‘চাহিদা আর সরবরাহ’ অর্থনীতির কথা বটে কিন্তু আমার বিশ্বাস, জীবনের সব কিছুর সঙ্গেই রয়েছে এর সম্পর্ক। সাহিত্যিক-শিল্পীরা তো বটেই, এমন কি ওলি দরবেশ, পির-মুর্শেদ, ইমাম-মোয়াজ্জেন, পাদ্রি-পুরোহিত সবাই এ শৃঙ্খলে বাধা। এ সবের পেছনে আধ্যাত্মিকতা যতটুকু আছে তার অনেক বেশি আছে পার্থিব চাহিদা আর সরবরাহ-এর টানাপোড়েন। একই পিরের পৃথক হয়ে যাওয়া ওয়ারিশরাও যে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ‘ওরশ করে থাকে, তা মোটেও আধ্যাত্মিক কারণে নয়। সেও এক প্রকার ‘ক্লোজড় মার্কেট। সাহিত্যের ব্যাপারে তা আপত্তিকর হবে কেন? সাহিত্য তো পুরোপুরি পার্থিব ব্যাপার, চাহিদা আর সরবরাহ নীতির বাইরে সাহিত্যেরও বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। ক্লোজড় মার্কেট বা সংরক্ষণ নীতি আমাদের কি কোন ফায়দা করে নি? এ নীতির ফলে অনেক বিষয়ে আমরা এখন স্বাবলম্বী বা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি। আমাদের বই-এর ছাপা, গেটআপ, অঙ্গসজ্জা যে এখন প্রায় কলকাতার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে, তা-ও কলকাতার ওপর নির্ভর না করারই ফল। সংবাদপত্রের পাঠক-সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই সংবাদপত্রের সংখ্যা, এমন কি মানও অনেক বেড়ে গেছে। সাহিত্যের পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমার বিশ্বাস সাহিত্যের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে–সংখ্যা এবং গুণ উভয় ক্ষেত্রে।
এখন আমাদের অবস্থা?
একটি প্রতিনিধি স্থানীয় দৃষ্টান্ত : ঢাকার একটি প্রগতিশীল পত্রিকার তরুণ সম্পাদকের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি নিজেও প্রগতিপন্থী, উচ্চ-শিক্ষিত, দেশের সাংস্কৃতিক জীবন তার নখদর্পণে, আমার সমধর্মী, আমার মতামতের ভক্ত, আমার লেখার অত্যন্ত অনুরক্ত। তার নিজেরই এ দাবি। কিন্তু আশ্চর্য, আমার পাঁচ-সাত বছর আগে প্রকাশিত বইও তিনি পড়েন নি, আলাপে মনে হলো সে সব বইয়ের চেহারাও দেখেন নি তিনি। তার পরিবারটি শিক্ষিত আর সংস্কৃতিবান। তিনি নিজেই জানালেন চিকিৎসার জন্য তিনি শিগগিরই বিলাত যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের লেখকরা বছরে যে কয়খানা বই লেখেন তা কেনার সামর্থ্য যে তাঁর তথা তাঁর পরিবারের আছে তা সহজে অনুমেয়। অথচ কেনেন বলে মনে হয় না। এদিকে বাংলাদেশের সাহিত্যে বন্ধ্যাত্ব সম্বন্ধে তার দুর্ভাবনারও অন্ত নেই। এ ব্যাপারে তিনি ব্যতিক্রম নন–আমরা সকলে এ অপরাধে অপরাধী। আসলে আমাদের জীবনটাই এক স্ববিরোধিতা। আমার বিশ্বাস, আমাদের শিক্ষক, অধ্যাপক, সাহিত্যসেবী, সাংবাদিক (অন্যদের কথা বাদ দিলাম) কারো ঘরে বাংলাদেশের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই কয়টাও আছে কিনা সন্দেহ। এ কয় বছরে বাংলাদেশে পড়বার মতো বই কিছুই লেখা হয় নি, অতি বড়ো স্বদেশ-নিন্দুকও বোধ করি এমন কথা বলবে না। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে স্বদেশ নিন্দুকের সংখ্যা স্বদেশ-প্রেমিকের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। কিনে পড়া দূরে থাকুক অনেক ব্যক্তি দেশের লেখকদের বই বিনে পয়সায় পড়ে দেখার যোগ্যও মনে করেন না। শিক্ষা বিভাগের উচ্চতম চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত আর ইসলামি সংস্কৃতির নামে উচ্চকণ্ঠ এক সুধী ব্যক্তি আমাদের এক তরুণের কাছ থেকে প্রায়ই গল্প-উপন্যাসের বই চেয়ে নিয়ে পড়তেন কিন্তু তিনি নাকি উক্ত তরুণকে খাড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, বাংলাদেশের লেখকদের কোন বই পাঠিয়ে না!
