সাহিত্য এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার–অন্যান্য ব্যবহারিক শিল্প প্রয়োজনের তাড়নায় রাতারাতি গড়ে ওঠা হয়ত তেমন অসম্ভব নয়। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পের তেমন কোনো ত্বরিত তাড়না নেই বলে তার গতি স্বাভাবিক নিয়মেই মন্থর। সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব যেমন দীর্ঘ তেমনি ব্যক্তি বা সমাজ মনে তার চাহিদার তাড়না সৃষ্টিও সময় সাপেক্ষ; আর তা আরো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্মরণীয়, সাহিত্যের সমস্যা শুধু লেখক-কেন্দ্রিক নয়, পাঠক-কেন্দ্রিকও। ডিম আগে না মুরগি আগে, গাছ আগে না বীজ আগে–এসব তর্কে না গিয়েও বলা যায়, লেখক আর পাঠক পরস্পরের পরিপূরক। প্রায় ষাট বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন : ‘অনেকে কবিতু করিয়া বলেন যে, পাখী যেমন নিজের উল্লাসেই গান করে লেখকের রচনার উল্লাসও সেইরূপ আত্মগত। পাঠকেরা যেন। তাহা আড়ি পাতিয়া শুনিয়া থাকেন। পাখীর গানের মধ্যে পক্ষি-সমাজের প্রতি যে কোন লক্ষ্য নাই এ কথা জোর করিয়া বলিতে পারি না। না থাকে তো নাই রহিল, তাহা লইয়া তর্ক করা বৃথা। কিন্তু লেখকের প্রধান লক্ষ্য পাঠক সমাজ।’ এ সম্বন্ধে আজো দ্বিমত ঘটার কোন কারণ দেখি না। যে দেশে পাঠক যত বেশি সে দেশে সাহিত্যের প্রসারও তত অধিক–এ তো আমাদের এক সাধারণ অভিজ্ঞতা। পাঠকের মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের মানেরও উন্নয়ন না হয়ে পারে না। অবশ্য উন্নত সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আরো যে কিছু শর্ত নেই তা নয়, যেমন সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যবোধ, সমাজের সার্বিক সংস্কৃতি-চেতনা ইত্যাদি। তবুও পাঠক প্রধান শর্ত, পাঠক ছাড়া আজকের দিনে সাহিত্য আর সাহিত্যিকের বেঁচে থাকাই অসম্ভব। সাহিত্যকে বাদ দিয়ে পাঠক বরং বাঁচতে পারে, তবে সে বাঁচা মন আর মূল্যবোধকে শিকেয় তুলে রেখে বাঁচা। প্রাচীন কালে যে উন্নত সাহিত্য-সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে তার বড় কারণ তখন সাহিত্য ও সাহিত্যিক এমন পাঠক-নির্ভর ছিলো না। রচিত হতো তখন শুধু কবিতাই, আর কবি মাত্রই ছিলেন সভা কবি। রাজাই ছিলেন তখন সাহিত্যের রক্ষক, ভক্ষকও বলা যায়। এখন সে আসন জনসাধারণের। সে জনসাধারণ যদি সাহিত্যের ভক্ষক না হন তা হলে সাহিত্যের ফুল ফোঁটা বিলম্বিত হবেই। সাহিত্য তো আর কোন বনফুল নয় যে আপনাআপনি ফুটে আপনাআপনি ঝরে পড়বে!
