বলা হয়ে থাকে গ্রিক সভ্যতাই আধুনিক সভ্যতার জনক। তার আগে মানুষের ভাবনা-চিন্তা আর সব রকম উপলব্ধি ছিল অশরীরী, অপার্থিব আর অপৌরুষের চেতনায় সীমাবদ্ধ। গ্রিকরাই প্রথম ফিরে তাকায় মানুষের দিকে, মানুষের মন আর মনের অসীম দিগন্ত রেখার পানে। মন আর আত্মা–এ দুয়ের অধিকারী বলেই মানুষ মানুষ। তার স্বাতন্ত্র আর শ্রেষ্ঠত্বও এ কারণে। এ দুয়েরই চর্চা গ্রিক সভ্যতার অবদান। পরবর্তী য়ুরোপীয় সভ্যতাও গড়ে উঠেছে এ পথের অনুসরণ করেই। ‘The Greeks were the first intellectualists. In a world where the irrational had played the chief role, they came forward as the protogonists of the mind.’ (Edith Hamilton. The Greek Way to Western Civilization)
অন্যত্র : ‘Mind and spirit together make up that which separates us from the rest of the animal world, that which enables a man to know the truth and that which enable him to die for truth.’ (ঐ)
মননশীলতার সূচনা যেমন এখান থেকে তেমনি মননশীলতার ফলে যে স্বাধীন চিন্তার উদ্ভব, যা সব বিদ্রোহের মূল কারণ, তারও শুরু এখান থেকেই। ফলে যুক্তিহীন স্বৈরাচারী ও নির্মম পৌরহিত্যতন্ত্রের যে শুধু অবসান ঘটলো তা নয়; ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য-বিজ্ঞান, শিল্প ও রাষ্ট্রতন্ত্রেও দেখা দিল নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন রূপ ও চেহারা। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রেও দেখা দিল নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন রূপ ও চেহারা। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রেরও আবির্ভাব এ কালে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা মানে স্বতন্ত্র চিন্তা–আর স্বতন্ত্র চিন্তাই জন্ম দেয় শিল্প-সাহিত্য, দর্শন আর বিজ্ঞানের, যা সব। সভ্যতার পাদপীঠ। গ্রিকরা মনের আবিষ্কার করেছে, মনের বিচিত্র ফসলে তাদের সভ্যতাও হয়েছে সমৃদ্ধ। মনকে আবিষ্কার করা বা খুঁজে পাওয়া মানে জীবনকে খুঁজে পাওয়া–জীবনের আনন্দ আর উল্লাসকে ফিরে পাওয়া। গ্রিক সভ্যতায় জীবনের আনন্দেরই অভিব্যক্তি ঘটেছে নানাভাবে। এ সভ্যতার ভাব-সন্তান বলে য়ুরোপীয় সভ্যতায়ও আমরা জীবনের বিচিত্র আনন্দেরই প্রকাশ দেখতে পাই।
আমাদের মুশকিল, আমাদের সভ্যতা জীবনমুখী নয়, অনেকখানি পরলোকমুখী। ফলে জীবনের বিচিত্র বিকাশ আর তার আনন্দের প্রকাশ আমাদের সভ্যতায় তেমন ঘটে নি। সভ্যতায় না ঘটা মানে সাহিত্য-শিল্পেও না ঘটা। এ যুগেও আমাদের সমাজ যতখানি অনুষ্ঠান-অনুরাগী ততখানি জীবন-প্রেমিক নয়। মন আমাদের অনেকখানি একই বৃত্তে বাধা। আমাদের সাহিত্যিক-শিল্পীরাও এ বৃত্তরেখা ডিঙিয়ে যেতে পারে না–না পারার কারণ ওপরে উল্লেখিত হয়েছে। মন যদি অবাধে বিচরণ করতে না পারে আর না পারে তাকে অবাধে প্রকাশ করতে, তাহলে সেখানে জীবন-চেতনা তথা জীবনের আনন্দের প্রকাশও অবাধ হতে পারে না। আমাদের এ সীমাবদ্ধতাই আমাদের বিদ্রোহের প্রতিকূল। এ যুগে আধুনিকতার পথেই সাহিত্যে বিদ্রোহের আবির্ভাব–আধুনিকতা মানে সমকালীন জীবন ও জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া; উন্মুক্ত চোখে তার নগ্ন রূপটা দেখে নেওয়া আর তাকে শিল্পায়িত করা। এ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বলে আমাদের আধুনিকতাও হচ্ছে না খাঁটি। ফলে বলিষ্ঠ কোন বিদ্রোহের সুরও আমরা শুনতে পাচ্ছি না আমাদের সাহিত্য ও শিল্পে। মনে হয়, বিদ্রোহী সাহিত্য-শিল্পীর জন্য আমাদের আরো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে।
