ওপর নয়, সাহিত্যের ওপরও।
সাহিত্যের মূল্য শুধু মানসিক নয়, তার একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে। এ দিকের নিরাপত্তা ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যের অসম্ভব প্রসার তার এক বড় নজির। আমরা যে বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য কিছুটা ‘সংরক্ষণ’ চাই তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সংরক্ষণের অর্থ এ নয় যে, আমরা দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কোন সংযোগই রাখবো না। আমরা চাচ্ছি, আমাদের নির্মীয়মান সাহিত্যের জন্য কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করেও এ নিরাপত্তা কীভাবে রক্ষিত হতে পারে এ বিষয় অর্থনীতিবিদরা ভেবে দেখতে পারেন।
আমার নিজের দু’টা নিবেদন : একটার কথা আগেই বলেছি, দেশের সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম মমতা। দেশের বই-পুস্তককে নিজের সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গ করে দেওয়া। হাজারো ব্যাপারে এমন কি যেখানে প্রাণের দায় (যেমন ঔষধপত্র) আছে সেখানেও আজকাল আমরা আর বিদেশের সঙ্গে তুলনা করি না। সাহিত্যের ব্যাপারেও কথায়। কথায় সে তুলনা নাই বা করলাম–অন্তত কিছুকাল।
আমার দ্বিতীয় নিবেদন : সাহিত্য আমদানির ব্যাপারে কিছুটা নির্বাচন নীতি গ্রহণ অর্থাৎ নির্বিচারে যে-কোন বইপত্র না এনে সাহিত্যমূল্য বিচার করে বই আমদানি করা। লাইসেন্স প্রথা থাকা সত্ত্বেও এখন সে নীতি পালিত হয় বলে মনে হয় না। যে কোনো উপযুক্ত লোক দিয়ে গঠিত কমিটির দ্বারা এ কাজ অর্থাৎ নির্বাচন সহজেই করানো যায়।
বয়স্কদের কথা নাই বা তুললাম। তারা যা হওয়ার তা হয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের যে ছেলে-মেয়ে আর ছাত্র-ছাত্রীরা বড়ো হয়ে উঠছে তাদের আজ দৈহিক খোরাক যোগাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু মানসিক খোরাক জোগাচ্ছে অন্য দেশ বা দেশের সাহিত্য। যদি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আর স্বতন্ত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস করা হয় তা হলে এটা কি শুভ লক্ষণ? এরা কি একদিন অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হবে না? দেশাত্মবোধ আর জাতীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা কি সাহিত্যেরও এক কাজ নয়? সব দেশে জাতীয় সাহিত্য আর সংস্কৃতির বুনিয়াদ পাকা করে নিয়ে তবে বিশ্বসাহিত্য বা বিশ্ব-সংস্কৃতির দিকে পা বাড়ানো হয়, আমাদের যাত্রা কি অনেকটা বিপরীত দিক থেকে শুরু হয় নি? অবশ্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা জাতীয়তায় বিশ্বাস না করলে এসব প্রশ্ন আদৌ ওঠে না।
বাংলাদেশের সাহিত্য বন্ধ্যা হয়ে আছে–এ আমি বিশ্বাস করি না। এখনো আশানুরূপ প্রাচুর্য হয়তো দেখা দেয় নি, তার পেছনে বহুতর কারণ রয়েছে। পাঠকের সহযোগিতা পেলে, এখানকার সাহিত্যের পাঠক সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায় আমাদের সাহিত্যের যে দারিদ্র্য দেখে আমরা আজ কিছুটা হতাশা বোধ করছি তা আর থাকবে না। সাহিত্যের শৈশব দীর্ঘ বলে মাতৃস্নেহও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত। অনেক সময় প্রকাশকরাই পাঠক তৈরি করেন, আমাদের আজো তেমন একটি প্রকাশক সংস্থাও গড়ে ওঠে নি। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারেও কোন ভালো বই (মন্দ বইও) প্রকাশিত হলে আমরা তার খবর পাই কী করে? কেমন করে ওসব বই ঢাকা-চাটগাঁর বাজারে এসে পৌঁছে কোনো কোনোটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই। সুষ্ঠু প্রচার ব্যবস্থার ফলেই এসব ঘটে থাকে। অথচ ঢাকায় প্রকাশিত অনেক বইয়ের খবর আমাদের মফস্বল শহরের স্কুল-কলেজেও কোনোদিন পৌঁছে না। এখন আমাদের অনেকের স্বদেশে সাহিত্যের প্রতি একটা উন্নাসিক মনোভাব রয়েছে–অন্যান্য দেশে সাহিত্য কীভাবে গড়ে উঠেছে সে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে এ মনোভাব অনেকখানি দূর হবে। প্রাথমিক অবস্থায় মহৎ সব কিছুর প্রতি একটা অটল নিষ্ঠা থাকা চাই; অনেক সময় সে নিষ্ঠা হয়তো গোঁড়ামির কাছাকাছি গিয়েও পৌঁছে। তবে স্মরণীয়: সাহিত্যই যোগায় সব রকম গোঁড়ামির সীমা পেরিয়ে উদার সূর্যালোকে পৌঁছার প্রেরণা।