লেখক না হয় মরিয়া হয়ে লিখেই চললো; কিন্তু প্রকাশক তা ছাপবে কেন যদি এক হাজার বই ছেপে তাকে পাঁচ সাত বছর বসে থাকতে হয়? তিনি ত ব্যবসায়ী, টাকাটা ফেরত না এলে তার ব্যবসা টিকে কী করে? আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংখ্যায় অনেক বেশি হতে পারি। এ সংখ্যা নিয়ে গর্ব করতেও আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা। এখনও এমন কি দুহাজার স্বদেশপ্রেমিক পাঠকও সৃষ্টি করতে পারি নি, যারা স্রেফ স্বদেশের লেখক, প্রকাশক আর মুদ্রাকরের খাতিরে নির্বিচারে ভালোমন্দ বই কিনে এঁদের বেঁচে থাকার, একটু প্রসারিত হওয়ার সুযোগ দেবেন। না হয় নির্বাচন করে কিনেই সে সুযোগ দিক।
ব্রিটিশ আমলের একটি শোনা ঘটনা : একটা সাহেব তার চাপরাশিকে কিছুটা কাপড় কিনে আনতে দিয়েছিল, কিনে আনার পর সাহেব দেখতে পেলো কাপড়টা জাপানের তৈরি। তৎক্ষণাৎ কাঁচি বের করে কাপড়টা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে সাহেব আবার টাকা দিয়ে চাপরাশিকে বলে দিলে : Made in England কাপড়া লে আও। হয়তো কোনো ব্যাপারেই এতখানি গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা ভালো নয়—সাহিত্য-শিল্পের ব্যাপারে তো নয়-ই। তবুও স্বদেশানুরাগের যে দৃষ্টিভঙ্গি এর অন্তরালে সক্রিয়–তার মূল্য নেহাত কম নয়। ইংরেজ যে নানাদিকে বড় হয়েছে তার পেছনেও রয়েছে এ দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের যে তুলনা নেই তাও এ কারণে। জনৈক আমেরিকা ফেরত বন্ধুর মুখে শুনেছি, ওখানে মোটামুটি পরিচিত যে-কোনো লেখকের কোনো বই ই লাখের কমে ছাপা হয় না, আর বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কয়েক হাজার বই বিক্রি হয়ে যায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ পাঠাগারে। সব প্রকাশিত বই কেনা যাদের জন্য বাধ্যতামূলক ওসব দেশে চলনসই গোটা দুই বই লিখতে পারলেও কোন লেখককেই রাত জেগে সংবাদপত্র অফিসে প্রফ দেখতে হয় না বা করতে হয় না সরকারি চাকুরির শৃঙ্খলে বাধা থেকে জীবিকা অর্জন। ঢাকার এক প্রকাশক-বন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশে ভালো-মন্দ যে বই-ই প্রকাশিত হোক, তার প্রত্যেকটার আঠারো কপি আমেরিকান সরকার বা ঐ সরকারের এজেন্টের কাছে সরবরাহ করার নির্দেশ আছে তাদের প্রতি। আমাদের সরকারের নিজেদের দেশে প্রকাশিত বইগুলো কেনারও এমন কোন ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই।
ভেরা ব্রিটেন (Vera Brittain) একবার লিখেছিলেন, কাগজ দুষ্প্রাপ্য ছিল বলে যুদ্ধের সময় তাঁর একটা বই মাত্র পঞ্চাশ হাজার ছাপতে হয়েছিল আর তা-ও বই মুদ্রাযন্ত্রের জঠর থেকে বেরিয়ে আসার আগেই আগাম বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তার দুঃখ বইগুলো এক সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় তাকে অনেক বেশি ট্যাক্স দিতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, ভেরা ব্রিটেন এমন কোন প্রথম শ্রেণীর লেখিকা নন। শুনতে পাই, পশ্চিমবঙ্গেও এখন প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই পাঁচ হাজারের কম ছাপা হয় না (অবশ্য কবিতা ছাড়া)। অথচ আয়তন আর লোকসংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ আমাদের থেকে কত ছোট। পূজায়-পরবে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা কত বেশি বই কেনে আর সে তুলনায় ঈদে-পরবে আমাদের এখানে কটা বই হয় বিক্রি? বই পড়ার যে অদম্য ক্ষুধা আর নিজের দেশের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার যে আগ্রহ তা আমাদের কোথায়? তার কোন পরিচয় কোথাও আজো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি?