তিরিশ বছরে সাহিত্য-শিল্পের মতো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপারে খুব বেশি আশা করা সঙ্গত নয়। তবে দেখতে হবে গোড়াপত্তন ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা অর্থাৎ সাহিত্য-শিল্পের যে বুনিয়াদি শর্ত তা আমরা পালন করছি কিনা, পদক্ষেপটা পড়ছে কিনা ঠিকভাবে। সাহিত্য ধর্ম বা রাষ্ট্রের শেকলে কখনো বাধা থাকে নি। থাকবেও না কোনো কালে। কাফেরি ফতোয়া নজরুল ইসলাম বা পূর্বসূরী পারস্য কবিদের সাহিত্যের পথ থেকে ফেরাতে পারে নি। ইকবালেও শাস্ত্র-বিরোধী কথার অন্ত নেই। নজরুলকে যারা কাফেরি ফতোয়া দিয়েছিল, দেখা গেছে পরে তারাই হয়েছে গোঁড়া নজরুল-ভক্ত। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটেছে।
খাঁটি সাহিত্যের কাছে শাস্ত্রকে এমন কি রাষ্ট্রীয় শক্তিকেও একদিন মাথা নোয়াতে হবে–এ বিশ্বাসে আমি বিশ্বাসী। ইতিমধ্যেই মিসরে শাস্ত্র অনেকখানি পেছনে হটে গেছে। আধুনিকমনা পাঠক-সংখ্যা অগুনতি হলে শাস্ত্রের পশ্চাদগতি যে দ্রুত ও ত্বরান্বিত হবে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। সাময়িকভাবে সবকিছুই রাহুগ্রস্ত হতে পারে। সাহিত্য একটা বন্ধনমুক্ত ব্যাপার–প্রথমে এ বোধটা থাকা চাই। তারপর চাই তার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি। শেষোক্ত ব্যাপারে আমরা ব্যর্থ, অনিচ্ছুক ও অপ্রস্তুত। সাহিত্য-শিল্প Whole time job। আমরা একজনও সেভাবে সাহিত্যকে নিই নি, সে অদম্য সাহিত্য-প্রেম আমাদের কারো নেই। তারাশঙ্কর মাত্র ত্রিশ টাকা আয় সম্বল করে পাইস হোটেলে খেয়ে কাটিয়েছেন বহুকাল–সে অবস্থায়ও সাড়ে চার শ’ টাকার চাকুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন স্রেফ সাহিত্য-সাধনায় ছেদ পড়বে বলে। সবটুকু শক্তি আর অবসর নিয়ে সাহিত্য করেন বলে অন্নদাশঙ্কর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে আই.সি.এস.-এর চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও শুধু সাহিত্যের খাতিরে সরকারি চাকুরি নেন নি। বেসরকারি চাকুরিও যখনি দেখেছেন সাহিত্যের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখনই তা বিনা দ্বিধায় ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে এদের সাফল্যটা দেখেন, ত্যাগটা দেখেন না। ত্যাগের দীক্ষা যতদিন না হবে, ততদিন সাহিত্যের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল–এ শুধু এক সুখদ আশা হয়েই থাকবে।
আগেই বলেছি সাহিত্য অপ্রাকৃত, অপার্থিব বা অলৌকিক কিছু নয়–নয় কিছুমাত্র আধ্যাত্মিক ব্যাপার, অন্তত জন্ম বিকাশ আর প্রসারের বেলায়। অন্য দশটা পার্থিব আর লৌকিক ব্যাপারের মতই তারও বিকাশের ধারা একই। প্রয়োজন হলে, বিশেষ করে গঠনের যুগে ‘ক্লোজড মার্কেট’ বা সংরক্ষণ রীতি খুব ক্ষতিকর বলে আমার মনে হয় না। ‘সংরক্ষণ’ চাওয়া হচ্ছে নিছক অর্থনৈতিক স্বার্থে, যেভাবেই হোক অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত না হলে সাহিত্য আর সাহিত্যিক দাঁড়াতে পারবে না। এখন লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলার বই বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে ফেলছে। লাইসেন্স তুলে দিয়ে এটাকে উন্মুক্ত বাজার ঘোষণা করলে অবস্থা আরো কাহিল হবে।
সাহিত্যের ব্যাপারেও সব দেশেই অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কোন না কোন ব্যবস্থা আজও আছে। ইংরেজি বহু বইয়ের গায়ে লেখা থাকে এই সংস্করণ কানাডায় বিক্রি নিষিদ্ধ, ঐ সংস্করণ আমেরিকায়, কোনোটা বা গ্রেটব্রিটেনে ইত্যাদি। এসবই তো অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার কলা-কৌশল। প্রকাশ-শিল্পের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে আইন করে ফরাসি প্রকাশকদের বাধা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে কোনো বই কি পশ্চিমবঙ্গে বা কলকাতায় রপ্তানি হয়? পড়ার যোগ্য এক-আধটা বইও কি এখানে ছাপা হয় নি?
