(মানবতন্ত্র)
মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা করতে হলে চলনে-বলনে-আচরণে, চিন্তায়-কর্মে-প্রতিজ্ঞায় চাই মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধন। এই বোধ থেকেই আবুল ফজল লিখেছেন :
ব্যক্তি বা মানুষ হল সমাজ ও রাষ্ট্রের এক একটি অঙ্গ। সেই মানুষ যদি সৎ না হয়, সেই মানুষের মন থেকে যদি অবিদ্যা দূরীভূত না হয়, সেই মানুষ যদি ‘মধ্যমা প্রতিপ্য’ গ্রহণ না করে, মোট কথা ব্যক্তি মানুষের মন থেকে যদি হিংসা বিদ্বেষ নির্মূল না হয়, তা হলে শান্তি চিরকাল মানুষের নাগালের বাইরে বন্য হংস হয়েই থেকে যাবে।
(মানবতন্ত্র)
আবুল ফজলের প্রায় রচনারই মূলগত আদর্শ মানবতন্ত্র। এমন কি রবীন্দ্র প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি অন্যান্য মানবতাবাদীর মতোই মানবতাকেই ধর্মভেদ-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে স্থান দেন :
হিন্দুর ধর্ম, মুসলমানের ধর্ম, খ্রিস্টানের ধর্ম আলাদা হতে পারে কিন্তু মানুষের ধর্ম এক। ওখানেই মানুষের এক জাতিত্ব ও স্বরূপের প্রকাশ।
(রবীন্দ্র প্রসঙ্গ)
মানুষের শক্তির মহিমাকেও আবুল ফজল মানবতাবাদীর চোখে বিচার করেন। শক্তির পেছনে তিনি সব সময় শুভবুদ্ধিকে সক্রিয় দেখতে চান। কারণ তিনি জানেন, বিবেকশক্তিহীন বৃহৎশক্তি মানবের অকল্যাণই ডেকে আনে। তাঁর ভাষায়;
বৃহৎ শক্তির পেছনে যদি বৃহৎ বিবেকশক্তি সক্রিয় না হয় তা হলে মানব-সভ্যতার কিছুমাত্র উপকার সাধিত হবে না। ইতিহাসে বিবেকহীন শক্তির পরিচয় তৈমুর থেকে হিটলার পর্যন্ত অনেকেই দিয়েছেন, তাতে মানুষের কোন কল্যাণ হয় নি, তাদের নিজেদেরও না। সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করাই মানবতা, তা ধ্বংস করা মানবতা নয়।
(শুভ বুদ্ধি)
আবুল ফজল এই উদার মানবিকতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন। প্রেগতিবাদী। তাই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানবজাতির কল্যাণ-কামনাই তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে, কর্মে ও বক্তব্যে সুস্পষ্ট।
ছয়
এই ছিলেন আবুল ফজল। নিরলসভাবে লিখেছেন, চোখের সামনে কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিকারে সচেষ্ট হয়েছেন; মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। রাজনৈতিক সংকটে ভয় পান নি, সে সংকটে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ভোলেন নি।
এগিয়ে চলাই ছিল আবুল ফজলের ধর্ম। এই এগিয়ে চলার পথে পথের বাধাকে তিনি শুধু অতিক্রম করেন নি, তাকে অপসারণ করে অন্যের চলার পথকে সুগম করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল তার মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে আর শেষ জীবনে বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল, কারণ তিনি সময়ের পিছু পিছু চলেন নি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগের আধুনিকতাকে সব সময় তিনি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। বরং বলা চলে, তিনি সময়ের চলমানতার তুলনায় বরাবর একটু এগিয়েই চলেছে। অন্তরে তার তারুণ্য ছিল সব সময় জাগর।
বহু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকলেও আবুল ফজলের জীবনযাত্রা ছিল সাদা-মাটা, নিরাভরণ। সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি ছিল তার একমাত্র বেশ, শীতে কেবল তাতে যোগ হত শাল বা চাদর। শ্বেত শশ্রুমণ্ডিত শুভ্র বৃদ্ধ যখন কোনো সভামঞ্চে উঠে দাঁড়াতেন তখন শ্রোতামাত্রই উদগ্রীব হয়ে থাকত তার দরাজ ভারী গলায় যুক্তিসিদ্ধ সুস্পষ্ট কথন-নির্দেশনা শোনার জন্য। আজ তিনি নেই। কিন্তু জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় আসনটি তার পাকা হয়েই থাকবে।
মাহবুবুল হক
বাংলা বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সেপ্টেম্বর ২০০০
সম্পাদনা প্রসঙ্গে
এই গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলি ইতিমধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ গ্রন্থই বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। আবুল ফজলের এ সব লেখার যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে তেমনি সমকালীন প্রেক্ষাপটেও এগুলির মূল্যবত্তা কম নয়। এ বিবেচনা থেকেই আবুল ফজলের এই মননঋদ্ধ প্রবন্ধগুলি বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত করা হল।
প্রবন্ধগুলিকে তিনটি পর্বে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। লেখাগুলি কালানুক্রমে বিন্যস্ত।
প্রথম পর্বে সন্নিবেশিত হয়েছে আবুল ফজলের সাহিত্য-বিষয়ক নির্বাচিত প্রবন্ধ। এগুলির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে লেখকের সাহিত্য-বিষয়ক মৌল ধারণা। অবশ্য সেই সঙ্গে এসেছে সাহিত্যের উপকরণ, ঐতিহ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ; এসেছে সাহিত্য সমালোচনাসহ সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের নানা দিক।
দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে আবুল ফজলের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে লেখক শিল্পীর স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ। প্রায় অর্ধশতক ধরে বাঙালি মুসলমানকে তার স্বরূপ অন্বেষার জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করতে হয়েছে তার প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমকালীন সচেতন পাঠক ও সনিষ্ঠ গবেষকদের কাছে তা উদ্ভাসিত হবে এ সব প্রবন্ধের মাধ্যমে।
তৃতীয় পর্বে সংকলিত হয়েছে শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধে আবুল ফজল সমকালীন অনেক জ্বলন্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, বিবেকী সাহসী দৃঢ়তায় উচ্চারণ করেছেন প্রকৃত সত্যকে, পথ-নির্দেশ করেছেন সমস্যা মোকাবেলার। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আমরা এখনও যে সব সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি সেগুলো মোকাবেলায় আবুল ফজলের চিন্তা কেবল আমাদের ভাবনাকে উসকে দেয় না, উত্তরণের পথকেও আলোকিত করে।