বিদ্রোহ বলিষ্ঠ জীবন আর জীবনমুখী দর্শনের অভিব্যক্তি–আমাদের জীবন তার বিপরীত। কবর বা সমাধিসৌধের যত কদর আমাদের সমাজে তার সিকির সিকিও রঙ্গমঞ্চের নয়। বলা বাহুল্য, সমাধিসৌধ পরলোকমুখী দর্শনেরই প্রতীক আর রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার জীবনমুখী দর্শনের।
(মার্চ, ১৯৬৮)
[‘সাহিত্যে বিদ্রোহ’ প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৬৮ সালে। এটি পরে সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধে গ্রন্থভুক্ত হয়।]
সাহিত্যের উপকরণ
জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কিছুই সাহিত্যের উপকরণ–মানুষের চেতনা, অনুভব আর কৌতূহলকে যা স্পর্শ করে সে সবকেই সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ হয়তো একটা শিথিল ঢালা কথা। কারণ যে কোন উপকরণ সাহিত্যে ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে মাঝখানে আরো বহু স্তর পার হয়ে আসতে হয়। জীবন, জীবনের ঘটনা আর অভিজ্ঞতা–এ সব স্রেফ কাঁচা মাল। অন্য কাঁচা মাল যেভাবে পণ্য বা বস্তু হয়ে ওঠে, এসবও সেভাবেই সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে ওঠে। অন্য কাঁচামালের যে রূপান্তর, এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তরণ যা পুরোপুরি ব্যবহারিক তথা যান্ত্রিক বলে চাক্ষুষ আর সর্বজনদৃশ্য এবং সেভাবেই তা গ্রাহ্য। গো চর্মটা কী করে নানা স্তর পার হয়ে জুতো হয়ে ওঠে অথবা সবুজ পাট কী করে কার্পেটে রূপান্তরিত হয় তার সব প্রক্রিয়াই চোখে দেখা যায়, অবিশ্বাস কি অনুমানের অবসর তাতে নেই। তা নিয়ে তাই বিতর্কও ঘটে না।
কিন্তু সাহিত্য বস্তুটা এভাবে তৈরি হয় না আর ওটা বাহ্যিক বা ব্যবহারিক নয়। মোটেও। বাহ্যিক ঘটনা উপকরণ জোগায় সত্য কিন্তু সাহিত্যে রূপান্তরিত হওয়ার আগে তার যা কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তা সম্পূর্ণভাবে মানসিক তথা আভ্যন্তরিক–যেখানে চক্ষু-কর্ণের প্রবেশ নিষেধ। এ কারণে সাহিত্যের উপকরণ কথাটায় জটিলতা যেমন আছে তেমনি বিভ্রান্তি ঘটারও সুযোগ রয়েছে অনেক বেশি ঘটেও প্রচুর। তাই অনেক সময় ঘটনার নিখুঁত বর্ণনাকেও অনেকে সৎ-সাহিত্য বলে অভিহিত করে থাকেন। কবি থেকে সাংবাদিক বা শিল্পী থেকে ফটোগ্রাফার যে বর্ণনায় আর চিত্রণে সুদক্ষ তাতে সন্দেহ নেই–তাই বলে সাংবাদিকের নিখুঁত বর্ণনাকে বা ফটোগ্রাফারের নিপুণভাবে ভোলা ছবিকে কেউ সাহিত্য কি শিল্পের মর্যাদা দেবে না। যে মানসিক ক্রিয়ায় ঘটনা বা কোন বিশেষ অনুভব সাহিত্য আর শিল্প হয়ে ওঠে তার স্পর্শ ঐ সবে লাগে নি বলে ঐ সব অবিকল বা তার বেশি হতে পারে নি। এই বেশি হওয়াটাই মানসিক ক্রিয়া, এজন্যই শিল্পকে জীবনের চেয়ে বৃহত্তর (Larger than life) বলা হয়। যা আছে বা যা ঘটেছে। তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার নামই সাহিত্য বা শিল্প। এ কথাটাই রবীন্দ্রনাথ আরো সুন্দর করে বলেছেন তাঁর ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় :