শুধু আমদানি-নির্ভর কোন শিল্পই বাঁচতে পারে না, পারে না বাড়তে। বই পুস্তকও একটা শিল্প। দশটা পণ্যের একটা পণ্য। অন্য পণ্যের বেলায় বা সাধারণ নিয়ম বা রাষ্ট্রীয় বিধি তা বই-পুস্তকের বেলায়ও প্রযোজ্য বলেই আমার বিশ্বাস। পৃথিবীর তাবত মহৎ রচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভালো। তাতে মনের আর জ্ঞানের চৌহদ্দি বাড়ে, শেখা যায় লেখার কায়দা-কানুন, মন হয়ে ওঠে বড় আর উদার–এসবে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন দেশের বা কোন শ্রেণীর লেখা বই না পড়লে। মহৎ কিছু যে সৃষ্টি করা যায় না, তা সত্য নয়। সত্য হলে রাশিয়ায়, চীনে–যেখানে কঠোরতম সংরক্ষণ বা ক্লোজড মার্কেট নীতি চলছে সেখানে কোন মহৎ সৃষ্টিই সম্ভব হতো না। কিন্তু তাতো সত্য নয়–সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে, বিজ্ঞানে, চিত্রকলায় তারা তো ক্রমাগতই এগিয়ে চলেছে। শত্রুপক্ষের রিপোর্ট থেকেই তো এসব খবর আমরা জানতে পারছি। এমন কি ওসব দেশে অপ্রধান কবিদের কবিতার বইও নাকি লাখ কপির কমে ছাপা হয় না, আর তা নিঃশেষে বিক্রি হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যানুপাতে আমাদের দেশে বই-পুস্তুকের চাহিদা হলেই আমরা বেঁচে যাই। তা হচ্ছে না বলেই আমাদের আপত্তি।
‘সংরক্ষণ’ নীতি সব ক্ষেত্রে যে ক্ষতিকর তা আমার মনে হয় না। আমরা যে আজ অনেক বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভর হতে পেরেছি তা সংরক্ষণ-নীতিরই ফল।
সংরক্ষণ-নীতি না হলে অনেক কল-কারখানাই এখানে গড়ে উঠতো না–কল কারখানা মানে শুধু উৎপন্ন দ্রব্য নয়, অগণিত মানুষের জীবিকা সংস্থানও। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঝগড়ার একটা কারণ এই যে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের এমপ্লয়মেন্ট বা নিয়োগ সম্বন্ধে তারা মোটেই আমল দিচ্ছেন না। ওখানে যে কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখানে সে রকম আর একটা প্রতিষ্ঠা না করার যে যুক্তি তারা দিয়ে থাকেন তা মানবীয় দিক থেকেও ভ্রান্ত। ‘সংরক্ষণ নীতি’ উঠে গেলে, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের অনেক দৈনিক পত্রিকাই উঠে যাবে–এ উঠে যাওয়ার সঙ্গে শুধু যে মালিকদের স্বার্থ গ্রথিত তা নয়, অনেক সাধারণ মধ্যবিত্ত সন্তানের জীবিকার সম্পর্কও এর সঙ্গে জড়িত। বই পুস্তকও একটা শিল্প–এ শিল্পের ওপর শুধু যে লেখক-পাঠকের ভাগ্য নির্ভর করে তা নয়; প্রকাশক, মুদ্রাকর, দপ্তরি, ব্লকমেকার প্রভৃতি আরও তাদের হরেক রকম কর্মচারীর জীবিকার সম্পর্কও এ-শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। লেখক আর পাঠকের সহযোগিতা না হলে এ শিল্প কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না। চাহিদার ফলে যেমন নানা কল-কারখানা গড়ে উঠেছে, চাহিদার ফলেই যেমন আমাদের সংবাদপত্র শিল্পের প্রসার ঘটেছে তেমনি চাহিদার ফলেই সাহিত্যও গড়ে উঠবে, বৃদ্ধি পাবে তার প্রসার–যদিও অন্যগুলির তুলনায় সাহিত্য বেশ গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।