পাঠকের তো এ মনোভাব, প্রকাশক আর গ্রন্থ-বিক্রেতাদের মনোভাবও এর চেয়ে উৎসাহবর্ধক নয়। আমার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নাই বা উল্লেখ করলাম। আমাদের এখানকার প্রতিভাবান তরুণ লেখকদের অনেকেই আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন–তাদের যে-সব বই প্রকাশিত হয়েছে, তা হয় তারা নিজের খরচে ছেপে বের করেছেন না হয় প্রকাশকদের বহু তোয়াজ আর সাধ্য-সাধনা করেই করাতে হয়েছে ছাপাতে রাজি। এমন কি বই দোকানে জমা রাখতেও অনেক দোকানদার রাজি হন না।
বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা আজ শুধু পাঠকের মুখাপেক্ষী নয়, প্রকাশক আর গ্রন্থ বিক্রেতাদেরও মুখাপেক্ষী। লেখক, পাঠক আর প্রকাশক–এ তিনের যোগসূত্রে সাহিত্যের গতি আর সমৃদ্ধি বাধা আর গাঁথা। এ শৃঙ্খলের একটি কড়ার অনুপস্থিতিও সাহিত্যের গতি বিঘ্নিত হতে বাধ্য। শুধু লেখা বা বই পুস্তকের ব্যাপারে নয়, অন্য আরো অনেক সাংসারিক ব্যাপারেও আমার যে অভিজ্ঞতা তাতে আমার ধারণা : আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা যে করে না তা নয়; তবে সে ভক্তি শ্রদ্ধা হচ্ছে পুরোপুরি থিয়োরিটিকেল, প্র্যাকটিকেলের সীমায় তার অবতরণ কদাচিৎ ঘটে। কিন্তু সাহিত্য আর সাহিত্যিক ও সম্পূর্ণ প্র্যাকটিকেল বা বাস্তব ব্যাপার। লেখা আর লেখক দুই-ই একান্তই সলিড–শুধু হাওয়াই ভক্তি-শ্রদ্ধায় তার চলে না। প্রশংসা শুনে সামাজিকভাবে মনটা যে চাঙ্গা হয়ে ওঠে না তা নয় কিন্তু মনের ঠিক নিচেই উদর নামক যে বস্তুটা আছে তা অতি বেশি প্র্যাকটিকেল বলে নিছক প্রশংসায় এর মন মেজাজ কিন্তু একটুও চাঙ্গা হয়ে ওঠে না। মন আর মস্তিষ্কের সঙ্গে এ যন্ত্রটার সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ তা জানার জন্য বায়োলজিস্ট হওয়ার কোন দরকার পড়ে না। আমার বিশ্বাস, শুধু লেখকদের নয়; পাঠক, প্রকাশক, গ্রন্থ বিক্রেতা সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত না হলে অর্থাৎ স্বদেশের সাহিত্যের প্রতি নিবদ্ধ না হলে আমাদের সাহিত্যের দারিদ্র্য ঘোচানোর পটভূমিই রচিত হবে না। দেশের বই দেশের পাঠকরা না কিনলে কে কিনবে? এক সময় ফেরেস্তারা এসে নাকি মুসলমানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতেন কিন্তু বই-পুস্তক পড়ার মতো বীরতুহীন কাজে তাদের তেমন উৎসাহ আছে শোনা যায় নি। কাজেই দেশের অধিকাংশ লেখক মুসলমান বলে তারা এসে যে এখানকার বই-পুস্তক কিনে নিয়ে এখানকার সাহিত্যের সমৃদ্ধির পথ রচনা করে দেবেন তেমন ভরসা আমার নেই। এ বিষয়ে আমি চরম অবিশ্বাসী।